Friday, October 3, 2025
Homeসংস্কৃতিসাক্কারার বিড়াল: এক্স-রে স্ক্যানে উন্মোচিত মমির গোপন রহস্য

সাক্কারার বিড়াল: এক্স-রে স্ক্যানে উন্মোচিত মমির গোপন রহস্য

সাক্কারার বিড়াল: এক্স-রে স্ক্যানে উন্মোচিত মমির গোপন রহস্য


মিশরীয় সভ্যতা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম প্রাচীন ও রহস্যময়। পিরামিড, মমি, দেবদেবীর পূজা এবং সমাধিক্ষেত্র নিয়ে এই সভ্যতা দীর্ঘদিন ধরেই ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। মিশরের রাজধানী কায়রোর কাছাকাছি অবস্থিত সাক্কারা নেক্রোপলিস বা সমাধিক্ষেত্র হাজার বছরের পুরোনো অসংখ্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভাণ্ডার। এখানেই আবিষ্কৃত হয়েছিল বিপুল সংখ্যক বিড়ালের মমি, যা পরবর্তীতে পরিচিত হয় “সাক্কারার বিড়াল” নামে।

এই আবিষ্কার কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণেই নয়, বরং প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতিতে বিড়ালের বিশেষ স্থানটিকেও নতুন করে তুলে ধরেছে। মিশরের নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে পিরামিড, ফারাও, ও রহস্যময় মমির চিত্র। তবে শুধু মানবদেহ নয়, প্রাচীন মিশরীয়রা প্রাণীদেরও মমি করে সমাধিতে রাখত। এর পেছনে ছিল গভীর ধর্মীয় বিশ্বাস ও প্রতীকী তাৎপর্য। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল বিড়াল-মমি। বিড়াল ছিল দেবী বাসতেত-এর পবিত্র প্রতীক, যিনি সুরক্ষা, উর্বরতা ও মাতৃত্বের দেবী রূপে পূজিত হতেন।

সাক্কারার বিড়াল এর মমির ইতিহাস

খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে, বিশেষ করে তৃতীয় অন্তর্বর্তী ও পরবর্তী যুগে (৯৫০ খ্রিস্টপূর্ব – খ্রিস্টীয় ৩য় শতক), মিশরের বিভিন্ন অঞ্চলে লক্ষাধিক বিড়াল-মমি তৈরি করা হয়। এসব মমি মন্দিরে উৎসর্গ করা হতো বা মৃতের সঙ্গে কবর দেওয়া হতো যাতে আত্মা সুরক্ষিত থাকে। বিশেষত সাক্কারা অঞ্চল ছিল বিড়াল-মমির গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত। এখানে বহু বিড়াল মমি ও বিড়ালদেবী বাসতেতের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে। তবে এই ধর্মীয় অভ্যাসের পেছনে যে শুধু পবিত্রতা নয়, মাঝে মাঝে প্রতারণার ছোঁয়াও ছিল, তা বোঝা গেল এক আশ্চর্য এক্স-রে স্ক্যানের মাধ্যমে।

সাক্কারা: মিশরের নেক্রোপলিস

সাক্কারা প্রাচীন মিশরের অন্যতম বিখ্যাত নেক্রোপলিস। এটি মেমফিস নগরীর সমাধিক্ষেত্র হিসেবে খ্যাত ছিল। এখানে হাজার বছরের পুরোনো সমাধি, মন্দির, পিরামিড এবং অসংখ্য মমি আবিষ্কৃত হয়েছে। ইউনেস্কো ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, সাক্কারা কেবল রাজাদের সমাধিক্ষেত্র নয়, বরং সাধারণ জনগণ ও ধর্মীয় প্রাণীদেরও সমাধিস্থল ছিল।

বিড়াল ও প্রাচীন মিশরীয় সংস্কৃতি

প্রাচীন মিশরে বিড়াল ছিল অত্যন্ত পবিত্র প্রাণী। তারা বিশ্বাস করত, বিড়াল হলো দেবী বাস্তেত (Bastet)-এর প্রতীক। বাস্তেত ছিলেন গৃহ, উর্বরতা, মাতৃত্ব ও রক্ষাকারী শক্তির দেবী। বিড়ালের শিকারী প্রবৃত্তি (ইঁদুর ও সাপ ধ্বংস করার ক্ষমতা) কৃষিভিত্তিক সমাজে অমূল্য অবদান রাখত। তাই বিড়ালকে তারা শুধু পোষা প্রাণী হিসেবে নয়, বরং দেবতার দূত হিসেবেই শ্রদ্ধা করত। বিড়াল হত্যা প্রাচীন মিশরে ছিল গুরুতর অপরাধ। ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, যদি কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি বিড়ালকে হত্যা করত, তবে তার মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত হতে পারত।

সাক্কারার বিড়ালের আবিষ্কার

১৮৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাক্কারায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননে অসংখ্য বিড়ালের মমি আবিষ্কৃত হয়েছে। সবচেয়ে আলোচিত আবিষ্কারটি ঘটে ২০১৮ সালের নভেম্বরে, যখন মিশরের প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয় ঘোষণা করে যে, তারা সাক্কারায় নতুনভাবে সাতটি সমাধিক্ষেত্র উন্মোচন করেছে। এর মধ্যে তিনটি সমাধি বিশেষভাবে বিড়ালদের উৎসর্গ করা হয়েছিল।

এখান থেকে পাওয়া যায়: হাজার হাজার বিড়ালের মমি, কাঠের ও ব্রোঞ্জের তৈরি বিড়ালের মূর্তি, বাস্তেত দেবীর প্রতীকচিহ্ন খোদাই করা প্রতিমা, অন্যান্য প্রাণীর মমি (কোবরা, কুমির, স্কারাব পোকা ইত্যাদি) এই আবিষ্কার প্রমাণ করে যে, প্রাচীন মিশরে বিড়াল কেবল পোষা প্রাণী নয়, বরং ধর্মীয়ভাবে পবিত্র প্রাণী হিসেবে গণ্য হতো।

ধর্মীয় ও সামাজিক তাৎপর্য

বাস্তেত দেবীর পূজা – সাক্কারার বিড়ালের মমি মূলত বাস্তেত দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হত। মানুষ বিশ্বাস করত, মমি করা বিড়াল উৎসর্গ করলে তাদের পরিবার আশীর্বাদ ও সুরক্ষা লাভ করবে।

সমাধি সংস্কৃতি – মিশরীয়রা মানুষ ও প্রাণী উভয়কেই মৃত্যুর পর মমি করত। তারা বিশ্বাস করত, মমি করলে আত্মা অমরত্ব লাভ করে এবং পরকালে দেবতাদের সঙ্গে যুক্ত হয়।

অর্থনৈতিক ভূমিকা – বিড়াল মমি করার একটি বড় ব্যবসা গড়ে উঠেছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণায় জানা গেছে, হাজার হাজার বিড়াল বিশেষভাবে জন্মানো ও পালন করা হতো, যাতে তাদের মমি বিক্রি করা যায়।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার বিশ্লেষণ

আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন CT স্ক্যান এবং এক্স-রে, ব্যবহার করে গবেষকরা আবিষ্কার করেছেন: অনেক বিড়ালের মমি নিখুঁতভাবে সংরক্ষিত, কিছু বিড়ালকে তরুণ বয়সে উৎসর্গ করার জন্য হত্যা করা হতো, মমি করার প্রক্রিয়ায় ন্যাট্রন লবণ, রেজিন ও কাপড় ব্যবহৃত হত। এই বিশ্লেষণ প্রমাণ করে যে, বিড়ালের মমি কেবল ধর্মীয় নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ধর্মবিশারদরা মনে করেন, প্রাচীন মিশরে মন্দির ও ধর্মীয় উৎসবের সময় বড় পরিমাণে প্রাণী-মমি তৈরির চাহিদা ছিল। এর ফলে অনেক মমি প্রস্তুতকারক শর্টকাট গ্রহণ করত—মাঝেমধ্যে অঙ্গহীন বা প্রতীকী মমিও তৈরি করা হতো। এতে কখনো প্রতারণা থাকলেও, অনেক ক্ষেত্রে এটি ছিল প্রতীকী উৎসর্গের রূপ। শুধু একটি বিড়ালের কিছু অংশ বা তার প্রতিরূপ দেবীর প্রতি উৎসর্গ হিসেবে যথেষ্ট মনে করা হতো।

আধুনিক কালের তাৎপর্য

আজকের দিনে সাক্কারার বিড়াল বিশ্বজুড়ে পর্যটক ও গবেষকদের আকর্ষণ করছে। কায়রোর ইজিপশিয়ান মিউজিয়াম ও অন্যান্য জাদুঘরে এই মমিগুলো প্রদর্শিত হয়। এরা শুধু মিশরের ইতিহাস বোঝাতেই সাহায্য করছে না, বরং প্রাচীন মানুষের প্রাণী ও ধর্মীয় বিশ্বাসের সম্পর্ক সম্পর্কেও আলোকপাত করছে।

সাক্কারার বিড়াল আসলে প্রাচীন মিশরের ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও অর্থনীতির এক জীবন্ত প্রতীক। এই আবিষ্কার আমাদেরকে বুঝতে সাহায্য করে যে, প্রাচীন মিশরীয়রা প্রাণীকে কেবল ব্যবহারিক দিক থেকে নয়, বরং আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণ থেকেও গভীরভাবে মূল্যায়ন করত। বিড়াল ছিল একদিকে শস্যক্ষেতের রক্ষক, অন্যদিকে দেবী বাস্তেতের পবিত্র দূত। ফলে বিড়ালের প্রতি শ্রদ্ধা কেবল আবেগ বা ভালোবাসার বিষয় ছিল না, বরং এটি এক সুসংগঠিত ধর্মীয় ও সামাজিক প্রথার অংশ।

সাক্কারার বিড়াল আমাদের সামনে যে বিষয়গুলো স্পষ্ট করে তোলে—

ধর্মীয় তাৎপর্য – বিড়ালকে মমি করা ও দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা প্রমাণ করে মিশরীয়দের বিশ্বাস কতটা গভীর ছিল। তারা প্রাণীর মাধ্যমে দেবতার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করত, যা তাদের জীবনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

সমাজ ও অর্থনীতি – হাজার হাজার বিড়াল মমি করা দেখায় যে, এটি ছিল একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্প ও বাণিজ্য। এতে বিশেষ মন্দির, পুরোহিত, কারিগর ও ব্যবসায়ীরা যুক্ত ছিল।

সংস্কৃতির বহুমাত্রিকতা – সাক্কারার আবিষ্কার কেবল মিশরের ইতিহাস নয়, সমগ্র মানবসভ্যতার সংস্কৃতি বোঝার ক্ষেত্রেও মূল্যবান। এটি প্রমাণ করে মানুষ সবসময় প্রাণীকে কেবল উপযোগী জীব হিসেবে নয়, বরং প্রতীকী ও আধ্যাত্মিক সত্তা হিসেবেও দেখেছে।

মানব-প্রাণী সম্পর্কের ইতিহাস – সাক্কারার বিড়াল আমাদের শেখায় যে, মানুষের সঙ্গে প্রাণীর সম্পর্ক হাজার হাজার বছর ধরে সহাবস্থানের মাধ্যমে গড়ে উঠেছে। আজও আমরা পোষা প্রাণীকে পরিবারের সদস্য হিসেবে দেখি, আর মিশরীয়রা সেটিকে দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে দেখত।

    সবশেষে বলা যায়, সাক্কারার বিড়াল শুধুমাত্র প্রাচীন এক সমাধিক্ষেত্রের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নয়, বরং এটি মানবসভ্যতার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের এক অমূল্য দলিল। এর মাধ্যমে আমরা অতীতের মানুষের বিশ্বাস, ভয়, আশা ও ভালোবাসার এক অনন্য প্রতিচ্ছবি পাই। সাক্কারার বিড়াল তাই কেবল ইতিহাস নয়—এটি আজও আমাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা, যেখানে মানুষ, প্রাণী ও দেবতার মাঝে জটিল অথচ গভীর এক সম্পর্কের বর্ণনা লুকিয়ে আছে।

    তথ্যসূত্র:

    National Geographic, 2019 – “Cat Mummy Isn’t What It Seems”

    BBC News – “X-ray scans reveal secrets inside ancient cat mummy”

    Musée des Beaux-Arts de Rennes (France)

    Itihasar Golpo
    Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
    Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
    RELATED ARTICLES

    LEAVE A REPLY

    Please enter your comment!
    Please enter your name here

    Most Popular

    Recent Comments