বন্যপ্রাণী ওয়ালাবি
ওয়ালাবি (Wallaby) হল অস্ট্রেলিয়া এবং আশেপাশের দ্বীপাঞ্চলের এক ধরনের তৃণভোজী মারসুপিয়াল বা থলিবিশিষ্ট প্রাণী, যারা আকারে ক্যাঙ্গারুর তুলনায় ছোট হলেও দেখতে অনেকটা একই রকম। ক্যাঙ্গারুদের মত এদেরও লম্বা শক্তিশালী লেজ, বড় পেছনের পা এবং ছোট সামনের পা রয়েছে, যা লাফিয়ে চলাচল করতে সাহায্য করে। এরা Macropodidae পরিবারভুক্ত, যার অর্থ “বড় পা”। বর্তমানে প্রায় ৩০ প্রজাতির ওয়ালাবি পাওয়া যায়।
বাসস্থান ও বিস্তার
ওয়ালাবিরা মূলত অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া এবং পাপুয়া নিউ গিনির কিছু অংশে বিস্তৃত। অস্ট্রেলিয়ার বনাঞ্চল, তৃণভূমি, শুষ্ক এলাকা এবং উপকূলবর্তী ঝোপঝাড়—সব জায়গায়ই ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির ওয়ালাবি পাওয়া যায়। কিছু প্রজাতি পাহাড়ি বা পাথুরে এলাকায় বসবাস করে, যাদের রক ওয়ালাবি বলা হয়। এরা খাড়া ঢাল ও পাথরের মধ্যে লাফিয়ে চলাফেরা করতে খুব দক্ষ।
শারীরিক বৈশিষ্ট্য
ওয়ালাবিরা আকারে ছোট থেকে মাঝারি মাপের হয়। পূর্ণবয়স্কদের উচ্চতা সাধারণত ৩০ সেন্টিমিটার থেকে ১ মিটার পর্যন্ত এবং ওজন ২ থেকে ২৪ কিলোগ্রামের মধ্যে হয়। বামন ওয়ালাবি হল এই প্রজাতির সবচেয়ে ছোট সদস্য এবং ক্যাঙ্গারু পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য। এর দৈর্ঘ্য নাক থেকে লেজ পর্যন্ত প্রায় ৪৬ সেমি (১৮ ইঞ্চি) এবং এর ওজন প্রায় ১.৬ কেজি (৩.৫ পাউন্ড)।
পেছনের পা: লম্বা ও শক্তিশালী, যা দ্রুত এবং দূরে লাফানোর জন্য অভিযোজিত।
লেজ: পুরু ও পেশিবহুল, ভারসাম্য রক্ষা ও বিশ্রামের সময় ভর দেওয়ার কাজে লাগে।
ফার বা লোম: বাদামি, ধূসর বা কালচে রঙের, যা বাসস্থান অনুযায়ী ছদ্মবেশে সাহায্য করে।
মাথা ও কান: মাথা সরু এবং কান তুলনামূলক বড়, যা শিকারি সনাক্তে সাহায্য করে।
খাদ্যাভ্যাস
ওয়ালাবি তৃণভোজী। এরা মূলত ঘাস, পাতা, ছোট ডালপালা, ফুল এবং কখনও কখনও ফল খায়। শুষ্ক এলাকায় বসবাসকারী প্রজাতি জলসংরক্ষণের জন্য বিশেষভাবে অভিযোজিত; তারা উদ্ভিদ থেকে প্রয়োজনীয় পানি সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং দীর্ঘ সময় পানি ছাড়া থাকতে পারে।
আচরণ ও জীবনধারা
ওয়ালাবিরা মূলত লাজুক ও শান্ত স্বভাবের, তবে বিপদের সময় দ্রুত লাফিয়ে পালাতে পারে। কিছু প্রজাতি গোধূলি ও রাতে সক্রিয় থাকে (nocturnal), আবার কিছু দিনে সক্রিয় হয়।
গোষ্ঠীবদ্ধ জীবন: এরা সাধারণত ছোট দলে থাকে, যাকে “মব” বলা হয়। দলে থাকলে শিকারির হাত থেকে রক্ষা পাওয়া সহজ হয়।
যোগাযোগ: শারীরিক ভঙ্গি, লেজের নড়াচড়া ও শব্দের মাধ্যমে যোগাযোগ করে। বিপদে লেজ বা পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে সতর্ক সংকেত দেয়।
প্রজনন
ওয়ালাবির প্রজনন বৈশিষ্ট্য মারসুপিয়ালদের মতোই। স্ত্রী ওয়ালাবির গর্ভকাল খুব ছোট, মাত্র ৩০-৩৫ দিন। এরপর অতি ছোট ও অপরিণত বাচ্চা জন্ম দেয়, যা মায়ের থলিতে ঢুকে দুধ খেয়ে বড় হতে থাকে। থলির মধ্যে বাচ্চা প্রায় ৬-৯ মাস থাকে এবং পরে বাইরের জগতে আসতে শুরু করে, তবে মাঝে মাঝে আবার থলিতে ফিরে যায়।
প্রজাতি
প্রধান কিছু প্রজাতি হলো:
রক ওয়ালাবি (Rock Wallaby): পাথুরে ও পাহাড়ি এলাকায় থাকে, অসাধারণ লাফ দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
টামার ওয়ালাবি (Tammar Wallaby): আকারে ছোট, দক্ষিণ ও পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ায় পাওয়া যায়।
সোয়াম্প ওয়ালাবি (Swamp Wallaby): জলাভূমি ও ঘন বনাঞ্চলে বাস করে, গাঢ় রঙের লোম থাকে।
এজাইল ওয়ালাবি (Agile Wallaby): খোলা তৃণভূমিতে থাকে, দ্রুত দৌড়াতে পারে।
শিকারি ও হুমকি
প্রাকৃতিক শিকারিদের মধ্যে রয়েছে ডিঙ্গো, ঈগল এবং কিছু বড় সাপ। ইউরোপীয় উপনিবেশকারীদের আগমনের পর শেয়াল ও বন্য বিড়ালও এদের জন্য বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া বাসস্থান ধ্বংস, সড়ক দুর্ঘটনা ও খরা ওয়ালাবির জনসংখ্যা হ্রাস করছে। কিছু অঞ্চলে এদের শিকারও করা হয় চামড়া ও মাংসের জন্য।
সংরক্ষণ
বেশিরভাগ ওয়ালাবি প্রজাতি এখনো “Least Concern” বা কম ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হলেও কিছু প্রজাতি, যেমন ব্রিডলড নেল ওয়ালাবি (Bridled Nail-tail Wallaby) এবং প্রোসারপাইন রক ওয়ালাবি (Proserpine Rock Wallaby), গুরুতরভাবে বিপন্ন। অস্ট্রেলিয়ায় সংরক্ষণ প্রকল্প, শিকার নিয়ন্ত্রণ এবং বাসস্থান পুনর্গঠন প্রোগ্রাম চালু রয়েছে। জাতীয় উদ্যান ও সংরক্ষিত এলাকায় এদের জন্য নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করার চেষ্টা চলছে।
মানবসম্পর্ক
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা ওয়ালাবিকে খাদ্য ও চামড়ার উৎস হিসেবে ব্যবহার করত এবং সাংস্কৃতিক গল্পে এদের উল্লেখ আছে। আজও ওয়ালাবি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় প্রাণী, বিশেষ করে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণকেন্দ্র ও প্রাকৃতিক পার্কে।
ওয়ালাবি অস্ট্রেলিয়ার বন্যপ্রাণের একটি অনন্য অংশ, যারা অভিযোজন ক্ষমতা, লাফানোর দক্ষতা এবং থলিবিশিষ্ট প্রজনন পদ্ধতির জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। পরিবেশগত পরিবর্তন ও মানবসৃষ্ট হুমকির মুখে কিছু প্রজাতি বিপন্ন হলেও সংরক্ষণ প্রচেষ্টা এদের অস্তিত্ব রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য বজায় রাখতে ওয়ালাবির উপস্থিতি অপরিহার্য, তাই তাদের আবাসস্থল ও জীবনচক্র রক্ষায় আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন।
তথ্যসূত্র:
Australian Museum – Wallabies
National Geographic – Wallaby Facts
Britannica – Wallaby
World Wildlife Fund Australia – Protecting Native Species