ভাইকিং সভ্যতা
ভাইকিং সভ্যতা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরোপীয় সংস্কৃতি যা আনুমানিক ৮ম থেকে ১১শ শতাব্দী পর্যন্ত স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহ—বর্তমান নরওয়ে, সুইডেন এবং ডেনমার্কে—গড়ে উঠেছিল। ভাইকিং শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে প্রাচীন নর্স ভাষার víkingr থেকে, যার অর্থ “সমুদ্রযাত্রাকারী” বা “দস্যু।” ভাইকিংরা ছিলেন দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, দক্ষ নাবিক, বিচক্ষণ ব্যবসায়ী এবং মাঝে মাঝে কৃষক ও কারিগরও।
উদ্ভব ও সময়কাল
ভাইকিং যুগ আনুষ্ঠানিকভাবে ৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের লিন্ডিসফার্ন নামক একটি খ্রিস্টান গির্জায় আক্রমণের মাধ্যমে শুরু হয়। এই যুগটি প্রায় ২৫০ বছর ধরে স্থায়ী হয়, যার সমাপ্তি হয় ১০৬৬ সালের ব্যাটল অব হেস্টিংসের পর।
ভ্রমণ ও উপনিবেশ স্থাপন
ভাইকিংরা শুধু স্ক্যান্ডিনেভিয়াতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা ইউরোপের অনেক দেশেই অভিযান চালিয়েছিল—ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, রাশিয়া, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এমনকি উত্তর আমেরিকার উপকূলে (ল্যাঞ্জে আউ মেদোস, বর্তমান কানাডা) পর্যন্ত তারা পৌঁছায়। তারা নদীপথ এবং সমুদ্রপথ ব্যবহার করে নিজেদের সম্প্রসারিত করেছিল এবং অনেক স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
সমাজব্যবস্থা
ভাইকিং সমাজ ছিল স্তরবিন্যস্ত। সমাজের উচ্চস্তরে ছিলেন জার্ল বা অভিজাত শ্রেণি, যারা ছিল জমিদার, যোদ্ধা বা শাসক। মধ্যবিত্ত ছিল কার্ল, যারা ছিলেন কৃষক, কারিগর ও ব্যবসায়ী। সর্বনিম্ন স্তরে ছিল থ্রাল বা দাস। নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য নির্দিষ্ট সামাজিক ভূমিকা ছিল, তবে ভাইকিং নারীরা তুলনামূলকভাবে স্বাধীনতা ভোগ করত। তারা জমি মালিক হতে পারত, বিবাহবিচ্ছেদ করতে পারত এবং কখনো কখনো যুদ্ধে অংশগ্রহণও করত।
ধর্ম ও বিশ্বাস
ভাইকিংদের ধর্ম ছিল বহু দেবতা পূজাভিত্তিক। তারা প্রধানত নর্স পুরাণ অনুসরণ করত। কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেবতা হলেন:
ওডিন – জ্ঞান ও যুদ্ধের দেবতা
থর – বজ্রের দেবতা, যিনি তার হাতুড়ি Mjölnir দিয়ে শত্রুদের ধ্বংস করতেন
ফ্রেয়া – প্রেম ও সৌন্দর্যের দেবী
লোকি – প্রতারণা ও পরিবর্তনের দেবতা
ভাইকিংদের বিশ্বাস ছিল মৃত্যু পর জীবনের প্রতি। যারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করত, তারা ভ্যালহাল্লা-তে স্থান পেত, যা ছিল ওডিনের নিকট বীরদের জন্য নির্ধারিত পরকাল।
ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে মানুষ হত্যা
ঈশ্বরের সাথে ভালো সম্পর্ক নিশ্চিত করতে ভাইকিং রা প্রত্যেক ৯ বছরে ৯৯ জন মানুষ, ৯৯টি ঘোড়া, কুকুর, বাজপাখি উৎসর্গ করতো। যে মানুষদের তারা উৎসর্গ করতো তা অবশ্যই তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে করা হতো।
ভাইকিং দের চেহারা ও শারীরিক গঠন
ভাইকিংদের কাজ যেমন অপহরণ, লুটপাট ঠিক তেমনি এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ তাদের বাহ্যিক শারীরিক গঠনও। বিভিন্ন আখ্যানে তাদের কপাল বরাবর চুল, ঘন আই-ব্রো, ঝোপের ন্যায় শ্মশ্রু এবং প্রসারিত কাঁধের বর্ণনা রয়েছে যা দশ শতকের ক্রিমিনাল প্রোফাইলের সাথে পুরোপুরি মানানসই।
ভাইকিং দের রণোন্মাদনা
অতিপ্রাকৃত রাগ এবং ক্রোধের প্রতীক ভাইকিংরা। এই প্রচণ্ড ক্রোধই তাদেরকে যুদ্ধক্ষেত্রে ধাবিত করে। যার ফলে অনেক সময় তারা যুদ্ধপরবর্তী ট্রমা বা পীড়নের শিকার হতো এবং হতাশায় ভুগতো। এরপরও যুদ্ধের উন্মত্ততা তাদের উন্মাদনার মতো ছিলো যা তাদের জীবনকে রোমাঞ্চনীয় জীবনে পরিণত করেছিলো।
মৃতের নখ-কর্তন প্রথা
ভাইকিং দের অন্তুষ্ট্যিক্রিয়া রীতির একটি হলো সদ্য মৃতের হাত ও পায়ের নখ কেটে দেয়া। পৃথিবীর সমাপ্তি যেনো না হয় কিংবা হলেও যেনো বিলম্বে হয় সে লক্ষ্যেই তারা এরকম পদক্ষেপ নেয়।। মৃতের নখ দিয়ে তৈরি নাগফার নামে একটি জাহাজ দানবদের যুদ্ধে নিয়ে যেতো।
যতবেশি মানুষকে অকর্তিত নখসহ কবর দেয়া হয়, জাহাজটি ততই বড় হতে থাকে। যেহেতু বড় জাহাজ বেশি দানবের ভ্রমণের সমার্থক এবং কেউই বেশি দানব কিংবা পায়ের নখ দিয়ে বড় জাহাজ গড়ে উঠুক তা চায় না তাই মৃতের নখ কেটে দেয়া তাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি রীতি হয়ে ওঠে।
শিশুহত্যা
নামসম্বন্ধীয় বিশ্বাসকে ঘিরে ভাইকিং দের অধিকাংশ শিশুহত্যা হতো। একটি শিশুকে নির্দিষ্ট নাম দিয়ে খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত করার রীতি চালু হয়েছে ভাইকিং দের থেকেই। তাদের এই প্রথাটির নাম ‘অসা ভ্যাটনি’। বাবা-মা শিশুদের পর্যবেক্ষণ করার পর কেবল যখন সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা পালনযোগ্য তখনই এই অনুষ্ঠান করা হয়।
যাদের তারা পালন করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় না তাদের মারার জন্য অনাবৃত অবস্থায় বাইরে ফেলে রাখা হয়। বেশিরভাগক্ষেত্রে মেয়েরাই এমন দুর্ভাগ্যের শিকার হতো। যে কারণে ভাইকিংদের ছেলে এবং মেয়ের অনুপাত ৪:১ থেকে ৯:১ এর মত হতো সবসময়।
সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যপার হলো অসা ভ্যাটনির আগে শিশুহত্যাকে কখনো খুন বলে বিবেচনা করা হতো না। কেবলমাত্র নামকরণ এবং গ্রহণের পর হত্যা করলে তা ধর্তব্য বিষয় ছিলো।
ভাইকিং দের ঘর এবং পরিবেশ দূষণ
ভাইকিংদের ঘরগুলো অনেক বড় যার পেছনের দিকে উঠান থাকতো যেখানে মাংস পুড়িয়ে খাওয়া হতো। ঘরগুলোর চাল খড়ের তৈরি এবং দেয়ালগুলো আনাড়ি হাতের রং এ সজ্জিত। শীতের ১৫ সপ্তাহ পর্যন্ত প্রত্যেক ঘরের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হতো উষ্ণতার জন্য।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা এই ঘরগুলো নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড এবং কার্বন মনোক্সাইড সৃষ্টিতে সাহায্য করতো বলে মতামত দিয়েছে। যদিও তাদের ঘরের ছাদে ধোয়া বের হয়ে যাওয়ার জন্য একটি ফাঁকা স্থান থাকতো কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিলো না এবং ছাদের আকৃতিও এমন ছিলো যে ঘরেই বেশিরভাগ ধোয়া আটকে যেতো। এ কারণেই ভাইকিং মহিলা এবং শিশুরা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত বিভিন্ন রোগে ভুগতো।
জাহাজ ও নৌপ্রযুক্তি
ভাইকিং সভ্যতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক ছিল তাদের নৌপথে দক্ষতা। তারা “লংশিপ” নামে পরিচিত বিশেষ ধরনের সরু, লম্বা, হালকা এবং দ্রুতগতিসম্পন্ন জাহাজ তৈরি করত, যা সহজে নদীপথ বা সাগরপথে চলাচল করতে পারত। এই লংশিপগুলো তাদের অভিযান, লুণ্ঠন ও ব্যবসা সফল করার মূল চাবিকাঠি ছিল।
শিল্প ও সংস্কৃতি
ভাইকিং শিল্প ও কারুশিল্পে জ্যামিতিক নকশা, পশুর অবয়ব ও জটিল অলংকরণ দেখা যায়। তাদের তৈরি ধাতব অস্ত্র, গহনা, কাঠের নকশা ও পাথরের খোদাই ছিল অত্যন্ত চমকপ্রদ। “রুনিক লিপি” নামে পরিচিত এক ধরণের প্রাচীন লিপিতে তারা লেখালেখি করত। এছাড়াও ভাইকিং সাহিত্যে ‘সাগা’ নামে মহাকাব্যিক গাথা ও উপাখ্যান প্রচলিত ছিল, যা মূলত মৌখিকভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তরিত হত।
বাণিজ্য ও অর্থনীতি
ভাইকিংরা কেবল লুণ্ঠনকারীই ছিল না, তারা দক্ষ ব্যবসায়ীও ছিল। তারা মধ্যপ্রাচ্য, বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য ও ইউরোপের অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গে বাণিজ্য করত। তাদের বাণিজ্য পণ্যের মধ্যে ছিল পশম, দাস, ধাতব সামগ্রী, অস্ত্র এবং মশলা। কিছু ভাইকিং ব্যবসায়ী রাশিয়ার দিকে চলে গিয়ে কিয়েভান রাস নামক রাজ্য গঠন করে।
রাজনীতি ও আইনী ব্যবস্থা
ভাইকিং সমাজে থিং (Thing) নামে একটি গণপরিষদ ব্যবস্থা ছিল, যেখানে সাধারণ মানুষও অংশগ্রহণ করতে পারত। এই থিং সভায় আইন পাস, বিচার ও রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হত। ভাইকিং নেতারা সাধারণত জনগণের মধ্যে জনপ্রিয়তা ও যুদ্ধক্ষেত্রে কৃতিত্বের ভিত্তিতে উঠে আসত।
ধর্মান্তর ও খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ
ধীরে ধীরে ভাইকিংরা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে। একাদশ শতকের শুরুতে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়। এই ধর্মান্তর কেবল ধর্মীয় রূপান্তর নয়, বরং এটি সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তনেরও সূচনা করে। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে ভাইকিং সংস্কৃতি ধীরে ধীরে ইউরোপীয় সভ্যতার মূলধারায় মিশে যায়।
ভাইকিংদের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য:
সামুদ্রিক দক্ষতা: ভাইকিংরা তাদের জাহাজ নির্মাণ ও সমুদ্রযাত্রার দক্ষতার জন্য পরিচিত ছিল। তাদের জাহাজগুলো ছিল দ্রুতগামী এবং শক্তিশালী, যা তাদের সুদূর যাত্রা করতে সাহায্য করত।
সামরিক শক্তি: ভাইকিংরা ছিল দক্ষ যোদ্ধা এবং তাদের সামরিক শক্তি ছিল উল্লেখযোগ্য। তারা বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করত।
বাণিজ্য: ভাইকিংরা ব্যবসা-বাণিজ্যেও পারদর্শী ছিল। তারা বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে মূল্যবান সামগ্রী আদান-প্রদান করত।
বসতি স্থাপন: ভাইকিংরা কেবল অভিযান চালাত না, তারা বিভিন্ন স্থানে বসতিও স্থাপন করত। ইংল্যান্ড, আইসল্যান্ড, গ্রিনল্যান্ড এবং উত্তর আমেরিকার কিছু অংশে তাদের বসতি ছিল।
ধর্ম: ভাইকিংরা মূলত পৌত্তলিক ছিল, তবে একাদশ শতাব্দীতে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে শুরু করে।
ভাইকিংদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ভাইকিংরা ইতিহাসে তাদের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং অভিযানের জন্য বিখ্যাত। তারা ইউরোপের ভূরাজনীতি ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। তাদের অভিযাত্রার ফলে নতুন বাণিজ্যপথ, উপনিবেশ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় সম্ভব হয়েছে।
আজও আইসল্যান্ড, নরওয়ে ও ডেনমার্কে ভাইকিং উত্তরাধিকারের চিহ্ন দেখা যায়—রুনিক লিপি, স্থাপত্যের ধাঁচ, লোককাহিনি, ও সামরিক কৌশলে।
পতনের কারণ
ভাইকিং যুগের অবসান ঘটে একাধিক কারণে:
স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় ব্যক্তিগত অভিযান ও লুণ্ঠনের সুযোগ কমে যায়।
ইউরোপীয় দেশগুলো শক্তিশালী দুর্গ ও সংগঠিত সেনাবাহিনী গঠন করে ভাইকিং আক্রমণ ঠেকাতে সক্ষম হয়।
খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের ফলে আগের দেবতাকেন্দ্রিক জীবনধারায় পরিবর্তন আসে।
ভাইকিং সভ্যতা ছিল এক বহুমাত্রিক ও প্রভাবশালী যুগ, যেখানে বীরত্ব, বাণিজ্য, ধর্ম, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা মিলেমিশে এক অনন্য ইতিহাস রচনা করেছে। আধুনিক ইউরোপীয় ইতিহাসের ভিত্তি নির্মাণে ভাইকিংদের অবদান অনস্বীকার্য।
তথ্যসূত্র:
BBC History
National Museum of Denmark
The Viking World – Routledge (Edited by Stefan Brink & Neil Price)
Encyclopaedia Britannica