উপজাতীয় সমাজকল্যাণ
উপজাতীয়-প্রাক-রাষ্ট্র সমাজ বলতে সেই সকল সমাজব্যবস্থাকে বোঝানো হয়, যেখানে রাষ্ট্র, সরকার, কর ব্যবস্থা, বা লিপিবদ্ধ আইন ছিল না। এই সমাজগুলো রাষ্ট্রের উদ্ভবের পূর্ববর্তী পর্যায়ে অবস্থান করত এবং হাজার হাজার বছর ধরে মানবজাতির জীবনের মূল কাঠামো হিসেবে কাজ করেছিল। এটি ছিল মানব সভ্যতার প্রথম সামাজিক সংগঠন যেখানে আত্মীয়তা, প্রথা, ধর্মীয় বিশ্বাস, এবং পারস্পরিক নির্ভরতার ভিত্তিতে সমাজ গঠিত হয়েছিল।
উপজাতীয় সমাজ কাকে বলে
উপজাতীয় সমাজ বলতে এমন এক দল সম্প্রদায়কে বোঝায়, যারা একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক অঞ্চলে একত্রে বসবাস করে, একটি নিজস্ব সংস্কৃতি ও ভাষা ধারণ করে, এবং নিজেদের মধ্যে ঐক্যের এক শক্তিশালী অনুভূতি ও ঐতিহ্যগত প্রথা বহন করে। এই সমাজগুলি সাধারণত নিজস্ব রাজনৈতিক সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হয় এবং প্রায়শই বৃহত্তর রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে নিজস্ব পরিচয় বজায় রাখে। উপজাতীয় বা ট্রাইবাল সমাজ হল একধরনের সামাজিক সংগঠন যা সাধারণত আত্মীয়তার ভিত্তিতে গঠিত। এদের কোনো কেন্দ্রীয় সরকার ছিল না, বরং সমাজ পরিচালিত হতো প্রবীণদের সভা, গোত্রপতি, বা শামানদের মাধ্যমে। তাদের সামাজিক কাঠামো ছিল সমতাভিত্তিক (egalitarian), যেখানে ব্যক্তিগত মালিকানা ছিল খুব সীমিত, এবং সম্পদ শেয়ার করার প্রবণতা ছিল।
উপজাতির সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
একটি উপজাতি হলো এমন একদল মানুষ যারা পূর্বপুরুষ, সংস্কৃতি এবং কিছু নির্দিষ্ট রীতিনীতি ভাগ করে নেয়।তারা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বাস করে এবং নিজস্ব এক আলাদা সংস্কৃতি গড়ে তোলে, যা একটি বৃহত্তর জাতীয় রাষ্ট্র থেকে ভিন্ন। নৃবিজ্ঞানের ভাষায়, উপজাতি হলো একটি ছোট সামাজিক সংগঠন যেখানে সাধারণ বংশোদ্ভূত, ভাষা এবং সংস্কৃতি দ্বারা একটি গোষ্ঠী একত্রিত থাকে।
আত্মীয়তার ভিত্তিতে গঠিত ছোট জনগোষ্ঠী
লিখিত আইন বা সংবিধান অনুপস্থিত
রাজ্য কাঠামোর অনুপস্থিতি
প্রবীণদের অভিজ্ঞতা ও পরামর্শের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ
কৃষিকাজ, পশুপালন বা শিকার-সংগ্রহে জীবনধারণ
ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার-অনুষ্ঠান সমাজ পরিচালনার অংশ
মৌখিক ঐতিহ্যের উপর নির্ভরতা
স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য: প্রতিটি উপজাতির নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্য থাকে।
গোত্র বা দলের ভিত্তিতে সামাজিক সংগঠন: সমাজের ভিত্তি হল গোত্র বা দল, যেখানে সদস্যরা সাধারণত একই পূর্বপুরুষ বা আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ থাকে।
স্পষ্ট রাজনৈতিক কাঠামোর অভাব: এই সমাজে সাধারণত একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র বা সরকার ব্যবস্থা থাকে না, তবে গোত্র বা দলের নেতারা তাদের নিজ নিজ গোষ্ঠীর উপর প্রভাব বিস্তার করে।
সম্পদ বন্টন এবং সামাজিক নিয়মকানুন: সাধারণত ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুযায়ী সম্পদ বন্টন এবং সামাজিক নিয়মকানুন নির্ধারিত হয়।
ভূ-রাজনৈতিক সীমানা: এই সমাজগুলির সাধারণত নির্দিষ্ট কোন রাজনৈতিক সীমানা থাকে না, তবে তাদের বসবাসের এলাকা চিহ্নিত করা যেতে পারে।
প্রাক-রাষ্ট্র সমাজগুলোর অর্থনীতি ছিল প্রধানত অর্থ বিনিময়হীন। পণ্য ও সেবার বিনিময় হতো ‘বার্টার সিস্টেম’-এর মাধ্যমে বা পারস্পরিক আদান-প্রদানের ভিত্তিতে। এছাড়াও এই সমাজে সামাজিক অর্থনীতি চালু ছিল, যেখানে ‘উপহার প্রদান’ বা ‘দানে ফিরতি দান’ ছিল এক ধরনের সামাজিক সম্পর্ক রক্ষার পদ্ধতি। দলবদ্ধভাবে শিকার, মাছ ধরা, বা জমিতে চাষ করেই সমাজ জীবিকা নির্বাহ করত। জমি সাধারণত ব্যক্তিগত মালিকানাধীন নয়, বরং গোত্রের সম্পদ হিসেবে গণ্য হতো।
সামাজিক সংগঠন
উপজাতীয় সমাজে বংশানুক্রমিক সংগঠন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সমাজ সাধারণত দুটি প্রকার বংশের মাধ্যমে বিভক্ত ছিল:
মাতৃসত্ত্বাধিকার (Matrilineal) – সম্পত্তি বা বংশধারা মায়ের দিক থেকে হতো।
পিতৃসত্ত্বাধিকার (Patrilineal) – সম্পত্তি ও পরিচয় পিতার দিক থেকে হতো।
বিয়ে ছিল মূলত সামাজিক জোট গঠনের একটি মাধ্যম। অনেক উপজাতিতে একাধিক স্ত্রীর প্রথা (বহুপত্নীত্ব) বা সমষ্টিগত বিবাহের প্রথাও দেখা যেত।
ধর্ম ও বিশ্বাস
প্রাক-রাষ্ট্র সমাজে ধর্মীয় বিশ্বাস সমাজের প্রতিটি স্তরের সঙ্গে জড়িত ছিল। তারা প্রকৃতিপূজক ছিল এবং গাছ, নদী, পাহাড়, সূর্য বা চাঁদকে দেবতা হিসেবে পূজা করত। টোটেমিজম, অ্যানিমিজম ও আত্মা-বিশ্বাস তাদের ধর্মীয় জীবনের মূলভিত্তি। শামান বা ধর্মীয় পুরোহিতরা আত্মা বা দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করত এবং চিকিৎসা, ভবিষ্যদ্বাণী ইত্যাদি করত।
রাজনীতি ও নেতৃত্ব
প্রাক-রাষ্ট্র সমাজে “রাজনীতি” ছিল অনানুষ্ঠানিক। কোনো লিখিত সংবিধান বা প্রশাসনিক কাঠামো না থাকলেও, একটি অদৃশ্য সামাজিক শৃঙ্খলা ছিল। প্রবীণ বা অভিজ্ঞ ব্যক্তি, যাকে ‘প্রধান’ (chief) বলা হতো, সাধারণত সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। তবে এই নেতারা কর্তৃত্ববাদী নয়; বরং সমাজের সম্মতিতেই সিদ্ধান্ত নিতেন। ক্ষমতা ছিল মূলত নৈতিক প্রভাব ও অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে। কেউ আদেশ দিলে সেটি মানার বাধ্যবাধকতা ছিল না।
বিচার ও শাস্তি
উপজাতীয় সমাজে বিচারপ্রক্রিয়া ছিল সরল এবং সামাজিক সম্মানভিত্তিক। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা গোত্রের প্রবীণদের সামনে তোলা হতো, এবং তারা পক্ষপাতহীনভাবে সমাধান করতেন। শাস্তির ধরণ ছিল সামাজিকভাবে অপমান, বর্জন, কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায়। কখনো গুরুতর অপরাধে বহিষ্কার বা সমাজচ্যুতি ঘটত, যা ছিল সবচেয়ে কঠোর শাস্তি।
প্রাক-রাষ্ট্র সমাজের উদাহরণ
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নানা উপজাতীয় সমাজ গড়ে উঠেছিল, যেমন:
আফ্রিকার মাসাই, জুলু, হিম্বা
উত্তর আমেরিকার নাভাহো, ইরোকোই
দক্ষিণ আমেরিকার ইয়ানোমামো
অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী সমাজ (অ্যাবরিজিনাল)
বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, গারো, সাঁওতাল প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্ঠী
এদের প্রতিটিই ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও সংস্কৃতিতে গড়ে উঠলেও, প্রাক-রাষ্ট্র সমাজ কাঠামোর অনেক সাধারণ বৈশিষ্ট্য তারা ভাগ করে।
রাষ্ট্রের দিকে উত্তরণ
সময় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে উপজাতীয় সমাজে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। কৃষির উন্নয়ন, সম্পদের সঞ্চয়, ভূমির মালিকানা, এবং পেশাগত বিভাজনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সামাজিক স্তর বিভাজন শুরু হয়। এর ফলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হতে থাকে এবং ধনী-দরিদ্র বিভাজন গড়ে ওঠে। এক সময় এই পরিবর্তনগুলো রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যায়—যেখানে কেন্দ্রীয় প্রশাসন, কর ব্যবস্থা, এবং স্থায়ী সেনাবাহিনী গড়ে ওঠে।
উপজাতীয় সমাজের গুরুত্ব
উপজাতীয় সমাজ আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার সূচনার পূর্ববর্তী এক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি মানব ইতিহাসের একটি দীর্ঘ অধ্যায়, যেখানে মানুষ সহানুভূতি, সহযোগিতা, আচার-অনুষ্ঠান ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে টিকে ছিল। এগুলো থেকে আমরা জানতে পারি কিভাবে সমাজ বিকাশ লাভ করেছে এবং মানুষ কীভাবে প্রথমবারের মতো সমবেতভাবে বসবাস করতে শিখেছিল।
উপজাতীয়-প্রাক-রাষ্ট্র সমাজ ছিল মানব ইতিহাসের প্রাচীনতম ও দীর্ঘতম সময়কালব্যাপী গঠিত সমাজব্যবস্থা। এই সমাজগুলো আজও অনেক জায়গায় টিকে আছে, যদিও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ও বিশ্বায়নের চাপে তারা সংকটে রয়েছে। তবুও এদের জীবনযাপন, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আমরা এক মহামূল্যবান ঐতিহ্য ও শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি।
তথ্যসূত্র:
Service, Elman R.
Primitive Social Organization: An Evolutionary Perspective.
(Random House, 1962)
Morgan, Lewis Henry. Ancient Society. (1877)
Ember, Carol R., & Ember, Melvin.
Anthropology (14th Edition)
(Pearson Education, 2011)
Diamond, Jared.
Guns, Germs, and Steel: The Fates of Human Societies.
Malinowski, Bronislaw.
Argonauts of the Western Pacific (1922)