Friday, October 3, 2025
Homeসভ্যতাইনকা সভ্যতার বিস্ময়কর কিশোরীর মমি

ইনকা সভ্যতার বিস্ময়কর কিশোরীর মমি

ইনকা সভ্যতার বিস্ময়কর কিশোরীর মমি

দক্ষিণ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালায় একসময় সমৃদ্ধ ছিল ইনকা সভ্যতা, যার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্থাপত্য, কৃষি ও ধর্মীয় রীতিনীতির খ্যাতি আজও বিশ্ববাসীকে মুগ্ধ করে। কিন্তু এই সভ্যতার এক রহস্যময় দিক হলো তাদের মানববলিদান প্রথা, বিশেষ করে শিশু বা কিশোর-কিশোরী উৎসর্গ। এর একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হলো লা দনসেল (La Doncella) নামের এক কিশোরীর মমি, যাকে বিশ্বের সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত মমিগুলোর মধ্যে অন্যতম বলা হয়। ১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার আন্দিজ পর্বতমালার মাউন্ট লুল্লাইয়াকো (Mount Llullaillaco) এর চূড়ায় আবিষ্কৃত এই মমি ইনকা সংস্কৃতির ধর্মীয় বিশ্বাস এবং সামাজিক আচার সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে।

মমির আবিষ্কার

১৯৯৯ সালে আর্জেন্টিনার নৃবিজ্ঞানী জোহান রেইনহার্ড এবং তার দল আন্দিজ পর্বতের প্রায় ২২,০০০ ফুট (৬,৭৩৯ মিটার) উচ্চতায় প্রত্নতাত্ত্বিক খননের সময় তিনটি মমি আবিষ্কার করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো লা দনসেল (The Maiden) – প্রায় ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরী। তার সঙ্গে আরও দুটি মমি পাওয়া যায়: একটি শিশু (The Boy) এবং একটি ছোট মেয়ে (The Lightning Girl)।

এই মমিগুলো প্রাকৃতিকভাবে সংরক্ষিত হয়েছিল কারণ আন্দিজের তীব্র ঠান্ডা, নিম্ন তাপমাত্রা এবং শুষ্ক পরিবেশ তাদের দেহকে প্রায় সম্পূর্ণ অক্ষত অবস্থায় রেখেছিল। এমনকি মমির চুল, ত্বক, পোশাক এবং এমনকি পাকস্থলীর অভ্যন্তরে থাকা খাদ্যও বিশ্লেষণ করা সম্ভব হয়েছে।

লা দনসেলের চেহারা ও অবস্থা

লা দনসেল বসা অবস্থায় আবিষ্কৃত হয়। তার মাথা সামান্য নিচু, চুল বেণী করা, এবং তার মুখে এক ধরনের শান্ত অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায়। তার গায়ে ছিল আনকু (Andean পোশাক), এবং সাথে ছিল সজ্জিত জিনিসপত্র, যেমন চুলের অলংকার, ছোট পাত্র ও ধর্মীয় প্রতীক।

মমির শারীরবৃত্তীয় বিশ্লেষণ থেকে জানা যায়:

বয়স: আনুমানিক ১৫ বছর।

স্বাস্থ্য: মৃত্যুর আগে সুস্থ ছিল।

পাকস্থলীতে পাওয়া খাদ্য: ভুট্টা ও কোকা পাতা।

দাঁত ও হাড়ের গঠন: পুষ্টি সম্পন্ন।

এটি স্পষ্ট যে কিশোরীকে হত্যা করা হয়নি, বরং সম্ভবত ঠান্ডায় মৃত্যুর আগে চিচা (Chicha) নামক মদ্যপ পানীয় পান করানো হয়েছিল, যাতে সে অচেতন অবস্থায় মারা যায়।

ক্যাপাকোচা আচার

এই মমি ইনকার ক্যাপাকোচা (Capacocha) নামক ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের প্রমাণ বহন করে। এটি ছিল এক ধরনের পবিত্র উৎসর্গ যেখানে শিশু বা কিশোর-কিশোরীদের দেবতাদের শান্ত করার জন্য উৎসর্গ করা হতো। সাধারণত:

এই আচার বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সম্রাটের মৃত্যু অথবা গুরুত্বপূর্ণ সাম্রাজ্যিক অনুষ্ঠানে করা হতো।

বাছাই করা হতো শারীরিকভাবে সুস্থ, সুন্দর এবং সমাজে সম্মানিত শিশুদের।

উৎসর্গের আগে তাদের সমৃদ্ধ পোশাক পরানো হতো এবং দেবতার নৈবেদ্যস্বরূপ খাদ্য, অলংকার ও ধর্মীয় বস্তু দেওয়া হতো।

তাদেরকে উচ্চ পর্বতশৃঙ্গে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হতো, যেখানে ঠান্ডা ও অক্সিজেনের অভাবে তারা মারা যেত।

এই প্রথার মূল উদ্দেশ্য ছিল ইনকা দেবতাদের সন্তুষ্ট করা, বিশেষ করে পাহাড়ের দেবতা (Apu) এবং সূর্যদেব (Inti)।

বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ

ডিএনএ পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান ও টক্সিকোলজি রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে লা দনসেল মৃত্যুর আগে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্তুতির মধ্য দিয়ে গিয়েছিল:

মৃত্যুর এক বছর আগে থেকেই তাকে বিশেষ খাবার খাওয়ানো হতো।

মৃত্যুর কয়েক সপ্তাহ আগে চিচা ও কোকা পাতার ব্যবহার বাড়ানো হয়েছিল, যা অচেতনতা আনতে সাহায্য করেছিল।

শরীরে কোনো সহিংসতার চিহ্ন পাওয়া যায়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই মমির সংরক্ষণ মান এত ভালো যে আজও তার শরীরে জীবাণু পাওয়া সম্ভব, যা ভবিষ্যতে চিকিৎসা গবেষণার ক্ষেত্রে কাজে লাগতে পারে।

সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব

এই মমি শুধু ইনকা ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রমাণ নয়, বরং মানববলিদানের একটি জটিল সাংস্কৃতিক রূপকল্পও তুলে ধরে। এটি আমাদের জানায়:

ইনকা সমাজে ধর্ম ও রাজনীতি কতটা গভীরভাবে জড়িত ছিল।

শিশু উৎসর্গকে দেবতাদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের পবিত্র কাজ হিসেবে দেখা হতো।

এটি ছিল কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থার ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায়।

আজকের দৃষ্টিতে এটি নির্মম মনে হলেও, ইনকা সমাজে এটি ছিল পবিত্র ও সম্মানজনক প্রথা।

সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী

লা দনসেল বর্তমানে আর্জেন্টিনার মুসেও দে আরকেওলজিয়া দে আল্টা মনতানিয়া (MAAM), সাল্টা শহরে সংরক্ষিত আছে। সেখানে বিশেষ কাচের ক্যাপসুলে রাখা হয়েছে, যেখানে তাপমাত্রা, আর্দ্রতা ও অক্সিজেনের মাত্রা নিয়ন্ত্রিত থাকে যাতে মমি ক্ষতিগ্রস্ত না হয়।

আধুনিক বিতর্ক

এই আবিষ্কার অনেক বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। স্থানীয় আদিবাসী গোষ্ঠীগুলো দাবি করেছে যে এ ধরনের মমি আবার পাহাড়ে সমাধিস্থ করা উচিত, কারণ এগুলো তাদের পূর্বপুরুষের আত্মার সঙ্গে যুক্ত। অন্যদিকে, বিজ্ঞানীরা বলেন যে গবেষণার জন্য এই মমিগুলো সংরক্ষণ করা প্রয়োজন, কারণ এগুলো মানব ইতিহাসের এক অনন্য দলিল।

ইনকা সভ্যতার এই বিস্ময়কর কিশোরী মমি শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারের একটি নিদর্শন নয়; এটি মানব সভ্যতার ইতিহাস, ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক কাঠামো এবং প্রাচীন রীতিনীতির গভীর তাৎপর্য বহন করে। লা দনসেল এবং তার সঙ্গে পাওয়া মমিগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরে এক সময়ের এমন একটি বাস্তবতা, যেখানে ধর্ম এবং প্রকৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এতটাই গভীর ছিল যে মানুষ নিজের সন্তানকেও দেবতাদের শান্ত করার জন্য উৎসর্গ করতে প্রস্তুত ছিল।

এই মমি আমাদের শেখায় যে মানব সভ্যতা কেবল প্রযুক্তি ও স্থাপত্যে নয়, বরং বিশ্বাস ও সংস্কৃতির জটিলতায়ও সমৃদ্ধ। ইনকারা বিশ্বাস করত যে দেবতাদের সন্তুষ্ট করা তাদের সমাজের মঙ্গল, কৃষির সমৃদ্ধি এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়ার একমাত্র উপায়। বর্তমানের দৃষ্টিতে এটি নিষ্ঠুর মনে হলেও, সে সময়ের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এটি ছিল পবিত্র দায়িত্ব।

তাছাড়া, এই আবিষ্কার বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্যও এক অমূল্য সম্পদ। উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা শুধু মমির শারীরিক গঠন নয়, বরং তার খাদ্যাভ্যাস, স্বাস্থ্য, এমনকি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তের তথ্যও জানতে পারি। এই তথ্য আমাদের ইনকা সভ্যতার জীবনধারা, আচার-অনুষ্ঠান এবং তাদের চিকিৎসা জ্ঞানের স্তর সম্পর্কে ধারণা দেয়।

তবে এই মমিগুলোর সংরক্ষণ ও প্রদর্শনী নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তা সংস্কৃতি ও আধুনিক বিজ্ঞানের মধ্যে দ্বন্দ্বের প্রতিফলন। একদিকে বিজ্ঞানীরা বলছেন, এটি গবেষণার জন্য অপরিহার্য, অন্যদিকে আদিবাসী সম্প্রদায় দাবি করছে যে পূর্বপুরুষদের আত্মাকে সম্মান জানাতে তাদের পুনরায় সমাধিস্থ করা উচিত।

অতএব, লা দনসেল শুধু এক কিশোরীর মমি নয়; এটি অতীত ও বর্তমানের মধ্যে এক সেতুবন্ধন। এটি আমাদের শেখায় যে বিশ্বাস, সংস্কৃতি এবং ইতিহাস কিভাবে একে অপরের সঙ্গে জড়িত এবং কিভাবে তারা মানব সভ্যতার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ভবিষ্যতের জন্য এটি এক অমূল্য শিক্ষণীয় উপাদান, যা আমাদের মনে করিয়ে দেয়—মানব ইতিহাস কখনো সরলরেখায় চলে না; বরং এটি অসংখ্য গল্প, বিশ্বাস এবং ঘটনার জটিল বুনন।

তথ্যসূত্র

Reinhard, Johan. The Ice Maiden: Inca Mummies, Mountain Gods, and Sacred Sites in the Andes.

Wilson, Andrew. “Inca Child Sacrifice: The Maiden of Llullaillaco.” National Geographic, 2007.

Museo de Arqueología de Alta Montaña (MAAM), Salta, Argentina – Official Research Reports.

“Llullaillaco Mummies.” Smithsonian Institution Archives.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments