তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই, বৈজ্ঞানিক নাম Urocissa caerulea, একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও রঙিন পাখি যা শুধুমাত্র তাইওয়ান দ্বীপে পাওয়া যায়। এটি তাইওয়ানের স্থানীয় (endemic) প্রজাতির পাখি এবং অনেকের মতে তাইওয়ানের “অফিশিয়াল জাতীয় পাখি”, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা ঘোষণা করা হয়নি। পাখিটির চেহারা, স্বভাব এবং পরিবেশের সাথে এর সংহত আচরণ এই পাখিটিকে তাইওয়ানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রতীক করে তুলেছে।
চেহারা ও শারীরিক বৈশিষ্ট্য
এটি দৈর্ঘ্যে ৬৩–৬৮সেমি (২৫–২৭ ইঞ্চি)। লেজের দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৪–৪২সেমি (১৩–১৭ইঞ্চি) এবং ডানা ২০ সেমি (৭.৯ ইঞ্চি) লম্বা। এর ওজন ২৫৪–২৬০গ্রাম (৯.০–৯.২আউন্স)।
পুরুষ ও স্ত্রী পাখির পালক একই রকম। মাথা, ঘাড় এবং স্তন কালো। চোখ হলুদ, এবং ঠোঁট এবং পা লাল। বাকি পালকের বেশিরভাগই নীল। ডানা এবং লেজের পালকের ডগা সাদা। ডানার নীচের অংশ গাঢ় ধূসর এবং উড়ন্ত পালক হালকা ধূসর। উপরের লেজের ডগা কালো। লেজের পালকের কেন্দ্রীয় জোড়া সবচেয়ে লম্বা। আবার অন্যান্য লেজের পালকের কালো ব্যান্ড থাকে। ছানাগুলি সাধারণত ধূসর বর্ণের হয়ে থাকে এবং ছোট লেজ থাকে এবং এদের চোখের রং ধূসর-নীল বর্ণের হয়ে থাকে।
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই প্রথম দর্শনেই নজর কাড়ে। এর শরীরের প্রধান রঙ গাঢ় নীল, যা চোখে পড়ার মতো উজ্জ্বল। মাথা,ঘাড় ও বুকে কালো পালক থাকে, যেন একটি কালো হুড পরা। চোখের চারপাশ সাদা রঙের,যা কালো মাথার পটভূমিতে আরও স্পষ্টভাবে উদ্ভাসিত হয়। পা ও ঠোঁট উজ্জ্বল লাল, যা এর নীল ও কালো পালকের সাথে বিপরীত সাদৃশ্য সৃষ্টি করে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অংশ হলো এর লম্বা লেজ, যেখানে সাদা ও কালো রঙের রেখা থাকে এবং এটি অনেকটা পতাকার মতো নড়ে ওঠে। একটি পূর্ণবয়স্ক পাখির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৫ সেন্টিমিটার, যার বেশিরভাগই লেজ।
আবাস ও পরিবেশ
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই সাধারণত মধ্য ও নিম্ন পর্বতাঞ্চলে পাওয়া যায়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৩০০ থেকে ১২০০ মিটার উচ্চতায়। এরা প্রধানত গহীন বন ও পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করে। সম্প্রতি এই পাখি কিছুটা শহরতলি এলাকাতেও অভিযোজিত হয়েছে, বিশেষ করে যদি সেখানে গাছপালা ও খাদ্য সহজলভ্য হয়।
আচরণ ও স্বভাব
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই দলবদ্ধ পাখি। এরা সাধারণত ৬ থেকে ১২টি পাখির দলে চলাফেরা করে এবং একে অপরের সাথে সংহতভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে। তারা বনে একটি ‘প্যাট্রোল ইউনিট’-এর মতো আচরণ করে এবং চিৎকার করে আগমন জানান দেয়। এর কারণে একে “ফরেস্ট গার্ড” বা বনরক্ষী পাখিও বলা হয়।
পাখিটি অত্যন্ত বুদ্ধিমান, কৌতূহলী এবং কখনও কখনও মানুষকে অনুসরণ করতেও দেখা যায়। স্থানীয় মানুষেরা বলে, এই পাখি কিছুটা দুষ্ট প্রকৃতিরও, কারণ এটি মাঝে মাঝে বাসা থেকে ছোট বস্তু চুরি করে নিয়ে যায়! প্রায়শই একে অপরের পিছনে পিছনে সারিতে উড়ে বেড়ায়। একে কখনও কখনও “লম্বা লেজযুক্ত গঠন” বলা হয়। পাখিরা কাক পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মতো, তাদের একটি কর্কশ ডাক আছে যা উচ্চস্বরে বকবক করা, কিয়াক-ক্যাক-ক্যাক-ক্যাক হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে । অন্যান্য ডাকের মধ্যে রয়েছে গা-কাং, গা-কাং , কুই-ইপ এবং গার-সুই ।
খাদ্যাভ্যাস
তাইওয়ানের নীল ম্যাগপাইরা মেথর এবং সর্বভুক । তাদের খাদ্যের মধ্যে রয়েছে সাপ, ইঁদুর , ছোট পোকামাকড়, মৃতদেহ , অন্যান্য পাখির ডিম এবং ছানা, গাছপালা, ফল এবং বীজ। তারা মানুষের খাদ্য বর্জ্যও খায়। তারা কখনও কখনও মাটিতে অবশিষ্টাংশ জমা করে এবং ভবিষ্যতে পুনরুদ্ধারের জন্য পাতা দিয়ে ঢেকে দেয়। কখনও কখনও তারা পাতা বা ডালে খাবার সঞ্চয় করে।
প্রজনন ও বাসা বাঁধা
প্রজনন ঋতু মার্চ থেকে জুলাই। তাইওয়ান নীল ম্যাগপাই একগামী । স্ত্রীরা ডিম ফোটায় যখন পুরুষরা বাসা তৈরি এবং খাওয়ানোর কাজে সাহায্য করে। তাদের বাসা গাছের উঁচু ডালে তৈরি হয়। বাসাটি একটি বাটির আকারের এবং ডাল দিয়ে তৈরি। সাধারণত একটি ক্লাচে ৩-৮টি ডিম থাকে। ডিম হালকা সবুজ রঙের, বাদামী দাগযুক্ত। ডিম ফুটতে ১৭-১৯ দিন সময় লাগে। প্রতিটি বাসা থেকে ৩-৭টি বাচ্চা বের হয়। ২১-২৪ দিন পরে বাচ্চারা বাসা ছেড়ে চলে যায় এবং কয়েক দিন পরে অল্প দূরত্বের জন্য উড়তে শুরু করতে পারে। এর পরে কিছু জোড়া দ্বিতীয়বার প্রজনন করে।
তাইওয়ান নীল ম্যাগপাইয়ের বাসায় সাহায্যকারী থাকে ,বেশিরভাগই পূর্ববর্তী প্রজনন ঋতুর কিশোর। তারা ছানাদের খাওয়াতে এবং বাসা রক্ষা করতে সাহায্য করে। তাইওয়ান নীল ম্যাগপাইদের বাসা প্রতিরক্ষার একটি শক্তিশালী আচরণ রয়েছে এবং তারা অনুপ্রবেশকারীদের আক্রমণ করবে যতক্ষণ না তারা চলে যায়।
ডাক ও যোগাযোগ
এই পাখির কণ্ঠস্বর বেশ কর্কশ এবং বিভিন্ন ধরনের শব্দে পরিপূর্ণ। তারা “কাক-আক-আক”, “চিয়াচিয়াচিয়া” ইত্যাদি ধরনের উচ্চস্বরে ডাক দেয়, যা বনের নিস্তব্ধতা ভেঙে দেয়। এই ডাক একে অন্যের সাথে যোগাযোগ, বিপদ সংকেত ও খাদ্য খোঁজার সময় ব্যবহার করা হয়।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই তাইওয়ানের জাতীয় পরিচয়ের এক প্রতীক হয়ে উঠেছে। এটি ডাকটিকিট, চিত্রশিল্প, স্কুল প্রতীক ও সরকারি প্রচারপত্রে নিয়মিত ব্যবহৃত হয়। ২০০৭ সালে তাইওয়ানের জনগণের ভোটে এই পাখিটিকে “জাতীয় পাখি” হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
তাইওয়ানের জনগণের মধ্যে এই পাখির প্রতি একটি গর্ববোধ ও আবেগ রয়েছে। অনেক পরিবেশবাদী সংস্থা এই পাখির সংরক্ষণে কাজ করছে,কারণ এটি তাইওয়ানের জীববৈচিত্র্যের অন্যতম মণিমুক্তা।
সংরক্ষণ অবস্থা
বর্তমানে তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই IUCN Red List অনুযায়ী “কম উদ্বেগজনক (Least Concern)” তালিকাভুক্ত হলেও, এর স্বাভাবিক আবাসস্থল কমে আসা ও বনভূমি ধ্বংস হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে এটি হুমকির মুখে পড়তে পারে। তাই তাইওয়ানে বেশ কিছু সংরক্ষণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
অন্যান্য তথ্য:
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই, এশিয়ান ম্যাগপাই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত।
স্থানীয় নাম: 長尾山娘 (Changwei Shanniang), যার মানে ‘দীর্ঘ লেজওয়ালা পাহাড়ি সুন্দরী’।
এটি কখনও কখনও “ফর্মোসান ব্লু ম্যাগপাই” নামেও পরিচিত, কারণ তাইওয়ানের প্রাচীন নাম ছিল ফর্মোসা।
তাইওয়ান ব্লু ম্যাগপাই কেবল একটি পাখি নয়, এটি তাইওয়ানের সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও গর্বের প্রতীক। এর রঙিন রূপ, সমাজবদ্ধ আচরণ এবং চঞ্চল স্বভাব একে করে তুলেছে এক অসাধারণ জীববৈচিত্র্য সম্পদ। এই পাখির অস্তিত্ব ধরে রাখতে আমাদের উচিত প্রকৃতি সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এদের আবাসস্থল রক্ষা করা।
তথ্যসূত্র:
BirdLife International
IUCN Red List of Threatened Species
Taiwan Endemic Species Research Institute (TESRI)
Handbook of the Birds of the World (HBW), BirdLife International
National Geographic – Birds of Taiwan