সেন্ট পিটারের ব্যাসিলিকা
বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ও শ্রেষ্ঠ খ্রিস্টান গির্জা হলো সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা (St. Peter’s Basilica)। এটি ভ্যাটিকান সিটিতে অবস্থিত, যা রোম শহরের মধ্যেই একটি স্বাধীন পোপীয় রাষ্ট্র। এই গির্জাটি শুধু খ্রিস্টধর্মের নয়,মানব সভ্যতার স্থাপত্য,ধর্মীয় শিল্প ও ইতিহাসের একটি অনন্য নিদর্শন। এটি পোপের প্রধান উপাসনাস্থল এবং বহু তীর্থযাত্রীর পবিত্র গন্তব্য।
ইতিহাস
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকার ইতিহাস প্রাচীন রোমান সময় পর্যন্ত বিস্তৃত। বিশ্বাস করা হয়,খ্রিস্টপূর্ব ১ম শতকে খ্রিস্টান ধর্মের অন্যতম প্রচারক সেন্ট পিটার রোমে শহীদ হন এবং তাঁকে ভ্যাটিকান পাহাড়ের নিচে সমাহিত করা হয়। পরবর্তীতে রোমান সম্রাট কনস্টান্টাইন দ্য গ্রেট,যিনি খ্রিস্টান ধর্মকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন, খ্রিস্টীয় ৩২৬ সালে প্রথম একটি গির্জা নির্মাণ করেন সেন্ট পিটার-এর সমাধির উপরে। এই প্রথম গির্জাটিকেই “ওল্ড সেন্ট পিটারস ব্যাসিলিকা” বলা হতো।
১৫০৬ সালে পোপ জুলিয়াস দ্বিতীয় একটি নতুন,বৃহত্তর ব্যাসিলিকা নির্মাণের নির্দেশ দেন,কারণ পুরনো গির্জাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। এই নতুন ব্যাসিলিকা নির্মাণে সময় লাগে প্রায় ১২০ বছর এবং এটি শেষ হয় ১৬২৬ সালে পোপ আরবান অষ্টম-এর আমলে।
ভোগের মাধ্যমে অর্থায়ন
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা নির্মাণের জন্য অর্থায়নের একটি পদ্ধতি ছিল অবদানের বিনিময়ে ভোগ-ক্ষতি প্রদান। তহবিল সংগ্রহের এই পদ্ধতির একজন প্রধান প্রবর্তক ছিলেন মেইনজ এবং ম্যাগডেবার্গের আর্চবিশপ আলব্রেখ্ট ,যাকে পুনর্নির্মাণ কর্মসূচিতে অবদান রেখে রোমান কুরিয়ার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল ।
এটি সহজতর করার জন্য,তিনি জার্মান ডোমিনিকান ধর্মপ্রচারক জোহান টেটজেলকে নিযুক্ত করেছিলেন,যার বিক্রয়কর্মীরা একটি কেলেঙ্কারির সূত্রপাত করেছিল এবং প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কারের দিকে পরিচালিত করেছিল ।
স্থাপত্য শৈলী
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা রেনেসাঁ ও বারোক স্থাপত্যশৈলীর এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। গির্জাটির নকশা ও নির্মাণে বহু বিখ্যাত শিল্পী ও স্থপতির অবদান রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন:
ব্রামান্তে (Donato Bramante): প্রথম নকশা প্রণেতা।
রাফায়েল (Raphael): দ্বিতীয় পর্যায়ের স্থপতি।
মাইকেলএঞ্জেলো (Michelangelo): গম্বুজের নকশা করেন।
কার্লো মাদার্না (Carlo Maderno): পশ্চিম দিকের সম্মুখভাগ (façade) ও প্রবেশদ্বার নির্মাণ করেন।
জিয়ান লরেঞ্জো বার্নিনি (Gian Lorenzo Bernini): অভ্যন্তরের অলংকরণ ও বাইরের চত্বরের ডিজাইনে অনন্য অবদান রাখেন।
গির্জাটির গম্বুজ (Dome) রোম শহরের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন ও উচ্চতম স্থাপনা। এটি প্রায় ১৩৬ মিটার উঁচু এবং ৪২ মিটার ব্যাসবিশিষ্ট। ভেতর থেকে গম্বুজের চূড়ায় উঠা যায় প্রায় ৫০০ ধাপ পেরিয়ে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য ও অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্য
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা শুধু বিশালতাই নয়,ভেতরের নিপুণ শিল্প ও ভাস্কর্য দিয়ে অনন্য।
মাইকেলএঞ্জেলোর ‘Pietà’: মেরি ও মৃত যীশুকে নিয়ে এই মার্বেল ভাস্কর্যটি গির্জার এক কোণায় রাখা আছে। এটি তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ।
মেইন অল্টার (Baldachin): বার্নিনির তৈরি বিশাল ব্রোঞ্জের স্তম্ভ ও ছাউনিযুক্ত প্রধান বেদী,যার নিচেই সেন্ট পিটার-এর সমাধি।
Confessio ও ক্রিপ্ট: যেখানে সেন্ট পিটার-এর কবর বলে বিশ্বাস করা হয়। হাজার হাজার পুণ্যার্থী এখানে প্রার্থনায় মগ্ন থাকেন।
St. Peter’s Statue: একটি বিখ্যাত ব্রোঞ্জের মূর্তি যেখানে তীর্থযাত্রীরা সেন্ট পিটারের ডান পা স্পর্শ বা চুম্বন করে থাকেন আশীর্বাদের আশায়।
সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার
ব্যাসিলিকার সম্মুখে বিস্তৃত সেন্ট পিটার্স স্কোয়ার (Piazza San Pietro), যা বার্নিনির নকশায় তৈরি। এই স্কোয়ারটি দুটি অর্ধবৃত্তাকার স্তম্ভবেষ্টিত, যা পুণ্যার্থীদের একত্রিত হওয়ার স্থান। স্কোয়ারের মাঝখানে একটি প্রাচীন মিশরীয় ওবেলিস্ক রয়েছে,যা খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
ধর্মীয় গুরুত্ব
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের জন্য সবচেয়ে পবিত্র চারটি গির্জার (Major Basilicas)মধ্যে অন্যতম। যদিও এটি রোমান ক্যাথলিক চার্চের আনুষ্ঠানিক “ক্যাথেড্রাল”নয় (সেটি Lateran Basilica),তবুও পোপ সাধারণত এখানেই বড় বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান সম্পাদন করেন, যেমন:
পাস্কাল (ইস্টার) ও ক্রিসমাস মেস
পোপ নির্বাচনের পর প্রথম মেস
বিভিন্ন ধর্মীয় উত্সব ও আশীর্বাদ অনুষ্ঠান
পর্যটন ও সাংস্কৃতিক প্রভাব
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা শুধু ধর্মীয় স্থান নয়,এটি একটি সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক ও ধর্মপ্রাণ মানুষ বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এখানে আসেন।
গির্জাটি প্রবেশের জন্য টিকিট লাগে না,তবে গম্বুজে উঠার জন্য টিকিট কিনতে হয়। অভ্যন্তরের সুশৃঙ্খল ও পবিত্র পরিবেশ দর্শনার্থীদের এক আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা দেয়।
সেন্ট পিটার্স ব্যাসিলিকা শুধু একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়,এটি মানব ইতিহাসের এক স্থায়ী স্মারক,যেখানে ধর্ম,শিল্প ও স্থাপত্যের এক মহান সংমিশ্রণ ঘটেছে। এটি যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছে এবং আধুনিক স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের জন্য এক প্রেরণার উৎস হিসেবেও বিবেচিত হয়। সেন্ট পিটার্স-এর গম্বুজ থেকে রোম শহরের দৃশ্য যেমন মনোমুগ্ধকর,তেমনি এর প্রতিটি কোণ মানুষের আত্মিক প্রশান্তির প্রতীক।
তথ্যসূত্র
Vatican.va
UNESCO World Heritage Centre
Britannica.com
Art History Textbooks on Renaissance and Baroque architecture