সতীদাহ প্রথার ইতিহাস
তথাকথিত ‘ঐতিহ্যের’ পেছনের ভয়াবহ সত্য
ভারতের ইতিহাসে সতীদাহ একটি এমন কালো অধ্যায়, যেখানে নারীদের ‘সম্মান’ রক্ষার নামে জীবন্ত পোড়ানো হতো। এটি শুধুমাত্র একটি প্রথা ছিল না, বরং ছিল নারী নির্যাতনের চরম রূপ—একটি ব্যবস্থাগত নিপীড়ন, যা সমাজ, ধর্ম ও ‘ঐতিহ্য’-এর নামে বৈধতা পেয়েছিল।
সতীদাহ কী?
সতীদাহ (বা ‘সতী প্রথা’) বলতে বোঝানো হয় সেই প্রথাকে, যেখানে একজন স্ত্রী তার স্বামীর মৃত্যুর পর স্বেচ্ছায় কিংবা জোরপূর্বক তার সঙ্গে চিতায় উঠে আত্মাহুতি দিত। এই প্রথা মূলত হিন্দু সমাজে প্রচলিত ছিল এবং ‘স্ত্রী যদি সত্যিকার অর্থে সতী হয়, তবে সে স্বামীর সঙ্গে চিতায় উঠবে’—এই বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল।
ঐতিহ্য না বর্বরতা?
অনেকেই একে ‘ঐতিহ্য’ বা ‘ধ্যান ও আত্মত্যাগের নিদর্শন’ হিসেবে তুলে ধরতে চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তব চিত্র ছিল ভয়াবহ। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই নারীরা স্বেচ্ছায় নয়, বরং পারিবারিক, সামাজিক ও ধর্মীয় চাপে আত্মাহুতি দিতে বাধ্য হতেন।
অনেক সময় চিতায় জীবন্ত নারীকে বেঁধে ফেলা হতো যেন পালাতে না পারে। শ্মশানে ঢোল-বাদ্য বাজিয়ে তার কান্না ঢেকে ফেলা হতো, আর চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকত সমাজ—নীরব অথবা উল্লসিত দর্শক হয়ে।
প্রাচীন ভারতের সমাজব্যবস্থা ও নারীর স্থান
এই প্রথার পেছনে ছিল পিতৃতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি, যেখানে নারীর জীবন স্বামীর সঙ্গেই সীমাবদ্ধ ছিল। স্বামী মারা গেলে তার জীবনের অর্থ শেষ—এই ধারণাই নারীর অস্তিত্বকে শূন্যে নামিয়ে আনে। সতী হওয়া এক নারীর সর্বোচ্চ গুণ বিবেচনা করা হতো, যেন সে শুধু পুরুষের সেবিকা মাত্র।
আইন ও প্রতিরোধ
ব্রিটিশ শাসনামলে এই প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন জোরালো হয়। বিশেষ করে রাজা রামমোহন রায় সতীদাহের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। তার প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ, ১৮২৯ সালে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্কের শাসনামলে সতীদাহ আইনত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
কিন্তু তারপরও অনেক এলাকায় গোপনে এই প্রথা চলতে থাকে। ১৯৮৭ সালে রাজস্থানের রূপ কুয়ার সতীকাণ্ড তার জ্বলন্ত উদাহরণ, যেখানে শত শত মানুষ তাকে চিতায় উঠতে উৎসাহিত করেছিল।
সতীদাহের সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
এই প্রথা নারীদের কেবল প্রাণ কেড়ে নেয়নি, তাদের স্বাধীনতাকেও কেড়ে নিয়েছে। নারীর ইচ্ছা, কষ্ট, জীবন—সবকিছুই চাপা পড়েছিল ‘সম্মান’, ‘ধর্ম’ আর ‘ঐতিহ্য’-এর ভারে। সতীদাহ সমাজকে বার্তা দিত: একজন নারীর ব্যক্তিত্ব বা স্বাধীন সত্তা নেই, তার অস্তিত্ব শুধুই স্বামীর ছায়া।
আমাদের করণীয়
আজকের সমাজে সতীদাহ নেই—আইন আছে, সজাগতা আছে। কিন্তু এই ঘটনার স্মৃতি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে সমাজ ‘ঐতিহ্য’ আর ‘ধর্ম’-এর নামে নারীর স্বাধীনতা ও জীবন কেড়ে নিতে পারে। অতএব, আমাদের প্রয়োজন এই ইতিহাস জানানো, আলোচনা করা এবং নারীর অধিকারের পক্ষে সোচ্চার হওয়া।
শেষ কথা
সতীদাহ কোনো গৌরবময় ঐতিহ্য নয়; এটি ছিল এক নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার নির্মম রূপ। অতীতের ভুলগুলো যেন ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়—এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার।
তথ্যসূত্র (Sources):
- Roy, Rammohun. Translation of a Conference Between an Advocate for, and an Opponent of, the Practice of Burning Widows Alive. 1818.
- Manu Smriti (মনুস্মৃতি) — প্রাচীন হিন্দু ধর্মশাস্ত্র, যেখানে নারীর ভূমিকা ও বিধিনিষেধ সম্পর্কে উল্লেখ আছে।
- Lata Mani. Contentious Traditions: The Debate on Sati in Colonial India. University of California Press, 1998.