সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘরের ইতিহাস
সোনারগাঁও ছিল বাংলার মুসলিম শাসকদের অধীনে পূর্ববঙ্গের একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। বিক্ষিপ্ত নিদর্শনাদি থেকে প্রতীয়মান হয় যে,এটি পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত একটি বিস্তৃত জনপদ ছিল। সোনারগাঁও বাংলার ঐতিহাসিক অঞ্চলের অন্যতম প্রাচীন রাজধানী এবং পূর্ব বাংলার একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল। এটি একটি নদী বন্দরও ছিল।
তাঁতি ও কারিগরদের বিশাল জনসংখ্যার সাথে বাংলার মসলিন বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সোনারগাঁও। প্রাচীন গ্রীক ও রোমান বিবরণ অনুসারে, এই পশ্চাদভূমিতে এম্পোরিয়াম বা বাণিজ্যিক কেন্দ্র অবস্থিত ছিল, যা প্রত্নতাত্ত্বিকরা ওয়ারী-বটেশ্বর ধ্বংসাবশেষের সাথে সনাক্ত করেছেন। অঞ্চলটি বঙ্গ, সমতট, সেন এবং দেব রাজবংশের একটি ঘাঁটি ছিল।বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ভাণ্ডারে সোনারগাঁও এক উজ্জ্বল রত্ন। মধ্যযুগে এটি ছিল বাংলার রাজধানী, বাণিজ্যকেন্দ্র ও সাংস্কৃতিক মিলনস্থল। নদীবিধৌত এ জনপদে একসময় মসলিন, সুতিবস্ত্র, নীল ও শাঁখার মতো পণ্যের বাণিজ্যে সারা বিশ্বে খ্যাতি লাভ করেছিল। ইতিহাস, লোকশিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির সমন্বয়ে সোনারগাঁওকে বলা যায় বাংলার গৌরবের প্রতীক।
ভূগোল ও অবস্থান
সোনারগাঁও বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। এর পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা নদী, পূর্বে মেঘনা নদী এবং দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী প্রবাহিত। নদীঘেরা এ জনপদ ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সোনারগাঁও বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি ঐতিহাসিক স্থান ও বর্তমান উপজেলা, যা ঢাকা থেকে প্রায় ২৭ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এর ভৌগোলিক অবস্থান ঢাকা শহরের কাছাকাছি এবং এটি মূলত একটি প্রশাসনিক কেন্দ্র ও মধ্যযুগের রাজধানী ছিল, যা বর্তমানে বাংলাদেশের লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এবং পানাম নগরীর জন্য বিখ্যাত। নদীঘেরা এ জনপদ ভৌগোলিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নদীপথে সহজ যোগাযোগ,উর্বর মাটি ও কৃষিজ সমৃদ্ধি,আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সুযোগ এই কারণেই প্রাচীন শাসকগণ সোনারগাঁওকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন।
প্রাচীন ইতিহাস
সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন ইতিহাসে এটি সুবর্ণগ্রাম নামে পরিচিত ছিল, যা মুসলিম বিজয়ের আগে থেকেই বিক্রমপুরের বৌদ্ধ বংশ, যেমন চন্দ্র ও পাল রাজবংশের অধীনে একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। মুসলিম শাসনামলে এটি পূর্ববঙ্গের একটি প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং রাজধানী ছিল, বিশেষত সুলতানী আমলে এবং পরবর্তীতে প্রতাপশালী শাসক ঈশা খাঁ-এর রাজধানী হিসেবেও এর খ্যাতি ছিল। এটি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা ও বঙ্গোপসাগরের নিকটবর্তী একটি কৌশলগত নদী বন্দর ছিল এবং পরবর্তীতে মোঘলদের অধীনে আসে। সোনারগাঁওয়ের নামের উৎপত্তি নিয়ে বিভিন্ন মত আছে। অনেকে মনে করেন, এর প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম, যা থেকে ধীরে ধীরে “সোনারগাঁও” হয়েছে। মৌর্য, গুপ্ত, পাল ও সেন যুগে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জনপদ ছিল।
সুলতানি আমলে সোনারগাঁও
সুলতানি আমলে সোনারগাঁও ছিল পূর্ব বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজধানীও হয়েছিল। এটি মুসলিম শাসকদের অধীনে ছিল এবং বারো-ভূঁইয়াদের কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিতি লাভ করে, যেখানে ঈসা খান ও তার পুত্র মুসা খান মুঘলদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। বাংলার স্বাধীন সুলতানি যুগে (১৩শ–১৫শ শতক) সোনারগাঁও সর্বাধিক গুরুত্ব অর্জন করে।
১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ফখরুদ্দিন মুবারক শাহ সোনারগাঁওকে রাজধানী ঘোষণা করেন। তিনি এখানে টাকশাল (মুদ্রা তৈরির কারখানা) স্থাপন করেন।দুর্গ, মসজিদ, মাদ্রাসা ও রাস্তা নির্মাণ করেন। সোনারগাঁও থেকে তিনি গোটা বঙ্গদেশ শাসন করতেন। এরপর ইলিয়াস শাহ ও তার উত্তরসূরিরাও সোনারগাঁওকে রাজধানী হিসেবে ব্যবহার করেন।
মুঘল আমলে সোনারগাঁও
মুঘল আমলে সোনারগাঁও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র এবং জেলা হিসেবে পরিচিত ছিল, তবে ঈসা খান ও তার পুত্র মুসা খান-এর বারো ভূঁইয়া শাসনের সময় এটি প্রধান প্রশাসনিক কেন্দ্র ও রাজধানী ছিল, যা মুঘলদের সম্প্রসারণ প্রতিহত করে। ঢাকা বিজয়ের পর মুঘলরা সোনারগাঁওকে একটি জেলার মর্যাদা দেয় এবং এটি বাংলার প্রশাসনিক কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। মুঘল শাসনামলে সুবাদার ইসলাম খান চিশতি রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করেন। তবে সোনারগাঁও তার গুরুত্ব হারায়নি। মুঘল আমলে এটি বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় বণিকরা এখানে আসত মসলিন কিনতে। মুঘল প্রশাসনের জন্য এটি কৌশলগত স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হতো।
ঔপনিবেশিক আমলে সোনারগাঁও
ঔপনিবেশিক আমলে সোনারগাঁও তার পূর্বের প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারায়, কারণ নারায়ণগঞ্জ বন্দর প্রতিষ্ঠিত হয় এবং মুসলিম শাসনামলে রাজধানী হিসেবে এর গুরুত্ব কমে যায়। ব্রিটিশ আমলে এই অঞ্চলে পানাম নগরীতে ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর কিছু টাউনহাউস নির্মিত হলেও, মূল শহর হিসেবে এর পূর্বের বাণিজ্যিক গুরুত্ব হ্রাস পায়। ইংরেজ ও অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকরা ১৭শ শতাব্দীতে সোনারগাঁওয়ে আসতে শুরু করে। তারা এখানে নীলচাষ শুরু করে। কাপড় রপ্তানির কেন্দ্র তৈরি হয়। পানাম নগরে বণিকদের বসতি গড়ে ওঠে। এ সময় সোনারগাঁও ধীরে ধীরে গ্রামীণ জনপদে পরিণত হলেও বাণিজ্যিক গুরুত্ব বজায় থাকে।
স্থাপত্য ও প্রত্নতত্ত্ব
সোনারগাঁও মধ্যযুগীয় এবং ঔপনিবেশিক আমলের বহু প্রাচীন স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ একটি ঐতিহাসিক স্থান, যেখানে সুলতানি আমলের গোয়ালদি মসজিদ, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের মাজার, পানাম নগরীর জমিদার বাড়ি এবং বড় সর্দার বাড়ি সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা দেখতে পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি বারো-ভূঁইয়াদের কেন্দ্র ছিল এবং পরবর্তীতে মুঘল সাম্রাজ্যের একটি জেলায় পরিণত হয়। বর্তমানে এখানে বাংলাদেশ লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
স্থাপত্যিক নিদর্শন
গোয়ালদি মসজিদ: সোনারগাঁওয়ের টিকে থাকা মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন এটি, যা প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
পানাম নগরী: এটি একটি ঐতিহাসিক জনপদ যা প্রাচীন জমিদার বাড়ি ও পুরোনো স্থাপনাগুলোর জন্য পরিচিত।
বড় সর্দার বাড়ি: এটি একটি উল্লেখযোগ্য জমিদার বাড়ি, যার স্থাপত্যে মোজাইকের মতো বিভিন্ন নকশা ও কারুকার্য দেখা যায়।
প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব
সুলতানি আমলের স্থাপনা: সোনারগাঁওয়ের সুলতানি আমলের অনেক স্থাপনা, যেমন পাঁচ পীরের মাজার এবং গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের মাজার, আজও বিদ্যমান।
বারো-ভূঁইয়াদের কেন্দ্র: ঈসা খাঁ ও তার পুত্র মুসা খান এখানে মুঘলদের প্রতিরোধ করেছিলেন, যা সোনারগাঁওকে ঐতিহাসিক গুরুত্ব এনে দিয়েছে। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থান শিল্পাচার্য জয়নুল লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর এটি বাংলাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ও লোকশিল্পের একটি উল্লেখযোগ্য সংগ্রহশালা।
সোনারগাঁওয়ের বাণিজ্য ও অর্থনীতি
সোনারগাঁওয়ের অর্থনীতি ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ, এটি সুলতানি ও মুঘল আমলে বাংলার রাজধানী ও প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল এবং এর দীর্ঘ বাণিজ্যিক ঐতিহ্য রয়েছে। বর্তমানে, এটি নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা এবং শিল্প কারখানা, বিশেষ করে অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সিমেন্ট, জাহাজ, খাদ্য, বেভারেজ, ইলেকট্রনিকস, ও ইস্পাত শিল্পের কেন্দ্র হিসেবে বিকশিত হচ্ছে। সোনারগাঁওয়ের সমৃদ্ধির প্রধান উৎস ছিল বাণিজ্য।
মসলিন কাপড়: বিশ্বের সূক্ষ্মতম কাপড়, যা বিদেশে রপ্তানি হতো।
নীল: ইউরোপীয় বাজারে ব্যাপক চাহিদা ছিল।
সুতি কাপড় ও শাঁখা: স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ।
মসলাজাতীয় পণ্য, কাঠ ও ধাতব দ্রব্যও এখান থেকে রপ্তানি হতো।মধ্যযুগে সোনারগাঁওকে বলা হতো “বাণিজ্যের রাজধানী”।
সোনারগাঁওয়ের সংস্কৃতি ও সাহিত্য
সোনারগাঁওয়ের সংস্কৃতির মধ্যে লোকশিল্প ও কারুশিল্প, বিশেষ করে মসলিন শিল্প, রেশম শিল্প, ও শীতল পাটি উল্লেখযোগ্য ছিল। সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে সোনারগাঁও মূলত ঈশা খাঁর রাজধানী হিসেবে এবং সুলতানী ও মুঘল আমলে প্রশাসনিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এর সাহিত্যিক গুরুত্ব কমে গেলেও লোকশিল্প জাদুঘরের মাধ্যমে এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষিত হচ্ছে। সোনারগাঁও কেবল অর্থনীতির কেন্দ্রই ছিল না, বরং সংস্কৃতি ও সাহিত্যেও সমৃদ্ধ ছিল।
সুফি সাধক ও বৈষ্ণব কবিদের পদচারণায় এটি ছিল ধর্মীয়–সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। বৈষ্ণব পদাবলি রচনার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল সোনারগাঁও। জনসাধারণের মধ্যে ভাটিয়ালি, জারি, পালাগান জনপ্রিয় ছিল। লোকশিল্প যেমন নকশিকাঁথা, বাঁশের সামগ্রী, মাটির হাঁড়ি-পাত্র সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্যের অংশ।
শিক্ষা ও ধর্ম
সোনারগাঁওয়ের ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে শরিফুদ্দীন আবু তাওয়ামা এবং শেখ আলাউল হক-এর মতো সুফি ও আলেমদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল, যারা এখানে মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে একসময় উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয় ছিল এবং পরবর্তীতে হিন্দু জমিদারদের সময়ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। বর্তমানে এখানে লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরসহ আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও রয়েছে।
আধুনিক সোনারগাঁও
আজকের সোনারগাঁও নারায়ণগঞ্জ জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এখানে লোকশিল্প জাদুঘর ও পানাম নগর প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। প্রতিবছর লোকশিল্প মেলা ও পিঠা উৎসব আয়োজন করা হয়। শিল্পাঞ্চল গড়ে উঠেছে, ফলে আধুনিক অর্থনীতি সক্রিয়।
পর্যটন সম্ভাবনা
সোনারগাঁওয়ের পর্যটন সম্ভাবনা প্রবল, যা এখানকার সমৃদ্ধ ইতিহাস, ঐতিহাসিক স্থাপত্য, ও ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের কারণে দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে লোকশিল্প জাদুঘর, কারুপল্লী, প্রাচীন জমিদার বাড়ি, ও বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থাপনা রয়েছে। চলমান উন্নয়ন কাজ সম্পন্ন হলে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হবে।
চ্যালেঞ্জ ও সংরক্ষণ সমস্যা
সোনারগাঁও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি—সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন ঐতিহ্য ও প্রত্নতত্ত্বের মূল চ্যালেঞ্জগুলো হলো প্রত্নসম্পদের ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থা, অপর্যাপ্ত সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে জনসাধারণের অসচেতনতা। এই সমস্যাগুলোর সমাধান ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণের জন্য স্থানীয় সংগঠনগুলো মানববন্ধন ও গোলটেবিল বৈঠকের মাধ্যমে দাবি জানাচ্ছে। পানাম নগরের ভবনগুলো ধ্বংসপ্রায়। অবৈধ দখল ও অযত্নে নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও স্থানীয় জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এগুলো রক্ষা করা জরুরি।
সোনারগাঁও কেবল একটি প্রাচীন রাজধানী নয়, বরং এটি বাংলার অতীত ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জীবন্ত সাক্ষ্য। ইতিহাসের প্রতিটি স্তরে এ জনপদ তার নিজস্ব ভূমিকা রেখেছে। প্রাচীন যুগে এটি ছিল সুবর্ণগ্রাম নামে পরিচিত, মধ্যযুগে সুলতানি রাজধানী, মুঘল আমলে বাণিজ্যকেন্দ্র এবং ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় বণিকদের ব্যবসায়িক ঘাঁটি। এভাবে হাজার বছরের ধারাবাহিকতায় সোনারগাঁও এক বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক হয়ে উঠেছে।
মসলিন কাপড়, নীলচাষ, শাঁখা ও হস্তশিল্প সোনারগাঁওকে শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও পরিচিত করেছে। বিদেশি বণিকরা বাংলার সোনারগাঁওয়ে এসে বিস্মিত হতো এখানকার নিপুণ কারিগরদের দক্ষতা দেখে। এখানকার মসলিন একসময় ইউরোপীয় অভিজাতদের পোশাকের প্রধান উপাদান ছিল। অর্থাৎ, সোনারগাঁও ছিল বৈশ্বিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র।
শুধু অর্থনীতি নয়, সংস্কৃতি ও সাহিত্যেও সোনারগাঁও ছিল সমান গুরুত্বপূর্ণ। ভাটিয়ালি, জারি, বৈষ্ণব পদাবলি ও সুফি সাহিত্য এ জনপদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধ করেছে। লোকশিল্প, নকশিকাঁথা, কাঠের কাজ, বাঁশের সামগ্রী ও মাটির শিল্প এখানকার মানুষের সৃজনশীলতার পরিচায়ক। আজও লোকশিল্প জাদুঘরের মাধ্যমে সোনারগাঁও সেই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করছে।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য, সোনারগাঁওয়ের বহু নিদর্শন আজ ধ্বংসপ্রায়। পানাম নগরের বাড়িগুলো ভেঙে পড়ছে, নদীভাঙনে জমি হারাচ্ছে, অবহেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নষ্ট হচ্ছে। আধুনিকায়নের নামে ঐতিহ্যের জায়গায় কংক্রিটের ভবন উঠে আসছে। এর ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো আর দেখতে পাবে না বাংলার এই ঐতিহ্যের প্রকৃত রূপ। তাই এখন সময় এসেছে সোনারগাঁওকে নতুন করে মূল্যায়ন করার।
সোনারগাঁও কেবল ইতিহাসের অংশ নয়, এটি বর্তমান ও ভবিষ্যতেরও অংশ। এই ঐতিহ্য যদি আমরা সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও প্রচার করতে পারি, তবে এটি জাতীয় গর্বের পাশাপাশি আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করবে।
সর্বোপরি, সোনারগাঁও আমাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের প্রতীক, আমাদের পরিচয়ের অবিচ্ছেদ্য অংশ। অতীতের গৌরবময় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, বর্তমানের চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়েই আমরা সোনারগাঁওকে বিশ্বদরবারে পরিচিত করতে পারব। এভাবেই সোনারগাঁও হয়ে উঠবে— “বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও সভ্যতার চিরন্তন বাতিঘর।”
তথ্যসূত্র
আহমদ, সৈয়দ মোহাম্মদ। বাংলার ইতিহাসে সোনারগাঁও, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনা, ঢাকা।
রহমান, আবদুল করিম। বাংলার সুলতানি আমল, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
সুলতান, শাহাদত হোসেন। পানাম নগর ও সোনারগাঁওয়ের ঐতিহ্য, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর (সরকারি প্রকাশনা ও প্রদর্শনী উপকরণ)।
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রকাশনা ও প্রতিবেদন।