Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসসোমপুর মহাবিহার: স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন

সোমপুর মহাবিহার: স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন

সোমপুর মহাবিহার: স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন

সোমপুর মহাবিহার (Somapura Mahavihara) প্রাচীন বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি এবং দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম বৌদ্ধ বিহার। এটি বর্তমান বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার পাহাড়পুরে অবস্থিত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষণা করে। সোমপুর মহাবিহার পাল সাম্রাজ্যের সম্রাট ধর্মপাল কর্তৃক ৮ম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এর বিশালতা, শিল্পকলা এবং ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি শুধু বাংলাদেশের নয়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশের জন্য গৌরবের প্রতীক।

অবস্থান

অবস্থান: নওগাঁ জেলার বদলগাছি উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামে।

ভৌগোলিক অবস্থান: ২৫°০০′ উত্তর অক্ষাংশ ও ৮৮°৫৭′ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ।

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৪৫ কিমি দূরে, এবং বগুড়া থেকে প্রায় ৫০ কিমি।

ঐতিহাসিক পটভূমি

৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে হিউয়েন সাং পুন্ড্রবর্ধনে আসেন, তবে তার বিস্তারিত বিবরণে সোমপুরের বিহার ও মন্দিরের কোন উল্লেখ নেই। গোপালের পুত্র ধর্ম পাল (৭৮১ – ৮২২ খ্রি) সিংহাসনে আরোহণ করে দীর্ঘকাল রাজত্ব করেন ও রাজ্যকে বাংলা বিহার ছাড়িয়ে পাকিস্তানের উত্তর – পশ্চিম সীমান্তের গান্ধার পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। সম্রাট ধর্মপাল অনেক নিষ্ঠাবান বৌদ্ধ ছিলেন ও তিনিই বিক্রমশীলা ও সোমপুর বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। অন্য মতে, বিখ্যাত তিব্বতীয় ইতিহাস গ্রন্থ “পাগ সাম জোন ঝাং” এর লেখক অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে ধর্মপালের পুত্র দেবপাল (৮১০-৮৫০) কর্তৃক সোমপুরে নির্মিত বিশাল বিহার ও সুউচ্চ মন্দিরের উল্লেখ করেছেন।

সোমপুর বিহারের ভিক্ষুরা নালন্দা, বুদ্ধগয়া প্রভৃতি ভারতীয় বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থানে অর্থ ও ধন রত্ন দান করতেন বলে বিভিন্ন লিপিতে উল্লেখ করা আছে, যা ১০ম – ১১শ শতাব্দীতে সমৃদ্ধশীল অবস্থার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়া ৯ম শতাব্দী পর্যন্ত পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সোমপুর বিহার ছাড়াও অগ্রপুর (রাজশাহীর অগ্রাদিগুণ), উষ্মপুর, গোটপুর, এতপুর ও জগদ্দল ( রাজশাহীর জগদল) বিহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। ৯ম শতাব্দীর শেষভাগে গুর্জর রাজ প্রথম ভোজ ও মহেন্দ্র পাল, পাল সাম্রাজ্যের বিশেষ ক্ষতিসাধন করেন। পরে ১০ম শতাব্দীর শেষভাগে পাল বংশীয় রাজা মহীপাল (৯৯৫ – ১০৪৩) সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধার করেন ও সোমপুর বিহার মেরামত করেন। কিন্তু মহীপাল ও তার পুত্র নয়াপালের মৃত্যুর পর আবার পাল বংশের পতন শুরু হয়। এই সুযোগে মধ্যভারতের চেদীরাজ কর্ণ, চোলরাজ রাজেন্দ্র ও দিব্বো নামের এক দেশীয় কৈবর্ত সামন্ত নরপতি পর পর বরেন্দ্রভূমি আক্রমণ করেন।

নালন্দায় পাহাড়পুর মন্দির ও বিহার ধ্বংসের উল্লেখ সম্ভবত এ সময়ের আক্রমণের। ১১শ শতাব্দীতে পাল বংশীয় রামপাল হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধার করেন। ১২শ শতাব্দীতে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাট থেকে আগত সেন রাজারা বাংলা দখল করেন। সে রাজদের আমলে সোমপুর রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা হারায়। এ সময় শেষবারের মত সোমপুরের পতন শুরু হয়। সেন শাসনের ফলে পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকা এই বিহার সম্পর্কে একজন পণ্ডিত লিখেছেন, “পাহাড়পুরের বিহার ও মঠের ধ্বংসাবশেষগুলো বড় আকারের ধ্বংসের কোনও স্পষ্ট চিহ্ন বহন করে না। বিহার পরিত্যাগ বা ধ্বংসের মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানের পতনের অবশ্যই মুসলিম আক্রমণের ফলে সৃষ্ট ব্যাপক অস্থিরতা ও জনসংখ্যার বাস্তুচ্যুতির প্রভাব ছিল।

সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংস ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও বিশ্লেষণ :

সোমপুর মহাবিহার (বর্তমানে পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার) প্রাচীন বাংলার অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। পাল রাজবংশের অধীনে নির্মিত এই মহাবিহার জ্ঞান, ধর্ম ও সংস্কৃতির এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে খ্যাত ছিল। তবে ১১শ থেকে ১৩শ শতকের মাঝে একাধিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রভাবে এই সমৃদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র ধীরে ধীরে ধ্বংসের মুখে পড়ে যায়।

১.মুসলিম আক্রমণ ও বাহ্যিক আগ্রাসন

মুসলিম সেনাপতি ও আক্রমণ: ১২০৪-১২শ শতকের প্রথম দিকে তুর্কি সেনাপতি মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজির বাহিনী বাংলার বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র—নালন্দা, ওদন্তপুরীসহ—আক্রমণ করে।

অনেক গবেষক মনে করেন, বখতিয়ার খলজির শাসনামলে এই অঞ্চলের অনেক বিহার ও মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছিল, যদিও সোমপুর মহাবিহারের ক্ষেত্রে সরাসরি প্রমাণ কিছুটা বিতর্কিত। আক্রমণের সময় লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গণহত্যা সংঘটিত হয়, যার ফলে প্রতিষ্ঠানটির মূল্যবান গ্রন্থাগার, শিল্পকর্ম ও স্থাপত্য নিদর্শন ধ্বংস হয়ে যায়।

২.অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও স্থানীয় শাসকদের ভূমিকা

স্থানীয় রাজনীতির প্রভাব: কিছু প্রাচীন শিলালিপি ও ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, স্থানীয় হিন্দু শাসকরা ও রাজনীতিক দ্বন্দ্বও সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসের পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

ঐতিহাসিক কিছু সূত্রে উল্লেখ আছে যে, রাজা জাতবর্মা বা সমমানের কোনো স্থানীয় নেতার আক্রমণে মঠের প্রধান প্রতীক ও মঠাধ্যক্ষকে হত্যার ঘটনা ঘটে, যার ফলে বিহারের স্থায়িত্ব ভঙ্গ হয়। অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা ও শাসনের হস্তক্ষেপের কারণে শিক্ষাকেন্দ্রটি অপরিকল্পিতভাবে অবহেলিত ও পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্ষয়:

সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসের ফলে প্রাচীন বাংলায় বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হারিয়ে যায়। বহু মূল্যবান ধর্মীয় গ্রন্থ, শিলালিপি ও শিল্পকর্ম মুছে যায় যা পূর্ব এশিয়ার জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক অপূরণীয় অংশ ছিল। এই ধ্বংস প্রক্রিয়া শুধু একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান না, বরং এক সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ও শিক্ষামূলক ঐতিহ্যের পতনেরই পরিচায়ক।

অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা ও রাজনৈতিক অস্থায়িত্ব:

স্থানীয় শাসন ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে, বহিরাগত আগ্রাসনের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ অব্যবস্থাও বিহারের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করে।

এই প্রক্রিয়া দীর্ঘমেয়াদে বাংলায় ও ভারতের বৌদ্ধ শিক্ষা ও গবেষণা ব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক পরিচিতিতে গভীর প্রভাব ফেলে।

সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংসের ঘটনা একদিকে মুসলিম বাহিনীর আক্রমণের ফলাফল হিসেবে তফসিল করা হলেও, অন্যদিকে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ও স্থানীয় শাসকদের অস্থিরতা ও অবহেলারও এতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে।

বাহ্যিক আগ্রাসন: বখতিয়ার খলজির শাসনামলে বাহ্যিক আক্রমণ ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হলেও, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব স্থানীয় শাসকদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও হস্তক্ষেপও শিক্ষাকেন্দ্রের অবক্ষয়ে ভূমিকা রাখে।

এই দুই ন্যারেটিভ একত্রে বিবেচিত হলে দেখা যায় যে, সোমপুর মহাবিহারের ধ্বংস শুধুমাত্র একধরনের বাহ্যিক আক্রমণ নয়, বরং এক বহুমুখী এবং জটিল প্রক্রিয়া, যার ফলে এই প্রাচীন শিক্ষাকেন্দ্র চিরতরে অমোঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ থেকে হারিয়ে যায়।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

সোমপুর মহাবিহারের স্থাপত্য ভারতীয় উপমহাদেশের বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য উদাহরণ। এর স্থাপত্যশৈলীতে গুপ্ত, পাল ও প্রাচীন নালন্দা মহাবিহারের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।

প্রধান বৈশিষ্ট্য:

আয়তন ও পরিসর: সোমপুর মহাবিহারের মোট এলাকা প্রায় ২৭ একর। বিহারের প্রধান প্রাচীর বর্গাকার, প্রতিটি বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ২৮১ মিটার।

কেন্দ্রীয় স্তূপ: বিহারের মাঝখানে একটি বিশাল স্তূপ ছিল, যা বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। স্তূপটি বৌদ্ধ ধর্মের প্রতীক এবং ধ্যানের স্থান ছিল। এর উচ্চতা ছিল প্রায় ২১ মিটার।

কক্ষের বিন্যাস: পুরো বিহারে ১৭৭টি কক্ষ ছিল, যা শিক্ষার্থী ও ভিক্ষুদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কক্ষগুলো প্রাচীরের চারপাশে বিন্যস্ত।

প্রবেশদ্বার: প্রধান প্রবেশদ্বারটি উত্তর দিকে। এছাড়া পূর্ব, পশ্চিম ও দক্ষিণে ছোট প্রবেশপথ ছিল।

অলংকরণ: বিহারের দেয়ালে টেরাকোটার ফলক দ্বারা শোভিত। এই ফলকে পৌরাণিক কাহিনি, প্রাণী, উদ্ভিদ, নৃত্যশিল্পী, এবং সামাজিক জীবনের নানা দৃশ্য অঙ্কিত আছে।

টেরাকোটা ফলক

সোমপুর মহাবিহারের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য টেরাকোটা ফলক। প্রায় ২,৮০০টির বেশি ফলক আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলিতে দেখা যায়:

বৌদ্ধ ধর্মীয় চিত্রকল্প।

হিন্দু দেব-দেবীর চিত্র।

লোকজ জীবনের দৃশ্য।

নৃত্য ও সংগীতের উপস্থাপনা।

টেরাকোটা শিল্প সেই সময়কার মানুষের সংস্কৃতি, পোশাক, গহনা ও জীবনধারার প্রমাণ বহন করে।

শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র

সোমপুর মহাবিহার শুধু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এখানে বৌদ্ধ দর্শন, চিকিৎসা, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য এবং অন্যান্য বিদ্যা শেখানো হতো। নালন্দা, বিক্রমশীলা, ওদান্তপুরীর মতো সোমপুর মহাবিহারও একটি মহাবিদ্যালয় ছিল। চীন ও তিব্বতের ইতিহাসে তিব্বতের বিখ্যাত পণ্ডিত আতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান সোমপুর মহাবিহারের শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

ধ্বংসের ইতিহাস

১২শ শতাব্দীর শেষভাগে মুসলিম আক্রমণ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সোমপুর মহাবিহার ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। প্রাচীন ইতিহাসে উল্লেখ আছে যে, ১৩শ শতাব্দীতে তুর্কি সেনাপতি বখতিয়ার খলজি এই অঞ্চল আক্রমণ করলে বিহারটি সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। পরবর্তী সময়ে এটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে এবং মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়।

পুনঃআবিষ্কার

১৯২৩ সালে ব্রিটিশ প্রত্নতত্ত্ববিদরা খননকার্য শুরু করেন। এর পরে পাকিস্তান আমলে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের পরে খনন ও সংরক্ষণ কাজ অব্যাহত থাকে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য

১১৯৮৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত বিশ্ব ঐতিহ্য রক্ষা কমিটির এক সমাবেশে এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। কারণ:

এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের তালিকায় ৩২২তম স্মারক হিসেবে চিহ্নিত। সোমপুর মহাবিহার শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয়ই ছিল না, বরং এটি ছিল বৌদ্ধ ভিক্ষু ও পণ্ডিতদের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার বিশাল কেন্দ্র, যা সমগ্র এশিয়া জুড়ে খ্যাতি লাভ করেছিল। এই মহাবিহারটি ৮ম শতকে (সঠিকভাবে বলতে গেলে ৭৮১-৮২১ খ্রিষ্টাব্দে) পাল রাজা ধর্মপালের শাসনামলে নির্মিত হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বদলগাছী উপজেলায় অবস্থিত। এই বিশাল বৌদ্ধবিহারের চারপাশে ১৭৭টি ভিক্ষুকক্ষ ছিল এবং এর ঠিক কেন্দ্রে একটি মন্দির ছিল। এটি বৌদ্ধ স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার বৌদ্ধ শিক্ষার ইতিহাসের প্রধান কেন্দ্র। এর টেরাকোটা শিল্প অতুলনীয়।

বর্তমান অবস্থা

বর্তমানে সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক এটি দেখতে আসেন। এখানে একটি জাদুঘর রয়েছে যেখানে পাওয়া প্রত্নবস্তু প্রদর্শিত হয়। সরকার ও ইউনেস্কো একযোগে এর সংরক্ষণে কাজ করছে।

সোমপুর মহাবিহারের গুরুত্ব

ঐতিহাসিক গুরুত্ব:

পালরাজাদের শাসন ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার: পাল রাজবংশের রাজা ধর্মপালদেব কর্তৃক এই বিহার নির্মিত হয়, যা পাল শাসকদের বৌদ্ধধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগ ও পৃষ্ঠপোষকতার প্রমাণ বহন করে।

শিক্ষার কেন্দ্র: সোমপুর মহাবিহার একটি আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এটি শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয়, বরং এশিয়াের অন্যান্য দেশ থেকেও পর্যটকদের আকৃষ্ট করত, এবং বিদেশি ঐতিহাসিক ও পরিব্রাজকদের গ্রন্থগুলোতে এর সমৃদ্ধি ও খ্যাতির কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে।

ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি: এটি ছিল বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও প্রসারের একটি কেন্দ্র, যা বহু শতাব্দী ধরে জ্ঞানচর্চা ও সংস্কৃতির এক বিশাল কেন্দ্র ছিল।

স্থাপত্য ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব: এর বিশাল আয়তন ও অসাধারণ স্থাপত্যশৈলী একে এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান: ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো সোমপুর মহাবিহারকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের মর্যাদা দেয়, যা এর বৈশ্বিক গুরুত্বকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

স্থাপত্যশৈলীর গুরুত্ব:

নকশার বিশালতা: এটি South Asia-র অন্যতম বৃহত্তম বৌদ্ধবিহার ছিল, যার মূল কাঠামো প্রায় ২৭,০০০ বর্গমিটার বিস্তৃত ছিল।

চতুর্ভুজাকার নকশা: বিহারটি একটি চতুর্ভুজাকার কাঠামোয় নির্মিত, যেখানে ১৭৭টি কক্ষ রয়েছে।

ঐতিহ্যবাহী স্তূপ ও মন্দির: বিহারের কেন্দ্রে একটি ঐতিহ্যবাহী বৌদ্ধ স্তূপ রয়েছে এবং এর বাইরে মন্দির সংলগ্ন দেয়ালে বুদ্ধ ও হিন্দুদের দেবী মূর্তির পাশাপাশি বিভিন্ন পোড়া মাটির ফলক দেখা যায়।

গুপ্ত ও ভারতীয় বৌদ্ধ স্থাপত্যের মিশ্রণ: এর স্থাপত্যশৈলী গুপ্ত যুগের ও প্রাচীন ভারতীয় বৌদ্ধ স্থাপত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ মেলবন্ধন, যা পাল রাজা ধর্মপাল কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এই বিহারটিকে অনন্য করেছে।

আবাসন ও শিক্ষা কেন্দ্র: ১৭৭টি কক্ষ ভিক্ষুদের থাকার ও ধ্যানের জন্য ব্যবহৃত হতো, যা এটিকে শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

আন্তর্জাতিক আকর্ষণ: শুধু স্থানীয় নয়, চীন, তিব্বত, মায়ানমার, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে ধর্মজ্ঞান অর্জনের জন্য আসত, যা এর স্থাপত্যের প্রভাবকে নির্দেশ করে।

সাংস্কৃতিক গুরুত্ব:

জ্ঞান ও শিক্ষার কেন্দ্র: সোমপুর মহাবিহার ছিল একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়। এটি একটি বিশাল শিক্ষাকেন্দ্র ছিল যেখানে ধর্ম, শিল্পকলা এবং বৌদ্ধ哲学 নিয়ে চর্চা হতো।

ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব: এটি বৌদ্ধদের একটি অত্যন্ত বিখ্যাত ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল, যা প্রায় ৩০০ বছর ধরে কার্যকর ছিল।

স্থাপত্য ও শিল্পকলা: এর বিশাল স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন বাংলার স্থাপত্যের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এখানে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রত্নবস্তু থেকে সেই সময়ের শিল্পকলা এবং ধর্মীয় ভাবধারার পরিচয় পাওয়া যায়।

ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব: এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান এবং ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। এটি পাল রাজবংশের সময়ের জ্ঞান ও সংস্কৃতির এক মূল্যবান নিদর্শন।

আন্তর্জাতিক পরিচিতি: এটি শুধুমাত্র বাংলাতেই নয়, বরং পুরো ভারতীয় উপমহাদেশেই পরিচিত ছিল এবং হিমালয়ের দক্ষিণ অঞ্চলের বৃহত্তম মঠগুলির মধ্যে একটি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ

জলবায়ুর পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক ক্ষয়।

অপরিকল্পিত পর্যটন কার্যক্রম।

সংরক্ষণ কাজে পর্যাপ্ত অর্থ ও প্রযুক্তির প্রয়োজন।

সোমপুর মহাবিহার কেবল প্রাচীন বাংলার একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জ্ঞানচর্চার এক অমূল্য ঐতিহ্য। পাল সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগে নির্মিত এই মহাবিহার ছিল সেই সময়ের বৌদ্ধ ধর্মের প্রাণকেন্দ্র এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের আলোকবর্তিকা। এখানে শুধু ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানই নয়, বরং দর্শন, চিকিৎসাবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, সাহিত্য ও শিল্পকলার চর্চা হতো।

এর স্থাপত্যশৈলী এবং টেরাকোটা শিল্পকর্ম থেকে বোঝা যায়, তখনকার সমাজ কতটা সমৃদ্ধ ছিল। এ নিদর্শন প্রমাণ করে যে প্রাচীন বাংলায় শুধু ধর্মীয় নয়, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাগত উন্নতিরও অসাধারণ ইতিহাস রয়েছে। আজকের আধুনিক বাংলাদেশ যখন নিজস্ব ঐতিহ্যের গৌরব তুলে ধরতে চায়, তখন সোমপুর মহাবিহারের গুরুত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়।

বর্তমানে এটি ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত হলেও, এর সংরক্ষণ নিয়ে চ্যালেঞ্জ রয়েছে। প্রাকৃতিক ক্ষয়, পর্যটকদের অবহেলা, অপর্যাপ্ত রক্ষণাবেক্ষণ এবং জলবায়ুর পরিবর্তন এর জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে। তাই রাষ্ট্র, গবেষক, সংরক্ষণবিদ এবং জনগণকে একযোগে এর রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রচারে কাজ করতে হবে।

সোমপুর মহাবিহার শুধু অতীতের গৌরব নয়; এটি আজও শিক্ষা দেয় যে, সংস্কৃতি ও জ্ঞানের বিকাশে শান্তি ও সহনশীলতা অপরিহার্য। এই ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ করা মানে ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে জ্ঞানের আলো পৌঁছে দেওয়া। তাই আমরা সকলেই যদি একে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে পারি এবং যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারি, তবে এটি বাংলাদেশকে বিশ্ব মঞ্চে আরও উজ্জ্বল করে তুলবে।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর – পাহাড়পুর মহাবিহার সম্পর্কিত সরকারি তথ্য।

“A History of Bangladesh” by Willem van Schendel – ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট।

Banglapedia: National Encyclopedia of Bangladesh – সোমপুর মহাবিহার নিবন্ধ।

UNESCO World Heritage Centre

Department of Archaeology, Bangladesh – গবেষণা ও খনন সংক্রান্ত তথ্য।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments