Friday, October 3, 2025
Homeপ্রকৃতিতুষারময় পেঁচা

তুষারময় পেঁচা

তুষারময় পেঁচা


তুষারময় আউল পেঁচা বা “Snowy Owl” (বৈজ্ঞানিক নাম: Bubo scandiacus) হলো একটি অসাধারণ ও শীতপ্রধান অঞ্চলে বসবাসকারী পাখি, যা তার সাদা পালকের জন্য খুবই বিখ্যাত। এই পেঁচাটি আর্কটিক অঞ্চলের বাসিন্দা এবং এর সৌন্দর্য, শিকার কৌশল ও অভিযোজন ক্ষমতার জন্য এটি বিশ্বব্যাপী পাখিপ্রেমীদের মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়। এটি “হ্যারি পটার” সিনেমার মাধ্যমে আরও জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, যেখানে হ্যারি পটার তার পোষা পেঁচা হেডউইগ হিসেবে একটি তুষারময় আউল পেঁচা ব্যবহার করে।

বাহ্যিক গঠন

তুষারময় পেঁচাগুলো মাঝারি থেকে বড় আকারের পাখি। পুরুষ পেঁচাগুলি প্রায় পুরোপুরি সাদা হয়ে থাকে, আর স্ত্রী পেঁচাগুলির গায়ে থাকে কিছুটা কালো বা বাদামী দাগ। এদের চোখ বড় এবং উজ্জ্বল হলুদ, যা রাতেও শিকার করতে সাহায্য করে। ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার জন্য এদের পা ও পাখনায় ঘন পালক থাকে, যা এক ধরনের প্রাকৃতিক মোজা ও দস্তানা হিসেবে কাজ করে।

তুষারময় পেঁচা বেশ বড় আকারের পাখি, যার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫১ থেকে ৭০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের ডানার বিস্তার ১৩০ থেকে ১৬৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এদের ওজন সাধারণত ১.৫ থেকে ৩ কেজি পর্যন্ত হয় এবং ডানার বিস্তার হতে পারে প্রায় ৪.৫ থেকে ৫.৫ ফুট পর্যন্ত।

আবাস ও পরিবেশ

তুষারময় আউল সাধারণত আর্কটিক অঞ্চল, যেমন কানাডার উত্তরের অঞ্চল, আলাস্কা, গ্রিনল্যান্ড এবং ইউরেশিয়ার উত্তরাংশে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মে এরা বরফাচ্ছাদিত উন্মুক্ত টুন্দ্রা অঞ্চলে বাস করে। তবে শীতকালে খাবারের সন্ধানে এরা অনেক দূর দক্ষিণেও চলে আসে, এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু অংশে দেখা যায়। এই শীতকালীন স্থানান্তর বা “irruption” সবসময় ঘটে না, তবে যখন খাদ্যসংকট হয়, তখন তারা একসঙ্গে অনেক দক্ষিণে চলে আসে।

খাদ্যাভ্যাস ও শিকার

তুষারময় পেঁচা মূলত মাংসাশী। এদের প্রধান খাদ্য হলো লেমিং (lemming), একটি ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী যা আর্কটিক অঞ্চলে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। গ্রীষ্মকালে একটি প্রাপ্তবয়স্ক তুষারময় পেঁচা প্রতিদিন ৫ থেকে ৬টি লেমিং খেয়ে ফেলে। এছাড়াও এরা খরগোশ, ইঁদুর, পাখি, এবং এমনকি মাছও খেতে পারে।

তুষারময় পেঁচা একটি নির্ভুল শিকারি। তারা নিচু গাছ, পাহাড়ের ঢাল বা বরফের উপর বসে শিকারের জন্য অপেক্ষা করে এবং হঠাৎ করে আক্রমণ চালিয়ে তাদের শিকারকে ধরে ফেলে। তাদের শ্রবণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি অত্যন্ত প্রখর, যা রাতে ও বরফঢাকা পরিবেশেও শিকার করতে সহায়তা করে।

প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি

প্রতিটি গ্রীষ্ম মৌসুমে তুষারময় পেঁচা টুন্দ্রার উঁচু স্থানে বাসা বাঁধে। তারা সাধারণত মাটির উপর ছোট গর্তের মতো বাসা তৈরি করে, যেখানে স্ত্রী পেঁচা ৩ থেকে ১১টি ডিম পাড়ে। ডিম পাড়ার সংখ্যা নির্ভর করে সেই বছরের লেমিং এর প্রাচুর্যের উপর – যদি প্রচুর খাবার থাকে, তবে ডিমের সংখ্যাও বেশি হয়।

স্ত্রী পেঁচা ডিমে তা দেয় এবং পুরুষ পেঁচা খাবার এনে দেয়। ডিম ফুটে বাচ্চা বের হতে প্রায় ৩২-৩৪ দিন সময় লাগে। বাচ্চাগুলি প্রাথমিকভাবে অন্ধ ও দুর্বল হয়, কিন্তু ২০-২৫ দিনের মধ্যে তারা হেঁটে বেড়াতে পারে এবং ৭ সপ্তাহের মধ্যে উড়তে শেখে।

সামাজিক আচরণ

তুষারময় পেঁচা একা থাকতে পছন্দ করে। তারা সাধারণত একাকী শিকার করে এবং নিজেদের এলাকা অন্য পেঁচাদের থেকে রক্ষা করে। তবে খাদ্যের অভাবে বা শীতকালে তারা অনেক সময় গোষ্ঠীবদ্ধভাবে দেখা যায়।

তারা অনেক সময় মানুষের বসতি সংলগ্ন এলাকাতেও আসে, বিশেষ করে শীতকালে খাদ্য সংকটে পড়লে। তবে মানুষের উপস্থিতি ও পরিবেশগত পরিবর্তন এদের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে।

হুমকি ও সংরক্ষণ

তুষারময় পেঁচা এখনো “Least Concern” (IUCN-এর তালিকা অনুযায়ী) হিসেবে তালিকাভুক্ত হলেও, জলবায়ু পরিবর্তন, আবাসস্থলের ধ্বংস, খাদ্যসংকট ও শিকার – এসব কারণে তাদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে।

বিশেষত আর্কটিক অঞ্চলের উষ্ণায়নের ফলে লেমিং এর প্রজনন প্রভাবিত হচ্ছে, যার কারণে তুষারময় পেঁচার খাদ্য সংকট তৈরি হচ্ছে। এছাড়া অবৈধ শিকার এবং বৈদ্যুতিক তারে ধাক্কা খাওয়ার মতো ঘটনাও তাদের মৃত্যুর কারণ।

হাইব্রিড প্রজাতি

তুষারময় পেঁচা অন্যান্য প্রজাতির পেঁচাদের সাথে আন্তঃপ্রজনন করে বলে জানা যায় না, এবং সেই অনুযায়ী, তুষারময় পেঁচা এবং অন্যান্য পেঁচা প্রজাতির কোনও সংকর এখনও বন্য অঞ্চলে দেখা যায়নি। যাইহোক, জার্মানির কোলনবার্গে একটি শখের বাজপাখি ২০১৩ সালে একটি পুরুষ তুষারময় পেঁচা এবং একটি স্ত্রী ইউরেশিয়ান ঈগল-পেঁচা ( বুবো বুবো ) থেকে সংকর প্রজনন করে।

দুটি পুরুষ হাইব্রিড পেঁচা তাদের ইউরেশিয়ান ঈগল-পেঁচা মায়ের পালকের মতোই কালো দাগের অধিকারী ছিল, যদিও তাদের তুষারময় পেঁচা বাবার পালকের মতো কালো-সাদা রঙ ধরে রেখেছিল। জার্মান শব্দ তুষারময় পেঁচা এবং ইউরেশিয়ান ঈগল-পেঁচা (যথাক্রমে শ্নি -ইউল এবং উহু ) থেকে সংকরগুলিকে ” Schnuhus “ বলা হত । ২০১৪ সাল নাগাদ, সংকরগুলি পরিণত হয়েছিল এবং সুস্থ ছিল।

তুষারময় পেঁচা ও সংস্কৃতি

তুষারময় পেঁচা বহু সংস্কৃতিতে জ্ঞান, রহস্য এবং রাত্রিকালীন ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত। পশ্চিমা সাহিত্যে, কল্পকাহিনীতে এবং সিনেমায় তাদের উপস্থিতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। “হ্যারি পটার” সিরিজে হেডউইগ নামে হ্যারির পোষা তুষারময় পেঁচাটি এই প্রজাতিকে বিশ্বব্যাপী আলোচনায় নিয়ে আসে।

তুষারময় আউল পেঁচা হলো প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। তাদের সাদা সৌন্দর্য, শক্তিশালী শিকার কৌশল এবং ঠান্ডা পরিবেশে অভিযোজন ক্ষমতা একে পাখির জগতে বিশেষভাবে আলাদা করে তোলে। তবে আমাদের দায়িত্ব হলো এই মহাবিশ্বের এই দুর্লভ প্রজাতিকে রক্ষা করা, তাদের বাসস্থান সংরক্ষণ করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় সচেতনতা গড়ে তোলা।

তুষারময় পেঁচা শুধু বরফের পাখি নয়, বরং এক নিঃশব্দ শিকারি, প্রকৃতির ভারসাম্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

তথ্যসূত্র :

Cornell Lab of Ornithology

National Geographic

Smithsonian’s National Zoo & Conservation Biology Institute – Snowy Owl Profile

Audubon Society – Snowy Owl Conservation and Irruption Patterns

Encyclopedia of Life (EOL) – Bubo scandiacus

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments