ছোট সোনা মসজিদ: বাংলার এক অনন্য নিদর্শন
বাংলার প্রাচীন স্থাপত্য ঐতিহ্যের অন্যতম উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার গোমস্তাপুর উপজেলায় অবস্থিত ছোট সোনা মসজিদ। এই মসজিদটি গৌড়-লখনৌতির ইতিহাসের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত এবং সুলতানি আমলের স্থাপত্য শৈলীর এক বিরল নিদর্শন হিসেবে আজও গবেষকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
এটি বাংলার মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত, যেখানে গৌড়ীয় শৈলী, সূক্ষ্ম অলঙ্করণ এবং গ্রানাইট পাথরের ব্যবহার এক অনন্য সৌন্দর্য প্রকাশ করে। ১৫শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এটি নির্মিত হয়েছিল এবং এর সোনালি চুনকাম বা পলিশ করা ইটের কারণে স্থানীয় জনগণ একে “সোনা মসজিদ” নামে ডাকত। তুলনামূলক আকারে ছোট হওয়ায় এটি আজও পরিচিত “ছোট সোনা মসজিদ” নামে।
নামকরণ
ছোট সোনামসজিদ ‘সুলতানি স্থাপত্যের রত্ন’ বলে আখ্যাত। এর বাইরের দিকে সোনালি রং এর আস্তরণ ছিল, সূর্যের আলো পড়লে এ রং সোনার মতো ঝলমল করত। প্রাচীন গৌড়ে আরেকটি মসজিদ ছিল যা বড় সোনা মসজিদ নামে পরিচিত। এটি তৈরি করেছিলেন সুলতান নুসরত শাহ। সেটি ছিল আরও বড়। তাই স্থানীয় লোকজন এটিকে ছোট সোনা মসজিদ বলে অবহিত করতো, আর গৌড় নগরীর মসজিদটিকে বলতো বড় সোনা মসজিদ।
মসজিদের ইতিহাস
ছোট সোনা মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। বেশিরভাগ গবেষক একমত যে এটি বাংলার ইলিয়াস শাহি বংশের সময়ে (১৫শ শতাব্দী) নির্মিত হয়েছিল। মসজিদের শিলালিপি থেকে জানা যায়, সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহের শাসনামলে (১৪৯৪–১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ) এটি নির্মিত হয়। এই মসজিদটি গৌড় নগরীর সুলতানি স্থাপত্যের অংশ এবং ধারণা করা হয়, এটি ছিল রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গুরুত্বপূর্ণ একটি ধর্মীয় স্থাপনা। মুসলিম স্থাপত্যে গৌড়কে বলা হয়েছিল “বাঙলার তাজ”, যেখানে অসংখ্য মসজিদ, মাদ্রাসা, সমাধি ও প্রাসাদ গড়ে উঠেছিল।
ছোট সোনা মসজিদ নির্মাণ করেন ওলি মুহাম্মদ বিন আলাউদ্দিন হোসেন শাহ, যিনি সুলতানের একজন অভিজাত আমলা ছিলেন। মসজিদের মূল উদ্দেশ্য ছিল নামাজ আদায়ের পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষা ও সম্প্রদায়ের মিলনস্থল তৈরি করা। তবে শিলালিপিতে নির্মাণের সঠিক তারিখ সম্বলিত অক্ষরগুলি মুছে যাওয়ায় নির্মাণকাল জানা যায়নি। এটি কোতোয়ালী দরজা থেকে মাত্র ৩ কি.মি. দক্ষিণে। মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। এটি হোসেন-শাহ স্থাপত্য রীতিতে তৈরি।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
(ক) গঠন ও উপাদান
ছোট সোনা মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য হলো: হোসেন শাহী স্থাপত্যরীতিতে নির্মিত, বাইরে সোনার মতো ঝলমলে সোনালী আস্তরণযুক্ত, ভিতরের ১৫টি গম্বুজযুক্ত ইউনিট ও চৌচালা ভল্ট, এবং সুলতানি স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন হিসেবে এর পরিচিতি।
সোনালী আস্তরণ: এর বাইরের দেওয়ালে সোনালী রঙের আস্তরণ ছিল, যা সূর্যের আলোয় সোনার মতো ঝলমল করত। একারণেই এর নাম হয়েছিল ‘ছোট সোনা মসজিদ’। মসজিদটি আয়তাকার, প্রায় ২৫.১০ মিটার লম্বা এবং ১৫.৯০ মিটার চওড়া। এর মোট ১৫টি গম্বুজ রয়েছে—যার মধ্যে তিনটি সারি করে প্রত্যেকটিতে পাঁচটি গম্বুজ। গম্বুজগুলো ছোট আকারের হলেও স্থাপত্যশৈলীতে অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিন্যস্ত।
হোসেন শাহী রীতি: মসজিদটি সুলতানি স্থাপত্যের হোসেন শাহী রীতিতে নির্মিত, যা বাংলার মুসলিম স্থাপত্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
(খ) প্রবেশপথ ও দেয়াল
ছোট সোনা মসজিদের মূল প্রবেশপথ পূর্বদিকে এবং এটি একটি আয়তাকার নকশার, যার চারদিকে রয়েছে প্রায় ৬ ফুট পুরু পাথরের দেয়াল। এই দেয়ালগুলোর বাইরে ও ভেতরে পাথরের অলংকরণ দেখা যায় এবং দেয়ালের ভেতরে খিলানের কাজ রয়েছে। মসজিদের পশ্চিম দিকে একটি বড় দরজা রয়েছে যেখানে নকশা করা পাঁচটি মিহরাব বা খিলান দেখা যায়।
প্রবেশপথের বিবরণ
অবস্থান ও নকশা: মসজিদের মূল প্রবেশপথটি পূর্ব দিকে অবস্থিত। এটি একটি আয়তাকার নকশার প্রবেশপথ।
শিলালিপি: প্রবেশপথের ঠিক উপরে একটি শিলালিপি রয়েছে, যা থেকে জানা যায় যে এটি সুলতান আলাউদ্দিন হুসেন শাহের শাসনামলে জনৈক মনসুর ওয়ালী মুহম্মদ বিন আলী নির্মাণ করেন।
অলঙ্করণ: প্রবেশপথের দেয়ালগুলোতে পাথরের নকশা ও খোদাইয়ের কাজ রয়েছে।
দেয়ালের বিবরণ
গঠন: মসজিদটির দেয়ালগুলো মূলত ইটের তৈরি।
পুরুত্ব: দেয়ালগুলো বেশ পুরু এবং প্রায় ৬ ফুট পুরুত্বে নির্মিত।
আচ্ছাদন: দেয়ালগুলোর ভেতরে ও বাইরে পাথর দিয়ে ঢাকা রয়েছে, যা এটিকে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
প্রবেশদ্বার: মসজিদের পূর্ব দিকের প্রধান প্রবেশপথের বিপরীতে, পশ্চিম দিকের দেয়ালে নকশা খচিত পাঁচটি
(গ) অলঙ্করণ শৈলী
পুরো মসজিদের অলংকরণে মূলত পাথর, ইট, টেরাকোটা ও টাইল ব্যবহার করা হয়েছে। এদের মাঝে পাথর খোদাই এর কাজই বেশি। মসজিদের সম্মুখভাগ, বুরুজসমূহ, দরজা প্রভৃতি অংশে পাথরের উপর অত্যন্ত মিহি কাজ রয়েছে, যেখানে লতাপাতা, গোলাপ ফুল, ঝুলন্ত শিকল, ঘণ্টা ইত্যাদি খোদাই করা আছে। ফ্যাসাদগুলোতে দুই সারিতে প্যানেলের কাজ রয়েছে, নিচেরগুলো উপরের প্যানেলগুলোর চাইতে আকারে বড়।
দরজাগুলোর মাঝের অংশে এই প্যানেলগুলো অবস্থিত। দরজাগুলো অলংকরণযুক্ত চতুষ্কোণ ফ্রেমে আবদ্ধ। খিলানগুলো পাথর খোদাই এর অলংকরণযুক্ত। দুটি খিলানের মধ্যভাগেও পাথরের অলংকরণ রয়েছে। মাঝের দরজাটির উপরে একটি শিলালিপি পাওয়া যায়। ক্রেইটন ও কানিংহামের বর্ণনা থেকে জানা যায়, একসময় বাইরের দিকে পুরো মসজিদটির উপর সোনালি রঙের আস্তরণ ছিল, মতান্তরে কেবল গম্বুজগুলোর ওপর। গম্বুজগুলোর অভ্যন্তরভাগ টেরাকোটা সমৃদ্ধ।
(ঘ) গম্বুজ ও মিনার
১৫টি গম্বুজ ছাড়াও মসজিদের চার কোণায় চারটি অষ্টভুজাকৃতি মিনার রয়েছে। মসজিদের অভ্যন্তরে মোট ১৫টি ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে ৩টি ইউনিট চৌচালা ভল্ট দ্বারা আচ্ছাদিত এবং ১২টি বর্গাকার ইউনিট উল্টানো টাম্বলার আকৃতির গম্বুজ দ্বারা আবৃত। এগুলো উপরে ক্রমশ সরু হয়ে গিয়ে ছোট ছোট গম্বুজ দিয়ে সমাপ্ত।
নামকরণের কারণ
“সোনা মসজিদ” নামের পেছনে একটি বিশেষ ঐতিহাসিক কারণ রয়েছে। মসজিদের দেয়াল ও গম্বুজগুলো একসময় সোনালি চুনকাম বা পলিশ করা ছিল, যা রোদে ঝলমল করত। দূর থেকে দেখলে মনে হতো যেন এটি সোনার তৈরি। এজন্যই মসজিদটি “সোনা মসজিদ” নামে পরিচিতি পায়। পরে এর আকারে তুলনামূলক ক্ষুদ্রতার কারণে এটিকে “ছোট সোনা মসজিদ” বলা হয়, যাতে এটি গৌড়ের অন্য বড় সোনা মসজিদ থেকে আলাদা করা যায়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ছোট সোনা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি বাংলার সুলতানি স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন। এটি প্রমাণ করে যে ১৫শ শতাব্দীতে বাংলার মুসলিম সমাজে শিল্প-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় জীবনের বিকাশ কতটা সমৃদ্ধ ছিল। গৌড় নগরী যখন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী ছিল, তখন এই মসজিদটি ছিল এক কেন্দ্রবিন্দু। বর্তমান সময়ে এটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা হিসেবে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হতে পারে।
সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা
১৯০৯ সালে ব্রিটিশ সরকার এই মসজিদটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। মসজিদটি এখনও অটুট এবং স্থানীয় জনগণ ও পর্যটকদের জন্য আকর্ষণের কেন্দ্র। যদিও কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তবুও মসজিদটির মূল কাঠামো অক্ষত রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর নিয়মিত এর সংরক্ষণ ও সংস্কারের কাজ করে থাকে।
পর্যটন আকর্ষণ
ছোট সোনা মসজিদে প্রতিবছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক ভ্রমণে আসেন। গৌড়-লখনৌতির অন্যান্য স্থাপনার সাথে এটি ভ্রমণকারীদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়। পর্যটকেরা এখানে এসে মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের অনন্য শৈলী উপভোগ করেন। আশেপাশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন যেমন দারাসবাড়ি মসজিদ, ফতেপুর দরগাহ, এবং কুতুব শাহী মসজিদের সাথেও একে ঘুরে দেখা যায়।
শিল্প ও স্থাপত্য বিশ্লেষণ
ছোট সোনা মসজিদ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এটি সুলতানি আমলের গৌড়ীয় স্থাপত্যের নিখুঁত উদাহরণ। এখানে দৃষ্টিগোচর হয় ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যশৈলী। গম্বুজ, খিলান, মিহরাব এবং মিনারগুলো পারস্য ও তুর্কি শৈলীর প্রভাব বহন করে। একইসাথে বাংলার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য যেমন ফুলেল ও জ্যামিতিক অলঙ্করণ স্পষ্ট। এটি মূলত এক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন, যেখানে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী স্থাপত্য বাংলার নিজস্ব শিল্পকলার সাথে মিলেমিশে এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিল।
ছোট সোনা মসজিদের প্রাসঙ্গিকতা
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে ছোট সোনা মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। এটি মধ্যযুগীয় বাংলার মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চিত্র উপস্থাপন করে। এটি বাংলার প্রাচীন নগর গৌড়ের গৌরবময় ঐতিহ্যের এক জীবন্ত সাক্ষী। আধুনিক স্থপতি ও ইতিহাসবিদরা এখনও এর নকশা ও অলঙ্করণ থেকে অনুপ্রাণিত হন।
ছোট সোনা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি বাংলার সুলতানি যুগের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রতিফলন। এই মসজিদ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে মধ্যযুগীয় বাংলায় ইসলাম শুধু ধর্মীয় চর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এর সঙ্গে ছিল স্থাপত্য, শিল্পকলা এবং নগরজীবনের এক সমন্বিত রূপ।
এই স্থাপনাটি প্রমাণ করে যে বাংলার কারিগররা কতটা দক্ষ ছিলেন। তারা মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী স্থাপত্যশৈলীকে নিজেদের মাটির সঙ্গে মিশিয়ে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছিলেন, যা আজ “বাংলা সুলতানি স্থাপত্য” নামে পরিচিত। ছোট সোনা মসজিদে আমরা সেই ধারার সর্বোত্তম প্রকাশ দেখতে পাই।
এ মসজিদ বাংলার গৌড় নগরীর ঐতিহ্যকে অমর করেছে। আজ গৌড় শহর বিলীন হয়ে গেলেও ছোট সোনা মসজিদ এখনও দাঁড়িয়ে আছে অতীতের স্মৃতি বুকে নিয়ে। এটি প্রমাণ করে যে সভ্যতা হারিয়ে গেলেও এর সৃষ্টিকর্ম অমর হয়ে থাকতে পারে।
বর্তমান সময়ে ছোট সোনা মসজিদ বাংলাদেশের পর্যটন ও প্রত্নতাত্ত্বিক গর্বের প্রতীক। এটি শুধু দেশীয় পর্যটকদের কাছেই নয়, আন্তর্জাতিক গবেষক ও ভ্রমণকারীদের জন্যও আকর্ষণের কেন্দ্র। এ কারণে এর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এক কথায়, ছোট সোনা মসজিদ বাংলার ইতিহাস, শিল্প ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ। এটি আমাদের অতীতের গৌরবের স্মারক, বর্তমানের সাংস্কৃতিক পরিচয়, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।
তথ্যসূত্র
আহমেদ, নাজমা খাতুন। বাংলার সুলতানি স্থাপত্য। ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০৫।
ইসলাম, সাইফুদ্দীন। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। ঢাকা: প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ২০১০।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার। ছোট সোনা মসজিদ পরিচিতি পুস্তিকা।
Dani, Ahmad Hasan. Islamic Architecture: The Mosque. UNESCO, 1986.