রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল
আফ্রিকার উষ্ণ বনাঞ্চলের পাখিজগতের এক দুর্দান্ত সদস্য হলো রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল,(Silver-cheeked Hornbill) যার বৈজ্ঞানিক নাম Bycanistes brevis। এটি হর্নবিল পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্যপূর্ণ প্রজাতি। এর গলার রূপালী পালক, বিশাল ঠোঁট, উচ্চ কণ্ঠ এবং গাছে গাছে ডানা মেলে বিচরণ করা যেন প্রকৃতির এক চলমান শিল্পকর্ম। পূর্ব আফ্রিকার পার্বত্য বনাঞ্চলজুড়ে এই পাখিটির অবস্থান লক্ষ্য করা যায়, বিশেষ করে কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, মালাউই এবং মোজাম্বিকের উপকূলবর্তী অঞ্চলে। এই পাখিটির দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য এবং জোরালো ডাক একে প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তুলেছে।
বাহ্যিক গঠন ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য
রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল একটি বড় আকৃতির পাখি। পূর্ণবয়স্ক একটি পাখির দৈর্ঘ্য গড়ে ৭৫ -৮০ সেন্টিমিটার (৩০ থেকে ৩১ ইঞ্চি) এবং ওজন প্রায় ১-১.৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। এদের দেহের পালক মূলত কালো, তবে ঘাড় ও গালের চারপাশে থাকে রূপালি বা ধূসর পালকের একটি স্তর, যেখান থেকে এর নামকরণ হয়েছে। চোখের চারপাশে সাদা বা হালকা ছাই রঙের দাগ থাকে, যা এদের মুখমণ্ডলকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।
এই প্রজাতির আরেকটি দৃষ্টিনন্দন বৈশিষ্ট্য হলো এর ঠোঁটের উপরের বিশাল খাঁজযুক্ত অংশ, যাকে “ক্যাস্ক” (casque) বলা হয়। পুরুষ পাখিদের ক্যাস্ক বড় এবং বেশি গম্বুজাকার, যা স্ত্রী পাখিদের তুলনায় অনেক স্পষ্ট। এটি মূলত হালকা ও ফাঁপা, তবে মনে করা হয় এটি সামাজিক সংকেত ও ডাককে প্রতিধ্বনিত করতে সাহায্য করে।
আবাসস্থল ও পরিবেশ
এই হর্নবিলেরা প্রধানত উঁচু পার্বত্য বনাঞ্চল এবং ট্রপিক্যাল রেইনফরেস্টে বসবাস করে। সাধারণত সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০০০ থেকে ২৫০০ মিটার উচ্চতায় এদের পাওয়া যায়। উঁচু গাছপালায় সমৃদ্ধ এলাকাই এদের বিচরণের প্রিয় স্থান। রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল গাছে গাছে উড়ে বেড়ায় এবং মাঝেমধ্যে নিচে নেমে আসে কিন্তু বেশিরভাগ সময় গাছের উপরেই কাটায়।
আচরণ ও সামাজিকতা
এই হর্নবিলেরা অত্যন্ত সামাজিক প্রকৃতির। এরা সাধারণত জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে থাকে। গাছ থেকে গাছে উড়ে খাদ্য খুঁজে বেড়ানোই এদের প্রধান কার্যকলাপ। প্রজননের মৌসুম ছাড়া অনেক সময় একসাথে ২০-৩০টি পাখির দল গঠিত হয়।
তবে এদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো — ডাক। রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিলের ডাক অনেক দূর পর্যন্ত শোনা যায়, প্রায় এক কিলোমিটার বা তার বেশি দূরেও। এরা “ঘ্যাঁ-ঘ্যাঁ” বা “কা-কা” ধরনের কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে।
খাদ্যাভ্যাস
রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল মূলত ফলভোজী (frugivorous) পাখি, তবে এদের খাদ্য তালিকায় পোকামাকড়, ছোট সরীসৃপ, উভচর ও পাখির ছানাও থাকতে পারে। এরা গাছের ডালে বসে পাকা ফল গিলে ফেলে এবং অনেক সময় গাছের বীজ পরিবহণ করে। এজন্য এদের “বনের বীজ বাহক” বলা হয়ে থাকে, কারণ এইভাবে এরা বনজ উদ্ভিদের বিস্তারে ভূমিকা রাখে।
প্রজনন ও বাসা বানানো
প্রজনন মৌসুমে স্ত্রী হর্নবিল গাছের ফাঁকা কোটরের মধ্যে ডিম পাড়ে এবং সেখানে নিজেকে প্রায় সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ করে ফেলে। সে কাদা, খাবারের অবশিষ্টাংশ ও নিজের মল দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দেয়, শুধু একটি ছোট ফাঁক রেখে দেয় যেন পুরুষটি খাবার পৌঁছে দিতে পারে। স্ত্রী পাখি ডিম দেওয়া থেকে শুরু করে ছানাদের যত্ন নেওয়া পর্যন্ত পুরো সময় গর্তের ভেতরে অবস্থান করে।
এই সময় পুরুষ হর্নবিলটি একাই খাবার সংগ্রহ করে স্ত্রী ও ছানাদের খাওয়ায়। ছানারা বড় হলে এবং পালক গজালে স্ত্রী হর্নবিল গর্ত ভেঙে বের হয়ে আসে এবং তখন উভয় পিতামাতা মিলে ছানাদের যত্ন নিতে থাকে।
সংরক্ষণ ও হুমকি
রূপালী-গালযুক্ত হর্নবিল বর্তমানে IUCN-এর “Least Concern” (সামান্য উদ্বেগ) তালিকায় থাকলেও এদের সংখ্যা কিছু কিছু অঞ্চলে হ্রাস পাচ্ছে। বন ধ্বংস, কৃষি সম্প্রসারণ ও গাছ কাটার ফলে এদের বাসস্থান সংকুচিত হচ্ছে। বিশেষত আফ্রিকার কিছু অঞ্চলে বনভূমি কমে যাওয়ায় হর্নবিল প্রজাতিগুলো হুমকির মুখে পড়ছে।
তবে এখনো পূর্ব আফ্রিকার বিস্তীর্ণ বনভূমিতে এদের একটি শক্তিশালী জনসংখ্যা টিকে আছে। সংরক্ষিত বনাঞ্চল এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে এদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
তথ্যসূত্র:
আফ্রিকান বার্ড ক্লাব
IUCN Red List – Bycanistes brevis
হেলম ফিল্ড গাইড: Birds of East Africa
Cornell Lab of Ornithology – Macaulay Library
ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক আফ্রিকান পাখি সংকলন