সাসানীয় সাম্রাজ্যবাদ
সাসানীয় সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন ইরানের শেষ মহান সাম্রাজ্য যা ইসলামী বিজয়ের আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এটি ২২৪ খ্রিস্টাব্দে আরদাশির প্রথম (Ardashir I) পার্থিয়ান সাম্রাজ্যকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন এবং ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে আরব মুসলিম বাহিনীর হাতে পতিত হয়। এই সাম্রাজ্যকে অনেক ইতিহাসবিদ “প্রাচীন পারস্যের পুনর্জন্ম” হিসেবে দেখেন, কারণ এটি আখেমেনীয় সাম্রাজ্যের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করেছিল। রাজধানী ছিল প্রথমে সেসিফন (Ctesiphon) এবং পরে বিভিন্ন সময়ে অন্যান্য শহরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে কাজ করত।
নামকরণ
সরকারিভাবে সাসানীয় সাম্রাজ্যকে বলা হতো “ইরানিদের সাম্রাজ্য” (মধ্য পার্সীয়: 𐭠𐭩𐭥𐭠𐭭𐭱𐭲𐭥𐭩 Ērānšahr; পার্থীয়: 𐭀𐭓𐭉𐭀𐭍𐭇𐭔𐭕𐭓 Aryānxšahr; গ্রিক: Ἀριανῶν ἔθνος Arianōn Ethnos)। এই শব্দটির প্রথম প্রমাণ পাওয়া যায় শাপুর I-এর তিনভাষিক কাবা-য়ে জারতুশ্ত অভিলেখে। সেখানে তিনি ঘোষণা করেন: “আমি ইরানিদের সাম্রাজ্যের অধিপতি। তবে প্রচলিতভাবে, এই সাম্রাজ্য এবং সাসানীয় রাজবংশ উভয়কেই সাসান-এর নামে চিহ্নিত করা হয়। ইংরেজিতে এই নাম বিভিন্নভাবে লেখা হয়েছে, যেমন: Sassanian Empire, Sasanid Empire এবং Sassanid Empire।
সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা
সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হলেন প্রথম আরদাশির (Ardashir I)। তিনি ২২৪ খ্রিস্টাব্দে সাসানীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন এবং আর্শাকীয় বা পার্থিয়ান সাম্রাজ্যের পতনের পর ইরানের শাসনভার গ্রহণ করেন।
সাসানীয় রাজবংশের সূচনা ঘটে পার্সিস (বর্তমান ফারস প্রদেশ) অঞ্চলে। আরদাশির প্রথম, যিনি একজন স্থানীয় শাসকের পুত্র ছিলেন, পার্থিয়ানদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে শেষ পার্থিয়ান রাজা আর্টাবানাস চতুর্থকে পরাজিত করেন। এরপর তিনি নিজেকে “শাহান শাহ” (রাজাদের রাজা) উপাধি প্রদান করেন। সাসানীয় শাসকরা কেন্দ্রীয় প্রশাসন, কঠোর করব্যবস্থা এবং একনায়কতান্ত্রিক রাজশক্তির উপর গুরুত্ব দেন। রাজা ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী এবং তার শাসন দেবতাসম মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিল। রাজপরিবার সাসান দেবতার বংশধর দাবি করত, যা তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বৈধতা দিত।
ভূখণ্ড ও প্রভাব
সাসানীয় সাম্রাজ্য (২২৪-৬৫১ খ্রিষ্টাব্দ) প্রাচীন ইরানকে কেন্দ্র করে বিস্তৃত ছিল এবং এর ভূখণ্ড বর্তমান ইরান, ইরাক, সিরিয়া, ককেশাস, মধ্য এশিয়া এবং উত্তর-পশ্চিম ভারত পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এর প্রভাব শুধু ভূখণ্ডের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পশ্চিম ইউরোপ, পূর্ব আফ্রিকা, চীন ও ভারতের মতো দূরবর্তী অঞ্চলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছিল এবং ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যযুগীয় শিল্পকলা, স্থাপত্য ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। পশ্চিমে রোমান ও পরবর্তীতে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের সাথে প্রায় ধারাবাহিক যুদ্ধ চলত। এই সংঘর্ষগুলোকে রোম–সাসানীয় যুদ্ধ বলা হয়, যা ৪০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলে এবং ভূমধ্যসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করেছিল।
প্রশাসন ও সমাজ
সাসানীয় সাম্রাজ্যের প্রশাসন ছিল একটি জটিল ও কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্র, যা জরথুষ্ট্রবাদকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ব্যবহার করে ঐক্য ও বৈধতা নিশ্চিত করত। সামাজিক কাঠামো ছিল বর্ণপ্রথা নির্ভর, যেখানে পুরোহিত, যোদ্ধা, লেখক এবং কৃষক—এই চারটি শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল সমাজ। সাম্রাজ্যটি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও বিশ্বাসকে সহ্য করত এবং শিল্প, স্থাপত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপক পৃষ্ঠপোষকতা করত। সাসানীয় প্রশাসন ছিল অত্যন্ত সংগঠিত। সাম্রাজ্যটি বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিল, প্রতিটির শাসক ছিলেন রাজদরবার কর্তৃক নিযুক্ত গভর্নর। করব্যবস্থা উন্নত ছিল, কৃষি ও বাণিজ্য থেকে বিপুল রাজস্ব আসত।
সাসানীয় সমাজ চারটি প্রধান শ্রেণীতে বিভক্ত ছিল:
পুরোহিত: এরা বিশাল রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করত এবং সমাজের উচ্চ স্তরের অন্তর্ভুক্ত ছিল।
যোদ্ধা: এরা সামরিক শক্তি এবং সাম্রাজ্যের সুরক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।
লেখক: এরা প্রশাসন এবং জ্ঞানচর্চার সাথে যুক্ত ছিল।
কৃষক: এরা সমাজের বৃহত্তম অংশ ছিল এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখত।
ধর্ম ও সংস্কৃতি
সাসানীয় সাম্রাজ্যের রাষ্ট্রধর্ম ছিল জরথুস্ত্রবাদ (Zoroastrianism)। আহুরা মজদা ছিলেন প্রধান দেবতা এবং অগ্নিমন্দির ছিল ধর্মীয় জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। ধর্মীয় নেতারা রাজনীতিতে বড় ভূমিকা রাখতেন এবং ধর্মীয় শুদ্ধতা বজায় রাখতে কড়া নিয়ম আরোপ করা হতো। তবে ইহুদি, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ এবং মানিখেয় সম্প্রদায়ও সাম্রাজ্যে বসবাস করত, যদিও কখনও কখনও ধর্মীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছে।
সংস্কৃতির ক্ষেত্রে সাসানীয়রা শিল্প, স্থাপত্য ও সাহিত্য বিকাশে অবদান রাখে। বিশাল প্রাসাদ, পাথরের রিলিফ, গম্বুজযুক্ত স্থাপনা এবং সূক্ষ্ম অলঙ্কৃত ধাতবপাত্র তাদের কারুশিল্পের উৎকর্ষ প্রদর্শন করে। শাহনামা-তে পরবর্তী কালে সংরক্ষিত অনেক কিংবদন্তি এই সময়ের বীরদের ঘিরে গড়ে উঠেছিল।
অর্থনীতি ও বাণিজ্য
সাসানীয়রা সিল্ক রোড বাণিজ্যের প্রধান অংশীদার ছিল। তারা চীন, ভারত, মধ্য এশিয়া এবং রোমান সাম্রাজ্যের সাথে বাণিজ্য করত। রেশম, মসলা, রত্ন, ধাতবপাত্র, এবং সুগন্ধি ছিল প্রধান রপ্তানি পণ্য। পারস্য উপসাগর এবং আরব সাগরের বন্দরগুলো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। সাসানীয় সাম্রাজ্যের অধিকাংশ জনগণ কৃষক হওয়ায় অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল কৃষিকাজ ও চাষাবাদ। খুজিস্তান ও ইরাক ছিল এই খাতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশ।
নাহরাভান খাল ছিল সাসানীয় সেচব্যবস্থার অন্যতম শ্রেষ্ঠ উদাহরণ, যার অনেক নিদর্শন এখনো ইরানে বিদ্যমান। পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে বসবাসকারী যাযাবরদের মাধ্যমে কাঠ সংগ্রহ হতো। সাসানীয় শাসনব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভিত্তিক হওয়ায় এই যাযাবর ও পাহাড়ি অধিবাসীদের ওপর কর আরোপ সম্ভব হয়েছিল। খসরু প্রথম-এর শাসনামলে আরও জমি কেন্দ্রীয় শাসনের আওতায় আনা হয়।
সাসানীয় যুগে দুটি বাণিজ্যপথ ব্যবহৃত হতো: একটি ছিল উত্তরে, বিখ্যাত সিল্ক রুট; আরেকটি অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত, দক্ষিণ উপকূল ঘেঁষা পথ। Susa, Gundeshapur ও Shushtar-এর কারখানাগুলো রেশম উৎপাদনের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল এবং এগুলো চীনা কারখানার সমকক্ষ ছিল। সাসানীয় শাসকেরা গ্রামাঞ্চলের জনগণের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করতেন, যার ফলে দুর্ভিক্ষের সময় খাদ্য মজুদ রাখা সম্ভব হতো।
সামরিক শক্তি
সাসানীয় সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তি ছিল তার স্থায়ী সেনাবাহিনী, বিশেষ করে অশ্বারোহী ক্যাটাফ্র্যাক্ট (cavalry) এবং পদাতিক বাহিনীর সমন্বিত শক্তির উপর নির্ভরশীল। প্রথম আরদাশিরের অধীনে শক্তিশালী, ব্যক্তিগতভাবে নিয়ন্ত্রিত সেনাবাহিনীর মাধ্যমে সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপিত হয়, যা পরবর্তীতে রোমানদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে এবং তাদের সামরিক পদ্ধতিকেও প্রভাবিত করে। সাসানীয় সেনাবাহিনী ছিল অত্যন্ত প্রশিক্ষিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। ভারী অশ্বারোহী সৈন্য (Cataphracts), ধনুকধারী অশ্বারোহী এবং দুর্গ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় তারা দক্ষ ছিল। রোমান ও বাইজান্টাইনদের সঙ্গে সমানতালে যুদ্ধ করার মতো শক্তি ছিল তাদের।
পতন
সপ্তম শতাব্দীর প্রথম দিকে সাসানীয় সাম্রাজ্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, অভিজাত শ্রেণির বিভাজন, অর্থনৈতিক সংকট এবং ধারাবাহিক যুদ্ধের চাপে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৬০২–৬২৮ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইনের সাথে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের ফলে সাম্রাজ্যের সম্পদ ক্ষয় হয়। ৬৩৩ খ্রিস্টাব্দে আরব মুসলিম বাহিনী আক্রমণ শুরু করে এবং ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে শেষ সাসানীয় রাজা ইয়াজদেগার্দ তৃতীয় নিহত হন। এভাবে সাসানীয় সাম্রাজ্যের অবসান ঘটে এবং অঞ্চলটি ইসলামী খেলাফতের অধীনে চলে যায়। এই পতনের পেছনে ছিল যুদ্ধবিগ্রহের কারণে সৃষ্ট দুর্বলতা, অর্থনৈতিক সংকট, এবং প্লেগের মতো মহামারী।
উত্তরাধিকার
যদিও রাজনৈতিকভাবে সাসানীয় সাম্রাজ্য বিলুপ্ত হয়েছিল, এর সাংস্কৃতিক প্রভাব শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে ছিল। ইসলামী যুগে পারস্যের প্রশাসনিক কাঠামো, সাহিত্যিক ঐতিহ্য এবং শিল্পরীতি ব্যাপকভাবে গ্রহণ করা হয়। সাসানীয় যুগকে অনেক ইতিহাসবিদ “ইরানি জাতীয় পরিচয়ের স্বর্ণযুগ” হিসেবে অভিহিত করেন।
সাসানীয় সাম্রাজ্য শুধু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক সত্তা নয়, বরং শিল্প, সংস্কৃতি, ধর্ম ও প্রশাসনে অসামান্য অবদান রেখেছিল। এটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সাম্রাজ্য হিসেবে ইতিহাসে অমর হয়ে আছে।
সাসানীয় সাম্রাজ্য ছিল প্রাচীন ইরানের ঐতিহাসিক একটি বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি পার্থিয়ানদের পরের সময়কালের রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছিল। তার কঠোর প্রশাসনিক কাঠামো, সমৃদ্ধ শিল্প-সংস্কৃতি এবং ধারাবাহিক রোম–সাসানীয় সংঘর্ষ প্রাচীন বিশ্বের ইতিহাসকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। যদিও এটি আরব মুসলিম বিজয়ে পতিত হয়, সাসানীয় যুগের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি পরবর্তী যুগেও ইরানি ও মধ্যপ্রাচ্যের সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীর প্রভাব ফেলে গেছে।
তথ্যসূত্র
Encyclopaedia Britannica, “Sasanian Empire”
Frye, Richard N. The History of Ancient Iran
Daryaee, Touraj. Sasanian Persia: The Rise and Fall of an Empire
Greatrex, Geoffrey & Lieu, Samuel N.C. The Roman Eastern Frontier and the Persian Wars
Gignoux, Philippe. Zoroastrianism in the Sasanian Empire