সাফাভি সাম্রাজ্যের ইতিহাস
সাফাভি সাম্রাজ্য (১৫০১–১৭৩৬ খ্রি.) পারস্য তথা আধুনিক ইরানের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি শুধু একটি রাজনৈতিক শক্তিই ছিল না, বরং ধর্ম, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে অসাধারণ প্রভাব বিস্তার করেছিল। সাফাভিদের মাধ্যমে ইরান একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, যেখানে শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।
সাফাভি সাম্রাজ্যের শাহ ইসমাইল এর শাসনকাল
সাফাভি সাম্রাজ্যের উৎপত্তি মূলত একটি সুফি তরিকার হাত ধরে। এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন ইসমাইল প্রথম (শাহ ইসমাইল, শাসনকাল: ১৫০১–১৫২৪)। তিনি সাফাভিয়া নামক সুফি সম্প্রদায়ের নেতা ছিলেন এবং আজারবাইজান ও উত্তর-পশ্চিম ইরান অঞ্চলে সমর্থন অর্জন করেছিলেন। ১৫০১ সালে তিনি তাবরিজে নিজেকে শাহ ঘোষণা করেন এবং দ্রুত পারস্যের বিশাল অংশ দখল করেন। শাহ ইসমাইল পারস্যকে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেন এবং দ্বাদশী শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। এর ফলে পারস্যের ধর্মীয় পরিচয় সুন্নি অটোমান সাম্রাজ্য ও সুন্নি উজবেক শায়বানিদের থেকে আলাদা হয়ে দাঁড়ায়।
রাজনৈতিক কাঠামো
সাফাভি সাম্রাজ্য একটি কেন্দ্রভিত্তিক রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ছিল। শাহ ছিলেন সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সামরিক বাহিনী ও প্রশাসনে কিজিলবাশ নামে পরিচিত তুর্কি উপজাতি যোদ্ধাদের বিশেষ ভূমিকা ছিল। তবে পরবর্তী সময়ে শাহ আব্বাস প্রথম (শাসনকাল: ১৫৮৮–১৬২৯) একটি স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন, যেখানে দাস সৈন্য (গুলাম) অন্তর্ভুক্ত ছিল। এর ফলে কিজিলবাশদের প্রভাব সীমিত হয় এবং শাহের ক্ষমতা আরও দৃঢ় হয়।
ধর্মীয় রূপান্তর
সাফাভিদের অন্যতম বড় অবদান হলো পারস্যকে শিয়া ইসলামের কেন্দ্রবিন্দুতে রূপান্তরিত করা। ইসমাইল প্রথম রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে শিয়া মতবাদ চাপিয়ে দেন এবং এর প্রচার জোরদার করেন। বহু সুন্নি আলেম দেশত্যাগ করেন, আবার অনেককে শিয়া মতবাদ গ্রহণে বাধ্য করা হয়। এই ধর্মীয় পরিবর্তন শুধু পারস্যের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং পরবর্তী শতাব্দীতে শিয়া বিশ্বের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তি স্থাপন করে।
সাংস্কৃতিক ও শিল্পকলা
সাফাভি যুগকে পারস্য সংস্কৃতির সোনালি যুগ বলা হয়। শিল্প, স্থাপত্য, কারুশিল্প, বস্ত্র ও সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই এর সমৃদ্ধি দেখা যায়।
স্থাপত্য: শাহ আব্বাস প্রথমের সময় ইসফাহান শহর নতুন রাজধানী হিসেবে গড়ে তোলা হয়। সেখানে নির্মিত শাহ মসজিদ, শেখ লুতফুল্লাহ মসজিদ, আলী কপু প্রাসাদ ও বিস্তীর্ণ ময়দান (নকশে জাহান স্কোয়ার) আজও বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
কারুশিল্প: সাফাভি যুগে পারস্য গালিচা শিল্প বিশ্বজুড়ে প্রসিদ্ধি পায়। সূক্ষ্ম নকশা, রঙের সমন্বয় ও গুণগত মানের কারণে এই গালিচাগুলো ইউরোপে অত্যন্ত মূল্যবান ছিল।
সাহিত্য ও চিত্রকলা: কবিতা, মিনিেচার চিত্রকলা ও ক্যালিগ্রাফি বিকশিত হয়।
অর্থনীতি ও বাণিজ্য
সাফাভি সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল কৌশলগত। এটি ছিল পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যবর্তী এক গুরুত্বপূর্ণ সেতুবন্ধন। সিল্ক রোডের প্রধান অংশ এর মধ্য দিয়ে গিয়েছিল। বিশেষ করে রেশম রপ্তানি সাম্রাজ্যের প্রধান আয়ের উৎস ছিল। শাহ আব্বাস প্রথম ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন, যাতে অটোমান সাম্রাজ্যের প্রভাব মোকাবিলা করা যায়।
অটোমান ও মুঘলদের সঙ্গে সম্পর্ক
সাফাভিরা তিন দিক থেকে চাপের মুখে ছিল—
পশ্চিমে অটোমান সাম্রাজ্য (সুন্নি শক্তি)
পূর্বে উজবেক শায়বানিরা
দক্ষিণ-পূর্বে ভারতীয় মুঘল সাম্রাজ্য
অটোমানদের সঙ্গে দীর্ঘকালীন যুদ্ধ হয়েছিল। ১৫১৪ সালের চালদিরান যুদ্ধে সাফাভিরা পরাজিত হয়, ফলে অটোমানরা পূর্ব আনাতোলিয়া ও ইরাক দখল করে। তবে শাহ আব্বাস প্রথম দক্ষ কৌশলের মাধ্যমে অনেক হারানো ভূখণ্ড পুনরুদ্ধার করেন। মুঘল সাম্রাজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল জটিল—কখনো কূটনৈতিক, আবার কখনো সীমান্ত সংঘর্ষ। বিশেষ করে কন্দহার অঞ্চল নিয়ে বারবার দ্বন্দ্ব দেখা দেয়।
সাফাভি বংশের পতনের কারণ
সাফাভি সাম্রাজ্য সপ্তদশ শতকের পর ধীরে ধীরে দুর্বল হতে শুরু করে। প্রধান কারণগুলো ছিল:
দুর্বল শাসক ও রাজদরবারের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র
অর্থনৈতিক সংকট, বিশেষ করে ইউরোপীয় শক্তিদের সমুদ্রপথে বাণিজ্য শুরু হওয়ায় সিল্ক রোডের গুরুত্ব হ্রাস
সামরিক শক্তির অবক্ষয়
অটোমান ও আফগান আক্রমণ
অবশেষে ১৭২২ সালে আফগান গিলজাই উপজাতিরা ইসফাহান দখল করে। সাম্রাজ্য কার্যত ভেঙে পড়ে এবং ১৭৩৬ সালে নাদির শাহ নিজেকে নতুন শাসক ঘোষণা করলে সাফাভি সাম্রাজ্যের আনুষ্ঠানিক অবসান ঘটে।
উত্তরাধিকার
সাফাভি সাম্রাজ্য আধুনিক ইরানের জাতীয় পরিচয় ও রাজনৈতিক কাঠামোর ভিত্তি স্থাপন করে। শিয়া ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া তাদের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব। পাশাপাশি শিল্প, স্থাপত্য ও কারুশিল্পের যে ঐতিহ্য তারা রেখে গেছে, তা আজও বিশ্ব সংস্কৃতির অমূল্য সম্পদ।
সাফাভি সাম্রাজ্য শুধু পারস্যের নয়, গোটা ইসলামী বিশ্বের ইতিহাসে এক বিশেষ অধ্যায়। তারা পারস্যকে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত করে। তাদের অবদান আজও ইরানের সমাজ ও সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রতিফলিত।
তথ্যসূত্র
Roger Savory, Iran under the Safavids, Cambridge University Press, 1980.
Andrew J. Newman, Safavid Iran: Rebirth of a Persian Empire, I.B. Tauris, 2006.
Willem Floor, Safavid Government Institutions, Mazda Publishers, 2001.
Encyclopedia Britannica – “Safavid dynasty”.
Farhad Daftary, A History of Shi‘i Islam, I.B. Tauris, 2013.