Friday, October 3, 2025
Homeপ্রকৃতিরোজি পেলিকান পাখি – এক সৌন্দর্যময় জলচর

রোজি পেলিকান পাখি – এক সৌন্দর্যময় জলচর

রোজি পেলিকান পাখি – এক সৌন্দর্যময় জলচর

রোজি পেলিকান (Roseate Pelican),বা আরও নির্দিষ্টভাবে পরিচিত গ্রেট হোয়াইট পেলিকান (Pelecanus onocrotalus),এক বিশাল আকারের, সৌন্দর্যমণ্ডিত এবং চমৎকার দক্ষ মৎস্য শিকারী পাখি। যদিও “রোজি পেলিকান” নামটি মাঝে মাঝে গোলাপি-আভাযুক্ত পেলিকানদের বোঝাতে ব্যবহৃত হয়,এটি সাধারণত গ্রেট হোয়াইট পেলিকান বা পিঙ্ক-ব্যাকড পেলিকানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এই পাখিটি তার গায়ের হালকা গোলাপি পালক, বিশাল ঠোঁট এবং থলির মতো পাউচের জন্য বিখ্যাত।

শারীরিক বৈশিষ্ট্য:

রোজি পেলিকান দেখতে বেশ বিশাল এবং রাজকীয়। এর দেহের দৈর্ঘ্য প্রায় ১৪০–১৭৫ সেন্টিমিটার, এবং পাখা মেললে ডানার বিস্তার হতে পারে ২৮০ থেকে ৩৫০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত। একটি পূর্ণবয়স্ক পেলিকানের ওজন প্রায় ১০–১৫ কেজি হতে পারে। এদের সবচেয়ে চোখে পড়ার মতো বৈশিষ্ট্য হল বিশাল ঠোঁটটি, যার নিচে থাকে একটি প্রসারযোগ্য থলি—এই থলিটি মাছ ধরার সময় পানিকে ছেঁকে খাবার ধরতে ব্যবহার হয়। ঠোঁটের রঙ সাধারণত হলুদাভ বা গোলাপি রঙের হয়।

পালক সাধারণত সাদা বা হালকা গোলাপি রঙের হয়ে থাকে, যা সূর্যের আলোয় এক অনন্য গোলাপি আভা প্রদান করে। প্রজনন মৌসুমে এদের রঙ আরও উজ্জ্বল এবং আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে।

আবাসস্থল ও বিস্তার:

রোজি পেলিকান মূলত আফ্রিকা, দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপ, পশ্চিম ও দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে দেখা যায়। উপকূলীয় জলাভূমি, হ্রদ, নদী, জলাভূমি ও বৃহৎ জলাধারগুলো এদের প্রিয় আবাসস্থল। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলেও এদের দেখা মেলে।

তবে এরা পরিযায়ী পাখি। শীতের সময় এরা প্রজননের জন্য তুলনামূলক উষ্ণ অঞ্চল যেমন আফ্রিকা বা দক্ষিণ এশিয়ায় চলে আসে এবং বসন্তে আবার ফিরে যায়।

খাদ্যাভ্যাস:

রোজি পেলিকান মূলত মাছ খায়। এরা ঠোঁটের নিচের পাউচ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মাছ ধরার দক্ষ শিকারি। দলবদ্ধভাবে শিকার করাই এদের বিশেষ কৌশল—এরা একটি বৃত্ত তৈরি করে পানিতে সাঁতার কাটে এবং মাছগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে একসাথে ঠোঁট ডুবিয়ে তুলে আনে। এদের প্রতিদিন প্রায় ১.৫–২ কেজি মাছ প্রয়োজন হয়।

কখনো কখনো এরা ছোট উভচর, কাঁকড়া এবং জলজ পোকামাকড়ও খায়, তবে এসব মূল খাদ্য নয়।

প্রজনন ও জীবনচক্র:

রোজি পেলিকান সাধারণত দলবদ্ধভাবে বড় উপনিবেশে বাসা বাঁধে, যা কখনো হাজার হাজার পাখি নিয়ে গঠিত হতে পারে। প্রজনন মৌসুমে পুরুষেরা বিশেষ ভঙ্গিমায় পালক ফুলিয়ে এবং শব্দ করে মেয়ে পাখিদের আকৃষ্ট করে।

মাটিতে বা দ্বীপের ঝোপঝাড়ে বাসা তৈরি করে এবং একবারে সাধারণত ২–৩টি ডিম পাড়ে। উভয় পিতা-মাতা পালাক্রমে ডিমে তা দেয় এবং প্রায় ৩০ দিন পর ছানা ফোটে। ছানাদের খাদ্য পিতামাতা তাদের ঠোঁটের থলি থেকে তুলে দেয়। প্রায় ১০–১২ সপ্তাহের মধ্যে ছানারা উড়তে শেখে।

আচরণ ও বুদ্ধিমত্তা:

রোজি পেলিকান শান্ত প্রকৃতির হলেও বুদ্ধিমান এবং সামাজিক পাখি। এরা দলে থাকতে ভালোবাসে এবং পরস্পরের সঙ্গে সমন্বয় করে চলতে পারে। মাছ শিকার, প্রজনন এবং উড়ার সময় এদের দলবদ্ধ আচরণ অত্যন্ত সংগঠিত ও চমৎকার।
প্রতীকবাদ এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য

সময় এবং ভূগোল জুড়ে মানব সংস্কৃতিতে পেলিকান একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীকী ভূমিকা পালন করেছে। প্রাচীন মিশর থেকে আদিবাসী অস্ট্রেলিয়া এবং খ্রিস্টীয় রূপক থেকে আধুনিক লোগো এবং মাসকট পর্যন্ত, পেলিকানদের সুরক্ষা, ত্যাগ, যত্ন এবং রূপান্তরের প্রতীক হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। তাদের স্বতন্ত্র চেহারা এবং আচরণগুলি পৌরাণিক কাহিনী, ধর্মীয় প্রতীকবাদ, হেরাল্ডিক কৌশল, প্রাতিষ্ঠানিক প্রতীক এবং এমনকি অন্যান্য প্রাণী প্রজাতির নামকরণকেও অনুপ্রাণিত করেছে।

প্রাচীন এবং আদিবাসী বিশ্বাস

প্রাচীন মিশরে পেলিকান ( মিশরীয় ভাষায় হেনেট ) মৃত্যু এবং পরকালের সাথে সম্পর্কিত ছিল । সমাধির দেয়ালে এটিকে চিত্রিত করা হয়েছিল এবং সমাধি গ্রন্থগুলিতে সাপের বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক প্রতীক হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছিল। পিরামিড গ্রন্থগুলিতে হেনেটকে “রাজার মা” হিসাবেও উল্লেখ করা হয়েছিল এবং তাই তাকে দেবী হিসাবে দেখা হয়েছিল। অ-রাজকীয় সমাধি প্যাপিরিতে উল্লেখ রয়েছে যে পেলিকান মৃত ব্যক্তির জন্য পাতালে নিরাপদে যাওয়ার ভবিষ্যদ্বাণী করার ক্ষমতা রাখে বলে বিশ্বাস করা হত

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পেলিক্যানদের প্রতীক হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। লুইসিয়ানায়, পাখিটি লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি , তুলান ইউনিভার্সিটি , লুইসিয়ানা টেক ইউনিভার্সিটি , লাফায়েটে লুইসিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় , নিউ অরলিন্সের লয়োলা বিশ্ববিদ্যালয় , দক্ষিণ-পূর্ব লুইসিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় এবং দক্ষিণ বিশ্ববিদ্যালয়ের সীলমোহর শোভিত করে। প্যাকার কলেজিয়েট ইনস্টিটিউটের সীলমোহর , যেখানে একটি পেলিক্যান তার বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে,তা ১৮৮৫ সাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। প্রাগের চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদগুলিতেও একটি পেলিক্যানকে তাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে,

ক্রীড়া দল

খেলাধুলায়, পেলিকান বিভিন্ন দল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাথলেটিক্সের মাসকট এবং লোগো হিসেবে কাজ করে। এটি নিউ অরলিন্স পেলিকানস এনবিএ দল,লাহটি পেলিকানস আইস হকি দল,তুলান বিশ্ববিদ্যালয়,এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসকট ।

সংরক্ষণ অবস্থা:

আইইউসিএন (IUCN) অনুসারে, গ্রেট হোয়াইট পেলিকান বা রোজি পেলিকান বর্তমানে “Least Concern” ক্যাটাগরিতে থাকলেও তাদের অনেক আবাসস্থল আজ ধ্বংস বা হুমকির সম্মুখীন। জলাভূমি শুকিয়ে যাওয়া, দূষণ, অতিরিক্ত মাছ ধরা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনেক অঞ্চল থেকে এই পাখি হারিয়ে যাচ্ছে।

বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশে এসব পাখির সংখ্যা কমে গেছে। তাই জলাভূমি সংরক্ষণ এবং সচেতনতা বাড়ানো জরুরি।

রোজি পেলিকান ও মানুষের সম্পর্ক:

মানুষের সঙ্গে পেলিকানের সম্পর্ক হাজার বছর ধরে চলে আসছে। প্রাচীন মিশরীয় চিত্রলিপিতে পেলিকানের ছবি আছে। নানা জাতির শিল্প ও সাহিত্যে এই পাখি সৌন্দর্য ও ত্যাগের প্রতীক হিসেবে দেখা গেছে। অনেক স্থানে এই পাখিকে পর্যটনের জন্য আকর্ষণ হিসেবেও দেখা হয়।

রোজি পেলিকান এক আশ্চর্য পাখি—তা তার রঙিন রূপ, শিকার কৌশল, সামাজিক আচরণ কিংবা প্রাকৃতিক পরিবেশে তার বিশাল উপস্থিতি। আমাদের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য রক্ষায় এই ধরনের পাখি সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোজি পেলিকান শুধু একটি পাখি নয়—এটি আমাদের প্রকৃতির সৌন্দর্য, সংবেদনশীলতা এবং জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ। তাই তাদের রক্ষা করাও আমাদের দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র:

IUCN Red List – Pelecanus onocrotalus

National Geographic – Pelican Species Overview

BirdLife International

WWF – Wetland Birds Conservation

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments