Friday, October 3, 2025
Homeজীবনীরাজা রামমোহন রায়: একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনী

রাজা রামমোহন রায়: একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনী

রাজা রামমোহন রায়: একজন সমাজ সংস্কারকের জীবনী

রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২-১৮৩৩) ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সমাজ সংস্কারক, যিনি ধর্ম, শিক্ষা, নারী-অধিকার এবং সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে লড়াই করে আধুনিক ভারতের ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি একাধারে চিন্তাবিদ, দার্শনিক, মানবতাবাদী এবং সাংবাদিক ছিলেন। তাঁকে “ভারতের নবজাগরণের জনক” ও “আধুনিক ভারতের স্থপতি” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জন্ম, শৈশব ও শিক্ষা

১৭৭২ সালের ২২ মে হুগলি জেলার রাধানগর গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে রামমোহন রায়ের জন্ম হয়েছিল। তার পিতা রামকান্ত ছিলেন একজন বৈষ্ণব, তার মা ফুলঠাকুরানী দেবী ছিলেন শৈব পরিবার থেকে। তিনি সংস্কৃত, ফার্সি এবং ইংরেজি ভাষার একজন মহান পণ্ডিত ছিলেন এবং আরবি, ল্যাটিন এবং গ্রীক ভাষাও জানতেন।

পনেরো-ষোলো বছর বয়সে তিনি গৃহত্যাগ করে নানা স্থান ভ্রমণ করেন। কাশীতে ও পাটনায় কিছুকাল অবস্থান করেন। এছাড়া তিনি নেপালে গিয়েছিলেন। এর আগে তার সঙ্গে তন্ত্রশাস্ত্রবেত্তা সুপণ্ডিত নন্দকুমার বিদ্যালঙ্কারের (পরে হরিহরানন্দ তীর্থস্বামী কুলাবধূত নামে পরিচিত) যোগাযোগ হয়। নন্দকুমারের সহযোগিতায় রামমোহনের সংস্কৃত ভাষায় পাণ্ডিত্য হয়, তার বেদান্তে অনুরাগ জন্মে।

ব্রাহ্ম উপাসনালয় প্রতিষ্ঠায় হরিহরানন্দই তার দক্ষিণ-হস্ত ছিলেন। বারাণসী থেকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার পর তিনি পাটনা থেকে আরবি ও ফারসি ভাষা শেখেন। পরে তিনি ইংরেজি, গ্রিক ও হিব্রু ভাষাও শেখেন। পরিবারের প্রথাগত বিশ্বাস ও রক্ষণশীলতার মাঝেও রামমোহন ছোটবেলা থেকেই যুক্তিবাদী ও অনুসন্ধিৎসু মনের অধিকারী ছিলেন।

ধর্মচিন্তা ও সমাজ সংস্কার

রামমোহনের ধর্মীয় চিন্তা ছিল গভীর ও যুক্তিবাদী। তিনি হিন্দু ধর্মে প্রচলিত পৌরাণিক কুসংস্কার, বহু দেবতার পূজা, ও ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন এক সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের অস্তিত্বে। ১৮২৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ব্রাহ্ম সমাজ—একটি ধর্মীয় ও সামাজিক আন্দোলন যা হিন্দুধর্মের সংস্কার এবং একেশ্বরবাদের প্রচার করে।

ব্রাহ্ম সমাজ হিন্দু ধর্মকে যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী এবং আধুনিক রূপে গড়ে তোলার চেষ্টা করে। এতে নারী-পুরুষ সমতা, জাতপাতের বিরোধিতা, এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তাকে উৎসাহ দেওয়া হয়। এই আন্দোলন পরবর্তীকালে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কেশবচন্দ্র সেন-এর মাধ্যমে আরও বিস্তার লাভ করে।
রামমোহন রায় সামাজিক কুফলগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য এবং ভারতে সামাজিক ও শিক্ষাগত সংস্কার প্রচারের জন্য আত্মীয় সভা এবং একতাবাদী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

সমাজ সংস্কারক হিসেবে অবদান

রামমোহন রায় ছিলেন সতীদাহ প্রথা, নারী অধিকারহীনতা, বাল্যবিবাহ, এবং ধর্মীয় কুসংস্কারের ঘোরতর বিরোধী। তিনি সতেরো শতকে ভারতে প্রচলিত সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে সরব হন। বহু প্রচার ও আন্দোলনের পর ১৮২৯ সালে ব্রিটিশ গভর্নর লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করেন। এই কৃতিত্বের অন্যতম কারিগর ছিলেন রামমোহন।

তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে সরব ছিলেন। নারীদের মৌলিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, বিধবা বিবাহ, ও শিক্ষার সুযোগ নিয়ে তিনি অনেক লিখেছেন ও প্রচার করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারী শিক্ষা ছাড়া সমাজ উন্নত হতে পারে না।

শিক্ষা ও সাংবাদিকতা

রামমোহন রায় পশ্চিমা শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে ইংরেজি, বিজ্ঞান, গণিত এবং দর্শনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৮১৭ সালে তিনি ডেভিড হেয়ারের সঙ্গে যৌথভাবে কলকাতায় হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া তিনি সংস্কৃত কলেজ এবং পরবর্তীকালে অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল প্রতিষ্ঠায়ও ভূমিকা রাখেন।

তিনি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করেন। তাঁর উদ্যোগে প্রকাশিত হয় সাম্বাদ কৌমুদী (১৮২১)—যা ছিল সমাজ সংস্কার ও শিক্ষার প্রচারে একটি যুগান্তকারী প্রকাশনা। ইংরেজি ভাষায় তিনি প্রকাশ করেন Mirat-ul-Akhbar নামে একটি পত্রিকা, যাতে তিনি ভারতীয়দের অধিকারের কথা বলেন।

সাহিত্যকর্ম ও দর্শন

রামমোহন হিন্দু ধর্ম, ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম এবং পাশ্চাত্য দর্শনের উপর বহু গবেষণা করেন এবং বিভিন্ন ভাষায় প্রবন্ধ ও পুস্তক রচনা করেন। তিনি উপনিষদ, ভগবদগীতা, বেদান্ত দর্শনের যুক্তিবাদী ব্যাখ্যা দেন এবং হিন্দু ধর্মের একটি আধুনিক, যুক্তিনির্ভর রূপ তুলে ধরেন।

তিনি খ্রিস্টধর্মের অনেক ইতিবাচক দিক স্বীকার করলেও, ট্রিনিটি মতবাদ (ঈশ্বর, পুত্র ও পবিত্র আত্মা) ও পৌরাণিক বিশ্বাসের বিরোধিতা করেন। তাঁর কাজ ছিল আন্তঃধর্মীয় সমঝোতা ও যুক্তিভিত্তিক ধর্মচিন্তার প্রসার ঘটানো।

জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে

১৯৮৮ সালে শ্যাম বেনেগাল প্রযোজিত ও পরিচালিত দূরদর্শন সিরিয়াল ভারত এক খোঁজ। এছাড়াও রাজা রাম মোহন রায়ের উপর একটি পূর্ণাঙ্গ একটি পর্ব চিত্রিত করে। প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন বিশিষ্ট টিভি অভিনেতা অনঙ্গ দেশাই,উর্মিলা ভাট,টম অল্টার এবং রবি ঝাঁকাল সহ কাস্ট হিসেবে।

১৯৮৪ সালে ভারতের ফিল্ম ডিভিশন পিসি শর্মা পরিচালিত রাজা রামমোহন রায়ের একটি তথ্যচিত্র তৈরি করে।

উপাধি “রাজা”

তাঁর ইউরোপ যাত্রার আগে মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ তাঁকে “রাজা” উপাধিতে ভূষিত করেন। এই উপাধি তাঁর সামাজিক মর্যাদা ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বহুল পরিচিত।

ইউরোপ যাত্রা ও মৃত্যু

১৮৩০ সালে রামমোহন রায় ইংল্যান্ডে যান মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহের প্রতিনিধি হিসেবে, তাঁর পেনশন ইস্যুতে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে। ইউরোপে তিনি শিক্ষাবিদ, দার্শনিক এবং মানবাধিকারকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন এবং ভারতীয় সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা সম্পর্কে নানা বক্তব্য প্রদান করেন। ১৮৩২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে কিছুদিনের জন্য তিনি ফ্রান্সেও গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন আধুনিক ভারতের সমাজ সংস্কারের অন্যতম পথিকৃৎ।

১৮৩৩ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর, ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল শহরে, ৬১ বছর বয়সে রাজা রামমোহন রায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সেখানকার আরনস ভেলের কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

রাজা রামমোহন রায় ছিলেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি শুধু কুসংস্কার ও সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াননি, বরং যুক্তি, বিজ্ঞান এবং মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে একটি আধুনিক সমাজের পথ দেখিয়েছেন। তার অবদান আজও আমাদের শিক্ষার, মানবাধিকারের ও ধর্মীয় সহনশীলতার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। তিনি সত্যিকার অর্থেই ছিলেন “ভারতের নবজাগরণের অগ্রদূত”।

তথ্যসূত্র:

সরকার, শতানন্দ (২০০৫), রাজা রামমোহন রায়, কলকাতা

Encyclopaedia Britannica

পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারতীয় ইতিহাস সংক্রান্ত প্রকাশনা

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments