Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসকুতুব শাহ মসজিদ অষ্টগ্রাম

কুতুব শাহ মসজিদ অষ্টগ্রাম

কুতুব শাহ মসজিদ এর ইতিহাস

বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের এক অমূল্য সম্পদ হলো বিভিন্ন মসজিদ। বাংলার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলির মধ্যে যেসব মসজিদ মধ্যযুগের ইতিহাস বহন করে চলেছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো কুতুব শাহ মসজিদ। এটি বাংলাদেশের বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত এবং ষাট গম্বুজ মসজিদসহ অন্যান্য ইসলামী স্থাপত্যের সঙ্গে মিলে এক অনন্য স্থাপত্য-ঐতিহ্য গড়ে তুলেছে। কুতুব শাহ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং মধ্যযুগীয় বাংলার রাজনীতি, সংস্কৃতি, শিল্পকলা ও সামাজিক জীবনের একটি জীবন্ত দলিল।

কুতুব শাহ মসজিদ এর ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশ

কুতুব মসজিদ বা কুতুব শাহ মসজিদ কিশোরগঞ্জ জেলার অষ্টগ্রাম উপজেলায় অবস্থিত একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও বাংলাদেশের একটি প্রাচীন মসজিদ। মসজিদটি সুলতানী আমলে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। এটি সুন্দরবনের নিকটে এবং গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা নদীর বদ্বীপ অঞ্চলে। মসজিদটির চারপাশে গ্রামীণ পরিবেশ, সবুজ শস্যক্ষেত্র এবং ঐতিহ্যবাহী বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে। এই অঞ্চলকে বলা হয় “মসজিদের শহর”, কারণ এখানে অসংখ্য মসজিদ ও ইসলামি স্থাপত্য বিদ্যমান।

কুতুব শাহ মসজিদ নির্মাণ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

কুতুব মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, এটি মূলত ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে নির্মিত বলে মনে করা হয়, যা বাংলার সুলতানি ও মুঘল স্থাপত্যরীতির মিশেলে তৈরি। এই মসজিদটি কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম থানা সদরে অবস্থিত এবং বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহ-এর নামে এর নামকরণ করা হয়েছে, যিনি ঈশা খাঁ’র মিত্র ছিলেন এবং যিনি এই অঞ্চলে আগমন করেছিলেন।

নির্মাণকাল

ষোড়শ থেকে সপ্তদশ শতাব্দী: বেশিরভাগ ইতিহাসবিদ মনে করেন, মসজিদটি ১৭ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মিত।

মতবিরোধ: কিছু সূত্র এটি ১৬শ শতাব্দীতে নির্মিত বলেও উল্লেখ করে, যদিও অধিকাংশেরই মতামত সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে নির্মাণের পক্ষে। মসজিদের নামকরণ হয়েছে একজন সুফি সাধক কুতুব শাহ-এর নামে। তিনি ছিলেন একজন আধ্যাত্মিক নেতা এবং ইসলাম প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ। ধারণা করা হয়, তাঁর স্মরণেই স্থানীয় জনগণ মসজিদটির নাম রাখেন কুতুব শাহ মসজিদ।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

কুতুব শাহের আগমন: সুলতানি আমলের বিখ্যাত দরবেশ কুতুব শাহ, যিনি শাহ মজলিস কুতুব নামেও পরিচিত, ষোড়শ শতকে মহাবীর ঈশা খাঁর মিত্রশক্তি নিয়ে এই অঞ্চলে আগমন করেন।

কুতুব শাহ মসজিদ এর স্থাপত্যশৈলী

কুতুব মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে সুলতানি ও মোঘল প্রভাব রয়েছে; এটি একটি আট কোণাকার বুরুজ ও পাঁচটি গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ, যা ষোড়শ শতাব্দীর শেষ দিকে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। মসজিদের নির্মাণশৈলীতে বুরুজ এবং গম্বুজ ছাড়াও রয়েছে নান্দনিক কারুকার্য, যা একে একটি ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক নিদর্শনে পরিণত করেছে। বাংলার মসজিদ স্থাপত্যের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ইটের ব্যবহার। কুতুব শাহ মসজিদও মূলত ইট দিয়ে নির্মিত।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

গম্বুজ: মসজিদটির উপরে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মাঝের গম্বুজটি তুলনামূলক বড়, আর পাশে দুটি ছোট। এটি বাংলার মসজিদ স্থাপত্যের একটি সাধারণ রীতি।

মিনার: মসজিদের চার কোণে অষ্টভুজাকৃতির মিনার রয়েছে, যেগুলো কিছুটা উঁচু এবং অলঙ্করণশোভিত।

দেওয়াল: মোটা ও মজবুত দেওয়াল তৈরি করা হয়েছে পোড়ামাটির ইট দিয়ে।

খিলান: প্রবেশপথে ও জানালায় অর্ধবৃত্তাকার খিলান ব্যবহার করা হয়েছে।

শৈল্পিক অলঙ্করণ: মসজিদের বাইরের অংশে টেরাকোটার কাজ থাকলেও সময়ের সাথে সাথে অনেক অলঙ্করণ ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে।

সুলতানি ও মোঘল মিশ্রণ: কুতুব মসজিদের স্থাপত্যশৈলীকে সুলতানি আমলের শেষ এবং মোঘল আমলের প্রথম দিকের কাজের সাথে তুলনা করা হয়, কারণ এতে উভয় ধারার প্রভাব দেখা যায়।

প্রাচীনত্ব: বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলে টিকে থাকা মুসলিম স্থাপত্যের মধ্যে কুতুব মসজিদ অন্যতম প্রাচীনতম, যা একে ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে।

নান্দনিকতা: ধলেশ্বরী নদের তীরে অবস্থিত এই মসজিদটি দেখতে খুব সুন্দর এবং এর নকশা দর্শকদের মন জয় করে নেয়।

ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব

কুতুব মসজিদ, যা কুতুব শাহ মসজিদ নামেও পরিচিত, কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রামে অবস্থিত একটি সুলতানি আমলের প্রাচীন মসজিদ এবং এটি মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব ধারণ করে। এর ধর্মীয় গুরুত্ব হলো এটি একটি উপাসনা কেন্দ্র ও দরবেশ কুতুব শাহের মাজারের সাথে সংযুক্ত। সামাজিক গুরুত্বের দিক থেকে এটি একটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ও ঐতিহাসিক স্থাপত্যের উদাহরণ যা এলাকার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতীক। কুতুব শাহ মসজিদ শুধু নামাজ আদায়ের স্থান নয়, বরং এটি ছিল মুসলমানদের মিলনকেন্দ্র। মধ্যযুগে এখানে ইসলাম প্রচার, শিক্ষা ও সামাজিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। স্থানীয় জনগণ বিশ্বাস করত যে, এই মসজিদের আশীর্বাদে তাদের জীবন সুখময় হবে। এছাড়া, কুতুব শাহ মসজিদ সুফি সাধনা ও আধ্যাত্মিক চর্চার একটি কেন্দ্র হিসেবেও খ্যাত ছিল। এখানে ধর্মীয় উপদেশ, কোরআন তেলাওয়াত ও ইসলামী শিক্ষা দেওয়া হতো।

কুতুব শাহের অবদান

কুতুব শাহ (বা কুতুবী) মসজিদটি নির্মিত হয়েছিল কুতুব শাহের শাসনামলে, সম্ভবত কোনো মহামারী থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ঈশ্বরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। এই মসজিদটি শুধুমাত্র একটি উপাসনালয়ই ছিল না, বরং ইসলাম ও এর সাংস্কৃতিক প্রভাব প্রসারের একটি প্রতীকও ছিল। মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী এবং এর নকশা কুতুব শাহী আমলের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হয়। কুতুব শাহ ছিলেন খান জাহান আলীর সমসাময়িক একজন সুফি সাধক। তিনি ইসলাম প্রচার ও মানবসেবার মাধ্যমে সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছিলেন। তাঁর নামেই মসজিদটির নামকরণ হওয়ায় এটি শুধু স্থাপত্য নয়, বরং তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব

বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কুতুব শাহ মসজিদকে একটি ঐতিহাসিক স্থাপত্য হিসেবে সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে। এটি আজও বাংলার মুসলিম স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদসহ একাধিক স্থাপত্যকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের স্বীকৃতি দেয়। যদিও কুতুব শাহ মসজিদ সরাসরি সেই তালিকায় নেই, তবুও এটি বাগেরহাটের ইসলামি স্থাপত্য ধারার অন্তর্ভুক্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন।

বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণ

সময় ও প্রকৃতির ক্ষয়িষ্ণু প্রভাবে মসজিদটির অনেকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে গম্বুজ ও অলঙ্করণে ফাটল দেখা দিয়েছে। তবে সরকারের উদ্যোগে নিয়মিত সংরক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। স্থানীয় জনগণও এটিকে এখনো নামাজের জন্য ব্যবহার করে থাকেন।

পর্যটন ও সংস্কৃতিতে ভূমিকা

প্রতিবছর অসংখ্য দেশি-বিদেশি পর্যটক বাগেরহাট ভ্রমণে আসেন। ষাট গম্বুজ মসজিদের মতো কুতুব শাহ মসজিদও তাদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। ইতিহাস, স্থাপত্য ও ধর্মীয় ঐতিহ্যে আগ্রহী মানুষদের কাছে এটি এক অনন্য গন্তব্য। এছাড়া স্থানীয় সংস্কৃতি ও অর্থনীতিতেও এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পর্যটনের কারণে স্থানীয় মানুষরা আর্থিকভাবে উপকৃত হচ্ছেন।

কুতুব শাহ মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও স্থাপত্যশিল্পের এক অমূল্য দলিল। এই মসজিদ আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়, কীভাবে মধ্যযুগীয় বাংলায় ইসলাম প্রচার, সুফি সাধনা ও স্থানীয় জনগণের সংস্কৃতি একসূত্রে গাঁথা হয়েছিল। কুতুব শাহের মতো আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বরা শুধু ধর্মীয় নেতা ছিলেন না; তাঁরা ছিলেন সমাজ সংস্কারক, শিক্ষাবিদ এবং মানবতার দূত। তাঁদের অবদানের স্মারক হিসেবেই এই মসজিদ আজও দাঁড়িয়ে আছে।

স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকে কুতুব শাহ মসজিদ আমাদের বলে দেয়, বাংলার মুসলিম স্থপতিরা কেবল ধর্মীয় স্থাপনা তৈরি করেননি, বরং তাতে শিল্প ও নান্দনিকতাও যুক্ত করেছিলেন। ইটের গাঁথুনি, খিলান, গম্বুজ ও মিনারের সুষমা প্রমাণ করে যে তৎকালীন কারিগররা ছিলেন দক্ষ ও সৃজনশীল। যদিও সময়ের সাথে সাথে প্রাকৃতিক ক্ষয়, অবহেলা ও মানুষের অসতর্ক ব্যবহারে মসজিদের অনেকাংশ নষ্ট হয়ে গেছে, তবুও এর মূল রূপ এখনো আমাদের মুগ্ধ করে।

বর্তমান প্রজন্মের জন্য কুতুব শাহ মসজিদ একটি ঐতিহাসিক পাঠশালা। এর মাধ্যমে আমরা শিখতে পারি অতীতের সমাজব্যবস্থা, ধর্মীয় সহনশীলতা, স্থাপত্যকলা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের কথা। আজ যখন বিশ্বায়নের চাপে স্থানীয় ঐতিহ্য বিলুপ্তির পথে, তখন কুতুব শাহ মসজিদের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের জাতীয় পরিচয় ও আত্মমর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অতএব, আমাদের দায়িত্ব হলো এই ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো সংরক্ষণ করা, গবেষণা করা এবং আগামী প্রজন্মের কাছে এগুলোর গুরুত্ব পৌঁছে দেওয়া। কুতুব শাহ মসজিদ কেবল অতীতের স্মারক নয়; এটি আমাদের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্যও এক অনন্য প্রেরণার উৎস। এর গৌরবময় ইতিহাস আমাদের শেখায় যে, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে লালন করলে একটি জাতি কেবল টিকে থাকে না, বরং সমৃদ্ধ হয়।

তথ্যসূত্র

আহমেদ, নাজমুল। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা, ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ২০০২।

UNESCO World Heritage Centre. Historic Mosque City of Bagerhat.

Chowdhury, K. A. Islamic Architecture in Bengal, Dhaka University Press, 1999.

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার। বাগেরহাট প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন সংরক্ষণ প্রতিবেদন, ২০১৫।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments