তুতানখামুনের স্বর্ণের স্যান্ডেল কাহিনি
প্রাচীন মিশরের সমাধিতে পাওয়া স্বর্ণের স্যান্ডেল এবং পায়ের আঙুলের ঢাকনা (toe caps) মিশরীয় রাজপরিবারের বিলাসিতা, ধর্মীয় বিশ্বাস এবং পরকালীন জীবনের ধারণার এক অনন্য প্রতীক। এই জিনিসগুলো সাধারণ অলঙ্কার বা পোশাকের অংশ ছিল না; বরং মিশরীয়দের পরকালীন জীবনের প্রস্তুতির অংশ এবং সামাজিক মর্যাদার চিহ্ন। নিচে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
স্বর্ণের স্যান্ডেল: রাজকীয় বিলাসিতার প্রতীক
কোথায় পাওয়া গেছে?
সবচেয়ে বিখ্যাত উদাহরণ হলো তুতানখামুনের সমাধি (১৮তম রাজবংশ, খ্রিস্টপূর্ব ১৪ শতক) থেকে পাওয়া সোনার স্যান্ডেল। এই স্যান্ডেলগুলো প্রকৃতপক্ষে তুতানখামুনের পায়ের জন্য তৈরি করা হয়েছিল এবং তার মমির সঙ্গে রাখা হয়েছিল।
কেন স্যান্ডেল সমাধিতে রাখা হতো?
প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, মৃত্যুর পর আত্মা একটি দীর্ঘ যাত্রা করবে এবং পরকালীন জীবনে রাজা যেন আরামে চলতে পারেন, সেই জন্য স্যান্ডেল রাখা হতো। সোনার স্যান্ডেল ছিল মর্যাদার প্রতীক, যা ফেরাউনের দেবতুল্য ক্ষমতা এবং সমৃদ্ধি প্রকাশ করত।
নকশা ও বৈশিষ্ট্য
১। স্যান্ডেল সম্পূর্ণ সোনার পাত দিয়ে তৈরি।
২। তলার অংশে শত্রুদের ছবি খোদাই করা থাকত, যাতে ফেরাউন প্রতীকীভাবে তাদের পদদলিত করতে পারেন।
৩। এটি ক্ষমতা ও বিজয়ের প্রতীক।
৪। পায়ের মাপে তৈরি, মমির জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত।
পায়ের আঙুলের ঢাকনা (Toe Caps): অদ্ভুত কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অলঙ্কার
কেন ব্যবহার করা হতো?
মমি তৈরির সময় অনেক সময় পায়ের আঙুল ক্ষতিগ্রস্ত হতো। আঙুলকে সুরক্ষিত রাখতে এবং মৃতদেহকে পূর্ণাঙ্গ দেখাতে এই সোনার আঙুলের ঢাকনা ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও এটি পরকালীন জীবনে অমরত্ব ও সৌন্দর্যের প্রতীক হিসেবে ধরা হতো।
উপাদান ও নকশা
১। প্রধানত সোনা দিয়ে তৈরি, কখনও রুপা বা ব্রোঞ্জও ব্যবহার হতো।
২। প্রতিটি আঙুলের জন্য আলাদা ঢাকনা।
৩। মসৃণ ও চওড়া নকশা, কখনও কখনও হায়ারোগ্লিফিক খোদাই করা থাকত।
তুতানখামুনের সমাধি থেকে পাওয়া উদাহরণ
হাওয়ার্ড কার্টারের খননকাজে তুতানখামুনের সমাধি (KV62) থেকে অসংখ্য মূল্যবান জিনিস পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে:
১। দুটি সোনার স্যান্ডেল
২। ১০টি সোনার পায়ের আঙুলের ঢাকনা
৩। হাতের আঙুলের ঢাকনা
এই নিদর্শনগুলো বর্তমানে কায়রোর মিশরীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
ধর্মীয় ও প্রতীকী গুরুত্ব
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করত যে মৃতদেহের শারীরিক অঙ্গ যত বেশি সম্পূর্ণ থাকবে, আত্মা তত ভালোভাবে পরকালীন জীবনযাপন করবে। তাই আঙুলের ঢাকনা ছিল সৌন্দর্য এবং সুরক্ষার প্রতীক। সোনার ব্যবহার অমরত্ব ও দেবত্বের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো।
শিল্পকলা ও কারিগরি দক্ষতা
এই সোনার স্যান্ডেল ও আঙুলের ঢাকনা মিশরীয় ধাতুশিল্পের উৎকর্ষতা প্রমাণ করে। এত সূক্ষ্মভাবে সোনাকে পাতলা করে পায়ের মাপে তৈরি করা এবং খোদাই করা এক অসাধারণ প্রযুক্তি।
সমাধি থেকে পাওয়া অন্যান্য সম্পর্কিত জিনিস
স্যান্ডেল ও আঙুলের ঢাকনার পাশাপাশি সমাধি থেকে পাওয়া গেছে:
১। সোনার গহনা
২। সোনার মুখোশ
বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক ও মূর্তি এগুলো একসঙ্গে মিশরীয়দের পরকালীন বিশ্বাসের জটিলতা ও রাজকীয় বিলাসিতা তুলে ধরে।
প্রাচীন মিশরের সমাধি থেকে উদ্ধার হওয়া স্বর্ণের স্যান্ডেল ও পায়ের আঙুলের ঢাকনা কেবল বিলাসিতার প্রতীক নয়, বরং মিশরীয় সভ্যতার ধর্মীয় বিশ্বাস, কারিগরি উৎকর্ষতা এবং সামাজিক মর্যাদার প্রতিফলন। মিশরীয়রা বিশ্বাস করত, মৃত্যু জীবনের সমাপ্তি নয় বরং পরকালীন জীবনের সূচনা। তাই ফেরাউন ও অভিজাতদের সমাধিতে এমন বিলাসবহুল জিনিস রাখা হতো, যাতে তারা পরকালে একই মর্যাদা এবং সুরক্ষা বজায় রাখতে পারে।
স্বর্ণের স্যান্ডেল শুধু অলঙ্কার নয়; এটি শক্তি, দেবত্ব এবং চিরস্থায়ী জীবনযাত্রার প্রতীক ছিল। অন্যদিকে, পায়ের আঙুলের সোনার ঢাকনা মৃতদেহকে পূর্ণাঙ্গ রাখা এবং দেবত্বের ছোঁয়া দেওয়ার এক গভীর প্রতীকী অর্থ বহন করত। প্রতিটি টুকরো সোনা কেবল সৌন্দর্য নয়, বরং ধর্মীয় রীতিনীতি, পরকালীন প্রস্তুতি এবং ফেরাউনের মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রাখার প্রচেষ্টা প্রকাশ করে।
আজ এসব নিদর্শন কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তু নয়, এগুলো হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার জীবনধারা, বিশ্বাস এবং শিল্পকলা সম্পর্কে অমূল্য তথ্য দেয়। এগুলো আমাদের শেখায় যে, মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুতি প্রাচীন মিশরীয়দের কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই নিদর্শনগুলো তাই শুধু ইতিহাসের অংশ নয়, বরং মানব সভ্যতার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অমূল্য সম্পদ।
তথ্যসূত্র
Carter, Howard. The Tomb of Tut-Ankh-Amen. London: Cassell & Company, 1923.
Wilkinson, Richard H. The Complete Gods and Goddesses of Ancient Egypt. Thames & Hudson, 2003.
British Museum Collections
The Egyptian Museum, Cairo – Official Archives
Reeves, Nicholas. The Complete Tutankhamun: The King, the Tomb, the Royal Treasure. Thames & Hudson, 1990.