পিসার হেলানো টাওয়ার
পিসার হেলানো টাওয়ার (ইতালীয় নাম: Torre Pendente di Pisa) বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্যকীর্তি। এটি শুধু একটি স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন নয়, বরং প্রকৌশলগত সমস্যার জন্য বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছে। টাওয়ারটি ইতালির পিসা শহরের ক্যাথেড্রাল স্কয়ারে (Piazza dei Miracoli) অবস্থিত। এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এর হেলান—মাটি ও ভিত্তির সমস্যার কারণে টাওয়ারটি সোজা না থেকে একপাশে হেলে গেছে, যা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।
নির্মাণের ইতিহাস
পিসার হেলানো টাওয়ার মূলত ক্যাথেড্রালের ঘণ্টাধ্বনি টাওয়ার হিসেবে নির্মিত হয়েছিল। এর নির্মাণ শুরু হয় ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে এবং সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে প্রায় ২০০ বছর। এত দীর্ঘ সময়ের কারণ হলো বিভিন্ন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং টাওয়ারের হেলে যাওয়ার কারণে নির্মাণ বারবার বন্ধ হয়ে যাওয়া।
নির্মাণের প্রধান ধাপসমূহ
প্রথম ধাপ (১১৭৩–১১৭৮)
প্রথম তিনটি তলা নির্মাণের পর টাওয়ার হেলতে শুরু করে। কারণ, মাটির নিচের স্তর নরম এবং বালুকাময় ছিল, যা ভারসাম্য রাখতে পারেনি। এই সমস্যার কারণে কাজ বন্ধ করতে হয়।
দ্বিতীয় ধাপ (১২৭২–১২৭৮)
প্রায় এক শতাব্দী পর নির্মাণ আবার শুরু হয়। প্রকৌশলীরা হেলে যাওয়া কমানোর জন্য একপাশের তলা সামান্য উঁচু করে তৈরি করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও পুরোপুরি সমাধান মেলেনি।
শেষ ধাপ (১৩১৯–১৩৭২)
শেষ পর্যন্ত সপ্তম তলা এবং ঘণ্টাঘর তৈরি করা হয়। ১৩৭২ সালে টাওয়ার সম্পূর্ণ হয়।
স্থাপত্যশৈলী
পিসার টাওয়ার রোমানেস্ক স্থাপত্যশৈলীর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এর বৈশিষ্ট্য হলো:
বৃত্তাকার আকার
সাদা মার্বেল ব্যবহার
খিলানযুক্ত স্তম্ভ
অলংকৃত খোদাই
টাওয়ারটির মোট উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার (বর্তমানে হেলানের কারণে একপাশ কিছুটা ছোট)। ওজন প্রায় ১৪,৫০০ টন। এতে মোট ৮টি স্তর রয়েছে, যার মধ্যে উপরের স্তরে ঘণ্টাধ্বনি টাওয়ার রয়েছে।
কেন হেলেছে টাওয়ারটি?
পিসার টাওয়ার হেলেছে মূলত ভূতাত্ত্বিক সমস্যার কারণে। এর নিচের মাটি ছিল নরম এবং বালুমিশ্রিত, যা ওজন ধরে রাখতে পারেনি। ফলস্বরূপ ভিত্তি সমানভাবে বসেনি এবং টাওয়ার ধীরে ধীরে হেলে যায়।
শুরুর দিকে হেলান ছিল সামান্য, কিন্তু সময়ের সাথে তা ৫.৫ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যায়। ১৯৯০ সালে টাওয়ারটি পর্যটকদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়, কারণ এর ধ্বংস হওয়ার ঝুঁকি ছিল। পরে ব্যাপক প্রকৌশল কাজের মাধ্যমে হেলান কমিয়ে ৩.৯৭ ডিগ্রি করা হয় এবং ২০০১ সালে পুনরায় দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয়।
সংরক্ষণ ও পুনর্গঠন কাজ
১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ইতালীয় সরকার ও আন্তর্জাতিক প্রকৌশলীরা টাওয়ার স্থিতিশীল রাখতে নানা উদ্যোগ নেন। তারা:
মাটির নিচের অংশ থেকে মাটি অপসারণ করে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করেন। ইস্পাতের তার দিয়ে টাওয়ারকে স্থিতিশীল করা হয়। সিসমিক সেন্সর স্থাপন করা হয়। বর্তমানে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন টাওয়ারটি অন্তত আগামী ২০০ বছর নিরাপদ থাকবে।
বিশ্ব ঐতিহ্য ও পর্যটন গুরুত্ব
পিসার হেলানো টাওয়ার ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃত। প্রতিবছর প্রায় দুই মিলিয়নের বেশি পর্যটক এখানে আসেন। এর আশেপাশে রয়েছে পিসা ক্যাথেড্রাল, ব্যাপ্টিস্ট্রি এবং ক্যাম্পোসান্তো মনুমেন্টালে, যেগুলো মিলিয়ে “Square of Miracles” নামে পরিচিত।
গ্যালিলিও ও পিসার টাওয়ার
জনশ্রুতি আছে যে, গ্যালিলিও গ্যালিলি এখানে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব পরীক্ষা করার জন্য বিভিন্ন ওজনের বস্তু ফেলে দেখেছিলেন। যদিও এ তথ্যের প্রমাণ নেই, তবে গল্পটি বিজ্ঞানের ইতিহাসে খুবই জনপ্রিয়।
বর্তমান অবস্থা
আজকের দিনে পিসার হেলানো টাওয়ার একটি বিস্ময়কর স্থাপত্য ও প্রকৌশল শিক্ষার উদাহরণ। দর্শনার্থীরা নির্দিষ্ট সময়ে টাওয়ারের ভেতরে উঠতে পারেন। বর্তমানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা উন্নত হওয়ায় টাওয়ারটি আগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ নয়।
কিছু মজার তথ্য
টাওয়ারের উচ্চতা হেলানের কারণে এক পাশে ৫৬.৬৭ মিটার, অন্য পাশে ৫৫.৮৬ মিটার। টাওয়ারের মধ্যে ২৯৪টি সিঁড়ি রয়েছে। এর হেলান এতটাই বিখ্যাত যে অনেক স্থাপত্যশিল্পী ইচ্ছাকৃতভাবে “হেলানো ভবন” তৈরি করেন অনুপ্রেরণা হিসেবে। নির্মাণের সময় হেলানোর কারণে স্থপতিদের নাম ইতিহাসে তেমনভাবে সংরক্ষিত হয়নি, তবে সাধারণভাবে বলা হয় স্থপতি ছিলেন বোনানো পিসানো।
পিসার হেলানো টাওয়ার শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি মানব সৃজনশীলতা, প্রকৌশল সমস্যা এবং তার সমাধানের গল্প। আজ এটি ইতালির গর্ব, পর্যটনের প্রাণকেন্দ্র এবং বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়।
তথ্যসূত্র
UNESCO World Heritage Centre – Piazza del Duomo, Pisa
Official Leaning Tower of Pisa Website
Encyclopaedia Britannica – Leaning Tower of Pisa
National Geographic – Engineering the Leaning Tower of Pisa