পেত্রা: মরুভূমির গোলাপি শহর
পেত্রা (Petra) হল জর্ডানের দক্ষিণাঞ্চলের এক বিস্ময়কর প্রত্ননগরী, যাকে প্রায়ই “মরুভূমির গোলাপি শহর” (Rose City) বলা হয়। এই শহরটি মূলত লালচে-গোলাপি বেলেপাথরের পাহাড় কেটে নির্মিত, যা একে বিশ্বের অন্যতম অনন্য প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান করে তুলেছে। ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে, এবং ২০০৭ সালে “নতুন সাত আশ্চর্যের” একটি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
পেত্রা খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে নাবাতিয়ান রাজ্যের রাজধানী ছিল। নাবাতিয়ানরা ছিল এক দক্ষ আরব বণিক ও প্রকৌশলী জাতি, যারা মরুভূমির পানি ব্যবস্থাপনা ও শিলার ভেতর স্থাপত্য নির্মাণে অসাধারণ কৌশল দেখিয়েছিল। তাদের রাজত্বকাল (খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক – খ্রিস্টাব্দ ১০৬) পেত্রাকে বাণিজ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র বানায়, যেখানে ভারত, আরব, মিশর ও ভূমধ্যসাগরের সাথে সংযোগ ছিল।
খ্রিস্টাব্দ ১০৬ সালে রোমান সাম্রাজ্য পেত্রাকে দখল করে। রোমান যুগে এখানে নতুন স্থাপত্য ও রাস্তা নির্মিত হলেও, সমুদ্রপথের বাণিজ্য বাড়ার সাথে সাথে পেত্রার গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমে যায়। খ্রিস্টাব্দ ৭ম শতাব্দীর পর ভূমিকম্প ও বাণিজ্যপথ পরিবর্তনের কারণে শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে যায় এবং ১৯শ শতাব্দীতে ইউরোপীয় ভ্রমণকারী জোহান লুডভিগ বার্কহার্ড (১৮১২ সালে) একে পুনরাবিষ্কার করেন।
স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
পেত্রার স্থাপত্য প্রাচীন নাবাতিয়ান শিল্পের সাথে গ্রিক-রোমান প্রভাবের মিশ্রণ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি হলো:
শিলা খোদাই করা ভবন
পেত্রার সবথেকে বিখ্যাত দিক হলো এর স্থাপনাগুলি পাহাড়ের বেলেপাথরের গায়ে সরাসরি খোদাই করে তৈরি। এই কৌশল নাবাতিয়ানদের অসাধারণ প্রকৌশল দক্ষতা প্রদর্শন করে। বেলেপাথরের রঙ সূর্যের আলোয় পরিবর্তিত হয় — সকালে হালকা গোলাপি, দুপুরে কমলা, আর সন্ধ্যায় গাঢ় লালচে।
আল-খাজনে (Al-Khazneh)
পেত্রার প্রতীকী স্থাপনা। “ট্রেজারি” বা ধনভাণ্ডার নামে পরিচিত এই বিশাল মুখাবয়বটি প্রায় ৪০ মিটার উঁচু এবং ২৫ মিটার চওড়া। গ্রিক করিন্থিয়ান স্তম্ভ, পিরামিড-আকৃতির অলংকরণ ও ভাস্কর্য এখানে দৃষ্টিনন্দন। ধারণা করা হয় এটি কোনো নাবাতিয়ান রাজা বা রাজপরিবারের সমাধি ছিল।
সিক (Siq)
প্রধান প্রবেশপথ — প্রায় ১.২ কিমি দীর্ঘ একটি সরু গিরিখাত। দুই পাশে উঁচু পাথুরে প্রাচীর, কিছু জায়গায় ৮০ মিটার পর্যন্ত উঁচু। নাবাতিয়ানরা এখানে পাথরের ভেতর পানি সরবরাহের নালা তৈরি করেছিল।
মঠ (Ad Deir)
পেত্রার আরেকটি বিশাল কাঠামো। প্রায় ৫০ মিটার চওড়া এবং ৪৫ মিটার উঁচু এই স্থাপনাটি খ্রিস্টীয় যুগে ধর্মীয় কাজে ব্যবহৃত হয়েছিল।
রোমান ধাঁচের অ্যাম্ফিথিয়েটার
প্রায় ৮,০০০ দর্শক ধারণক্ষমতা সম্পন্ন এই থিয়েটারটি প্রাচীন নাটক ও অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য ব্যবহৃত হতো। এটি শিলা কেটে তৈরি, যা রোমান স্থাপত্যের প্রভাব দেখায়।
জল ব্যবস্থাপনা
মরুভূমি অঞ্চলে পেত্রা টিকে থাকার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ ছিল এর উন্নত জলাধার, বাঁধ এবং খাল ব্যবস্থা। বৃষ্টির পানি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের এই প্রযুক্তি শহরের জীবনধারাকে সম্ভব করেছিল।
ত্যাগের উচ্চ স্থান
জেবেল মাদবাহ পর্বতের চূড়ায় অবস্থিত উচ্চ কুরবানীর স্থান। পদযাত্রার শুরু পেত্রার থিয়েটারের কাছে। সেখান থেকে, উচ্চ কুরবানীর স্থানটি প্রায় ৮০০ ধাপ উঁচু। সেখানে যে বলিদান করা হত তা ছিল পাপমোচন । সেখানে যে বলিদান করা হত তার আরেকটি সাধারণ রূপ ছিল পশু বলি; এটি বিশ্বাসের কারণে যে নবী হারুনের সমাধি পেত্রায় অবস্থিত, যা মুসলমানদের জন্য একটি পবিত্র স্থান। এর সম্মানে, প্রতি বছর একটি ছাগল বলি দেওয়া হত। সেখানে অন্যান্য আচার-অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠিত হত, যার মধ্যে লোবান পোড়ানোও ছিল।
রাজকীয় সমাধিসৌধ
পেত্রার রাজকীয় সমাধিগুলি হেলেনিস্টিক স্থাপত্যের নাবাটিয়ান সংস্করণে অবস্থিত , তবে প্রাকৃতিক ক্ষয়ের কারণে এর সম্মুখভাগ জীর্ণ হয়ে গেছে। এই সমাধিগুলির মধ্যে একটি, প্রাসাদ সমাধি,পেত্রার রাজাদের সমাধি বলে অনুমান করা হয়। প্রাসাদ সমাধির ঠিক পাশে অবস্থিত করিন্থীয় সমাধিতে ট্রেজারিতে একই হেলেনিস্টিক স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। অন্য দুটি রাজকীয় সমাধি হল সিল্ক সমাধি এবং উর্ন সমাধি; সিল্ক সমাধিটি উর্ন সমাধির মতো তেমন আলাদা নয়। উর্ন সমাধির সামনে একটি বড় উঠোন রয়েছে এবং খ্রিস্টধর্মের প্রসারের পর ৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে এটি একটি গির্জায় রূপান্তরিত হয়।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
বাণিজ্যের কেন্দ্র: পেত্রা পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে বাণিজ্যপথের মূল সংযোগস্থল ছিল।
শিল্প ও স্থাপত্য: গ্রিক, রোমান, মিশরীয় এবং স্থানীয় শৈলীর মিশ্রণে গড়া এক অনন্য স্থাপত্যধারা।
ধর্মীয় বৈচিত্র্য: নাবাতিয়ানদের নিজস্ব দেবদেবীর পাশাপাশি গ্রিক ও রোমান দেবতার প্রতিমা পাওয়া গেছে।
ভূ-কৌশলগত গুরুত্ব
প্লিনি দ্য এল্ডার এবং অন্যান্য লেখকরা পেত্রাকে নাবাতীয় রাজ্যের রাজধানী এবং তাদের ক্যারাভান বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উঁচু পাথর দ্বারা ঘেরা এবং একটি চিরস্থায়ী স্রোত দ্বারা জলপ্রবাহিত, পেত্রা কেবল একটি দুর্গের সুবিধাই অর্জন করেনি, বরং পশ্চিমে গাজা , উত্তরে বসরা এবং দামেস্ক , আকাবা এবং লুইস কাম অন লোহিত সাগর এবং মরুভূমি পেরিয়ে পারস্য উপসাগরে যাওয়ার প্রধান বাণিজ্যিক রুটগুলিও নিয়ন্ত্রণ করেছিল ।
বর্তমান অবস্থা ও পর্যটন
আজকের পেত্রা জর্ডানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্রগুলির একটি। প্রতিবছর লাখো পর্যটক সরু সিক পেরিয়ে গোলাপি ট্রেজারি দেখতে আসে। তবে অতিরিক্ত পর্যটন, প্রাকৃতিক ক্ষয়, এবং মাঝে মাঝে বন্যা এই স্থানকে হুমকির মুখে ফেলছে। জর্ডান সরকার ও ইউনেস্কো মিলিতভাবে সংরক্ষণ কার্যক্রম চালাচ্ছে।
পেত্রা কেবল একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি মানব সৃজনশীলতা ও অভিযোজনশক্তির অসাধারণ উদাহরণ। মরুভূমির মাঝখানে পাহাড় কেটে নগর গড়া, পানি সংরক্ষণের উন্নত কৌশল, এবং নান্দনিক স্থাপত্য — সবকিছু মিলে এটি আজও বিস্ময়ের জন্ম দেয়। যারা ইতিহাস, স্থাপত্য বা প্রাচীন সভ্যতার প্রতি আগ্রহী, তাদের জন্য পেত্রা এক অনিবার্য গন্তব্য।
তথ্যসূত্র
UNESCO World Heritage Centre – Petra
Britannica, T. Editors of Encyclopaedia. “Petra”. Encyclopaedia Britannica.
Jodi Magness, The Archaeology of the Holy Land (Cambridge University Press, 2012)
Petra National Trust – History & Conservation