পেক্টোরাল – সিথিয়ান সংস্কৃতিতে এক অনন্য অলঙ্কার
পেক্টোরাল (pectoral) শব্দটি এসেছে ল্যাটিন pectus শব্দ থেকে, যার অর্থ “বুক” বা “বক্ষ”। পেক্টোরাল বলতে সাধারণত বোঝানো হয় এমন একটি অলঙ্কার, যা বুকের ওপর ঝুলে থাকে, গলার মালার মতো কিন্তু অনেক বৃহৎ ও জমকালো। পেক্টোরাল যা ১৯৭১ সালে ইউক্রেনের আধুনিক ডনিপ্রোপেট্রোভস্ক ওব্লাস্টের টোভস্টা মোহিলা নামক স্থানে একটি সমাধিস্থলে আবিষ্কৃত হয়েছিলো । প্রাচীন সভ্যতাগুলিতে, বিশেষত রাজবংশীয় বা যোদ্ধা সংস্কৃতিগুলিতে পেক্টোরাল শুধুই অলঙ্কারই নয়, বরং ক্ষমতা, পরিচয় এবং ধর্মীয় তাৎপর্যের প্রতীক ছিলো। ইউরেশিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে যাযাবর হিসেবে বসবাসকারী সিথিয়ান (Scythian) জাতির মধ্যেও এই অলঙ্কারের এক অনন্য মর্যাদা ছিলো।
সিথিয়ান জাতি পরিচিতি
সিথিয়ানরা ছিলো ইরানো-ভাষী যাযাবর জনগোষ্ঠী যারা খ্রিস্টপূর্ব ৯ম থেকে ১ম শতাব্দীর মধ্যে আজকের ইউক্রেন, রাশিয়া, কাজাখস্তান এবং মধ্য এশিয়ার বিস্তৃত তৃণভূমিতে বিচরণ করতো। তারা ছিলো দারুণ দক্ষ ঘোড়সওয়ার ও তীরন্দাজ। হেরোডোটাস তার লেখায় সিথিয়ানদের বর্ণনা করেছেন একাধারে ভয়ঙ্কর যোদ্ধা, দুধ ও ঘোড়ার মাংসভোজী, এবং প্রকৃত যাযাবর হিসেবে। তবে শুধু যোদ্ধাই নয়, তারা ছিলো সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ — তাদের হাতে তৈরি অলঙ্কার, অস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি ছিলো অদ্ভুত রকম সূক্ষ্ম ও নান্দনিক।
পেক্টোরাল:শুধুই অলঙ্কার নয়
সিথিয়ান সমাজে পেক্টোরাল ছিলো এক বিশেষ মর্যাদার প্রতীক। এটি কেবল রত্নখচিত গহনাই ছিলো না, বরং এতে লুকিয়ে থাকতো তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, সামাজিক কাঠামো এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
সিথিয়ান পেক্টোরাল সাধারণত স্বর্ণ দিয়ে তৈরি হতো। অলঙ্কারগুলো ছিলো বহুস্তরবিশিষ্ট, নকশায় ভরপুর, এবং প্রতিটি স্তরই ছিল প্রতীকী ব্যাখ্যায় পরিপূর্ণ। এতে যুদ্ধের দৃশ্য, দেবতা, পশু-পাখি, কৃষিকাজ, ফুল-লতা ও পৌরাণিক প্রাণীর চিত্র দেখা যেত।
ব্যবহার:
রাজা, উচ্চপদস্থ যোদ্ধা, অথবা ধর্মীয় পুরোহিতগণ এটি পরিধান করতো।
মৃতদের কবরস্থ করার সময় তাদের সঙ্গে পেক্টোরাল দেওয়া হতো, কারণ বিশ্বাস করা হতো যে এই অলঙ্কার আত্মার সুরক্ষা দেয়।
বিশ্লেষণ:
উপাদান: বিশুদ্ধ সোনা (প্রায় ১.১৫ কেজি ওজন)
ব্যাস: প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার
সম্ভাব্য সময়কাল: খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতক
নকশা ও স্তর:
উপরের স্তর: গরু দোহন, ঘোড়া লালন, পশুপালন – সিথিয়ান জীবনের প্রতিচ্ছবি।
মধ্য স্তর: ঘন ফুল-লতা ও পুষ্পমালার নকশা – সম্ভবত প্রকৃতি ও পুনর্জন্মের প্রতীক।
নিম্ন স্তর: পৌরাণিক দৃশ্য – ঈগল, সিংহ, গ্রিফিন ইত্যাদির মধ্যে যুদ্ধ; যা সৃষ্টির দ্বন্দ্ব ও শক্তির সংঘাতকে নির্দেশ করে।
গবেষকদের মতে, এই অলঙ্কারের সূক্ষ্ম কারুকাজ দেখে মনে হয়, এটি সিথিয়ানদের জন্য গ্রীক কারিগররা তৈরি করেছিলো, যেহেতু গ্রীক উপকূলীয় শহরগুলো (যেমন অলভিয়া, ক্রিমিয়া) সিথিয়ানদের সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্ত ছিলো।
ধর্মীয় ও প্রতীকী তাৎপর্য
সিথিয়ান পেক্টোরালে শুধু সৌন্দর্য নয়, বরং প্রতীকিতার গভীর ব্যঞ্জনা রয়েছে:
জীবন-মৃত্যুর মিশেল: শিকারে প্রাণীর মৃত্যু, ফুলে পূর্ণতা এবং মধ্যস্তরে মানব কর্মকাণ্ড — এই তিনটি স্তর একত্রে জীবনচক্রের প্রতিফলন।
অস্তিত্ববাদী দর্শন: পশু ও পৌরাণিক প্রাণীর সংঘর্ষ মানব জীবনের চিরন্তন দ্বন্দ্ব ও সংগ্রামের প্রতীক।
আত্মার সুরক্ষা: মৃতদের সঙ্গে কবরস্থ করা হলে এটি আত্মাকে রক্ষা করবে এমন বিশ্বাস ছিলো।
সিথিয়ান কারুশিল্প ও আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রভাব
সিথিয়ান পেক্টোরালগুলি কেবল তাদের নিজস্ব ঘরানার শিল্প নয়, বরং এটি গ্রীক, পারস্য এবং এমনকি মধ্য এশীয় শিল্পের সম্মিলিত প্রভাব বহন করে। বিশেষ করে:
গ্রিকদের সৌন্দর্যবোধ, প্রতীকবাদ ও পলিশ টেকনিক স্পষ্ট।
পারস্যের পশুর মোটিফ এবং আকারভঙ্গি দেখা যায়।
মধ্য এশীয় ধাঁচে দৃশ্যের প্যানেল-বিন্যাস ও গল্প বলার ভঙ্গি।
এই আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রভাব প্রমাণ করে যে সিথিয়ানরা ছিলো বহির্বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত, এবং তারা শুধুই ঘোড়সওয়ার যোদ্ধাই নয়, বরং নান্দনিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় অংশগ্রহণকারী একটি সমৃদ্ধ সমাজ।
আধুনিক গুরুত্ব ও গবেষণা
আজকের দৃষ্টিকোণ থেকে সিথিয়ান পেক্টোরালগুলো শুধু প্রাচীন অলঙ্কার নয়, বরং তা প্রত্নতাত্ত্বিক, নৃতাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অমূল্য নিদর্শন। ব্রিটিশ মিউজিয়াম, হার্মিটাজ মিউজিয়ামসহ বিশ্বের নানা গুরুত্বপূর্ণ জাদুঘরে এ ধরনের পেক্টোরাল সংরক্ষিত আছে। এগুলোর বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমরা প্রাচীন ইউরেশিয়ার বাণিজ্য, ধর্ম, সমাজ ও নন্দনতত্ত্ব সম্পর্কে গভীরতর ধারণা লাভ করি।
সিথিয়ান পেক্টোরাল একটি অলংকার হলেও, এর তাৎপর্য অনেক গভীর। এটি একাধারে শিল্প, ধর্ম, ইতিহাস ও পরিচয়ের বাহক। তোলস্তায়া মোগিলার পেক্টোরাল যেমন আমাদের জানায় প্রাচীন ইউরেশিয়ার সাংস্কৃতিক বিনিময়ের গল্প, তেমনি তা প্রমাণ করে সিথিয়ানরা শুধুই যাযাবর যোদ্ধা নয়, বরং তারা শিল্পপ্রেমী,সৃষ্টিশীল এবং আধ্যাত্মিকভাবে গভীরভাবে জড়িত এক জাতি।
তথ্যসূত্র
Herodotus, “Histories”
British Museum Exhibition: “Scythians: Warriors of Ancient Siberia”
State Hermitage Museum Archives
Anna A. Ivantchik, “Scythian Gold: Treasures from the North”
Oxford Handbook of Ancient Eurasian Nomads