Friday, October 3, 2025
Homeস্থাপত্যনয় গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাট

নয় গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাট

নয় গম্বুজ মসজিদ নববী

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল, বিশেষত বাগেরহাট জেলা, ইসলামি স্থাপত্যকলার এক অনন্য ভাণ্ডার। এখানে অবস্থিত অসংখ্য মসজিদ ও মাজারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল মধ্যযুগীয় শহর খলিফাতাবাদ, যা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন খান জাহান আলী। এই শহরকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা স্থাপত্য নিদর্শনের মধ্যে নয় গম্বুজ মসজিদ (Nine Dome Mosque) অন্যতম। এর স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস ও ধর্মীয় গুরুত্ব একে কেবল বাংলাদেশের নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য ঐতিহ্য হিসেবে স্থান দিয়েছে।

নয় গম্বুজ মসজিদ নির্মাণকাল

নয় গম্বুজ মসজিদটি বাগেরহাটের খানজাহানীয় নগরের অন্তর্গত। খান জাহান আলী ছিলেন ১৫শ শতকে বাংলায় মুসলিম শাসনের এক বিশিষ্ট প্রশাসক ও ধর্মপ্রচারক। তিনি খলিফাতাবাদ নামে যে নগরী গড়ে তুলেছিলেন, সেটিই আজকের বাগেরহাট। এখানে তিনি অসংখ্য মসজিদ, দিঘি, সড়ক ও মাজার নির্মাণ করেছিলেন। ধারণা করা হয় যে নয় গম্বুজ মসজিদটি ১৫শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে (প্রায় ১৪৫৯–১৪৬৯ খ্রিষ্টাব্দে) নির্মিত হয়েছিল। খান জাহান আলীর শাসনামলে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। যদিও সরাসরি তাঁর হাতে নির্মাণ নয়, তবে তাঁর তত্ত্বাবধান ও পৃষ্ঠপোষকতায় কাজটি হয়েছিল।

নয় গম্বুজ মসজিদ এর অবস্থান

নয় গম্বুজ মসজিদটি খান জাহান আলীর সমাধির খুব কাছাকাছি অবস্থিত। এটি বাগেরহাট শহরের পশ্চিমে অবস্থিত, প্রায় ৫০০ গজ দূরে খান জাহান আলীর মাজারের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। এই ভৌগোলিক অবস্থান থেকেই বোঝা যায়, মসজিদটি খান জাহান আলীর মাজার এলাকা তথা আধ্যাত্মিক কেন্দ্রকে ঘিরেই নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি সম্ভবত আশেপাশের মুসল্লিদের নামাজ আদায়ের জন্য ব্যবহার হতো।

নয় গম্বুজ মসজিদ এর স্থাপত্যশৈলী

নয় গম্বুজ মসজিদের স্থাপত্যশৈলীতে মুসলিম স্থাপত্যরীতির প্রভাব দেখা যায় এবং এর ছাদে রয়েছে নয়টি গম্বুজ। মসজিদটি পঞ্চদশ শতাব্দীতে নির্মিত বলে ধারণা করা হয়। এটি খান জাহান আলী কর্তৃক নির্মিত এবং তাঁর নগরের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর মধ্যে অন্যতম। নয় গম্বুজ মসজিদ বাংলা মুসলিম স্থাপত্যশৈলীর একটি অনন্য উদাহরণ। এর বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:

গম্বুজ বিন্যাস

নয় গম্বুজ মসজিদ এর গম্বুজ বিন্যাস হলো এর ভেতরের ইটের তৈরি চারটি স্তম্ভ দ্বারা ভাগ করা তিনটি ‘আইল’ ও তিনটি ‘বে’ এর প্রতিটির উপর একটি করে মোট নয়টি গম্বুজ। এই বিন্যাসটি মসজিদটিকে নয়টি ভাগে বিভক্ত করে। এই গম্বুজগুলি মূলত ইটের তৈরি এবং প্রতিটি স্তম্ভের উপর একটি করে গম্বুজ নির্মিত হয়েছে। এই স্থাপত্যশৈলী মসজিদের অভ্যন্তরভাগকে নয়টি পৃথক অংশে বিভক্ত করে, যেখানে প্রতিটি অংশের উপর একটি করে গম্বুজ বিদ্যমান। মাঝের গম্বুজটি অপেক্ষাকৃত বড়, আর বাকিগুলি অপেক্ষাকৃত ছোট।

গঠনকাঠামো

বাগেরহাটের নয় গম্বুজ মসজিদের গঠন কাঠামোর মূল বৈশিষ্ট্য হলো এর ছাদ জুড়ে থাকা নয়টি গম্বুজ। এটি একটি সাধারণ মসজিদ, যেখানে প্রধান প্রার্থনা কক্ষের উপরে সাতটি বাল্বযুক্ত গম্বুজ রয়েছে এবং মসজিদটি ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে খান জাহান আলী দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি আয়তাকার পরিকল্পনায় নির্মিত। এর দৈর্ঘ্য প্রায় ১৭.১ মিটার এবং প্রস্থ প্রায় ১৫.৮ মিটার। প্রাচীরগুলো অত্যন্ত পুরু (প্রায় ২.৪ মিটার), যা খান জাহানীয় স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য।

প্রবেশপথ

নয় গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাটে অবস্থিত এবং এটি খান জাহান আলীর মাজার-এর কাছাকাছি অবস্থিত। মসজিদটিতে প্রবেশ করার জন্য আপনাকে ঠাকুরদীঘির পশ্চিম তীর বরাবর যেতে হবে, কেননা মসজিদটি ঠিক সেখানেই অবস্থিত। পূর্ব দিকে তিনটি খিলান দরজা রয়েছে, উত্তর ও দক্ষিণ দিকেও একটি করে প্রবেশদ্বার আছে, সব দরজাগুলো খিলানাকৃতির এবং শক্তিশালী।

মেহরাব

নয় গম্বুজ মসজিদ, ষাট গম্বুজ মসজিদের কাছাকাছি অবস্থিত, একটি একক, আয়তক্ষেত্রাকার মেহরাব রয়েছে যা একটি অলঙ্কৃত খিলান। এটি কেন্দ্রীয় প্রার্থনা স্থানের পূর্ব দিকে অবস্থিত, যা সম্ভবত একটি ছোট মসজিদ। পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মেহরাব আছে। প্রধান মেহরাবটি মাঝখানে, যা সবচেয়ে বড় এবং সুন্দরভাবে অলংকৃত। মিহরাবগুলিতে টেরাকোটা নকশা ও খোদাইয়ের ব্যবহার দেখা যায়।

অলংকরণ

বাগেরহাটের নয় গম্বুজ মসজিদ এর মূল অলংকরণ মূলত এর স্থাপত্যশৈলী এবং পরিকল্পনার মধ্যেই নিহিত, যেখানে কালো পাথরের উপর বিশেষ নকশার অলংকরণ ও টেরাকোটা কাজের ব্যবহার দেখা যায়, যা একে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম চিত্তাকর্ষক মুসলিম স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত করেছে। বাহ্যিকভাবে স্থাপত্যটি অনেকটাই সরল, তবে ভেতরে টেরাকোটা অলংকরণ দেখা যায়। দেয়ালের গায়ে লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এবং ফুলের নকশার ব্যবহার আছে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

নয় গম্বুজ মসজিদটি শুধুমাত্র একটি স্থাপত্য নিদর্শনই নয়, এটি বাগেরহাটের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ইসলামিক স্থাপত্যের এক অমূল্য সম্পদ, যা এই অঞ্চলের শিকড়কে তুলে ধরে। এটি ইসলামী ঐতিহ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক সংরক্ষিত একটি ঐতিহাসিক স্থান। নয় গম্বুজ মসজিদ শুধু নামাজ পড়ার জায়গা নয়, বরং খানজাহান আলীর আধ্যাত্মিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে এটি ছিল একটি কেন্দ্রবিন্দু। এখানে মুসলমানরা শুধু ইবাদতই করতেন না, বরং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমও হতো।

অন্যান্য খানজাহানীয় স্থাপত্যের সঙ্গে তুলনা

বাগেরহাটে শতাধিক মসজিদের মধ্যে ষাট গম্বুজ মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, চিনি মসজিদ প্রভৃতি বিখ্যাত। নয় গম্বুজ মসজিদও এর মধ্যে অন্যতম। ষাট গম্বুজ মসজিদ অনেক বড় ও রাজকীয় হলেও নয় গম্বুজ মসজিদটি অপেক্ষাকৃত ছোট ও ঘনিষ্ঠ প্রকৃতির। এই স্থাপত্যে খান জাহানীয় নির্মাণশৈলীর সরলতা, গাম্ভীর্য ও ধর্মীয় বৈচিত্র্য স্পষ্ট।

সংরক্ষণ কার্যক্রম

বাগেরহাটের নয় গম্বুজ মসজিদের সংরক্ষণ কার্যক্রম মূলত বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে। এই অংশটি একটি সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন এবং এর তত্ত্বাবধান ও সংরক্ষণের দায়িত্ব অধিদপ্তর বহন করে থাকে। নয় গম্বুজ মসজিদ বর্তমানে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান—বাগেরহাট ঐতিহাসিক মসজিদ নগরীর অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এর সংরক্ষণ ও সংস্কার কাজ পরিচালনা করছে। দেয়ালের ক্ষয়রোধ, গম্বুজ মেরামত ও টেরাকোটা নকশা রক্ষায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও এটি বিকশিত হচ্ছে।

পর্যটন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব

নয় গম্বুজ মসজিদ মূলত এটি একটি স্থানীয় ঐতিহাসিক স্থাপনা, যার পর্যটন ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব মূলত এলাকাটিকে ঘিরে গড়ে ওঠা স্থানীয় পর্যটন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।  নয় গম্বুজ মসজিদ বাংলাদেশের ইতিহাসপ্রেমী ও বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়। প্রতিবছর হাজারো পর্যটক এখানে আসেন। এর ফলে স্থানীয় অর্থনীতি সক্রিয় হয় এবং বাগেরহাটকে একটি ঐতিহাসিক পর্যটন নগরী হিসেবে পরিচিতি দিয়েছে।

চ্যালেঞ্জ

মসজিদের অবকাঠামোকে প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, ঝড় এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ঐতিহাসিক কাঠামোর ক্ষতি না করে এর সংরক্ষণ ও রক্ষণাবেক্ষণে আধুনিক প্রযুক্তি (যেমন ড্রোন, থ্রিডি স্ক্যানিং) ব্যবহার করা প্রয়োজন, যা একটি অন্যতম চ্যালেঞ্জ।

ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

নয় গম্বুজ মসজিদ বাগেরহাটের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা মূলত এর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে পরিচিতি, ঐতিহাসিক গুরুত্ব, পর্যটন আকর্ষণ এবং স্থানীয় অর্থনীতির ওপর নির্ভরশীল। জাদুঘর এবং স্থানীয় অবকাঠামোর উন্নয়ন এই সম্ভাবনাকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা একে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ও পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করবে। যথাযথ সংরক্ষণ ও পর্যটন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নয় গম্বুজ মসজিদ কেবল একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের পরিচিতি বহুগুণ বাড়াতে পারে।

নয় গম্বুজ মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, বরং এটি মধ্যযুগীয় বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। এই মসজিদ আমাদের জানায়—কীভাবে ইসলামি স্থাপত্যশৈলী বাংলার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও স্থানীয় শিল্পরুচির সঙ্গে মিলেমিশে এক অনন্য ধারার সৃষ্টি করেছিল। খান জাহান আলীর হাত ধরে বাগেরহাটে যে ইসলামি সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল, নয় গম্বুজ মসজিদ সেই ধারার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

গম্বুজগুলির বিন্যাস, পুরু প্রাচীর, মেহরাবের অলংকরণ—সবকিছুই একদিকে যেমন ধর্মীয় শ্রদ্ধার প্রতীক, অন্যদিকে তেমনি শিল্প-সৌন্দর্যের প্রকাশ। এটি প্রমাণ করে যে মসজিদ নির্মাণ কেবল ইবাদতের জায়গা বানানোর উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এগুলোর মাধ্যমে সমাজে নান্দনিকতা, ঐক্য ও এক ধরনের আধ্যাত্মিক প্রশান্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল।

আজকের দিনে নয় গম্বুজ মসজিদ একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়কে সমৃদ্ধ করছে। এটি দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণ করছে এবং স্থানীয় অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করছে। তবে এর সবচেয়ে বড় গুরুত্ব হলো—এটি আমাদের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের অংশ।

যদি আমরা যথাযথভাবে এই মসজিদকে সংরক্ষণ করতে পারি, তবে এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাবে মধ্যযুগীয় বাংলার এক গৌরবময় অধ্যায়ের কথা। এটি প্রমাণ করে যে বাঙালি সমাজ কেবল কৃষিনির্ভর ছিল না, বরং ধর্মীয়, শিল্পকলা ও নগরায়নের দিক থেকেও অত্যন্ত উন্নত ছিল।

সবশেষে বলা যায়—নয় গম্বুজ মসজিদ শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, এটি একটি ঐতিহ্যের বাতিঘর, যা আমাদেরকে অতীতের সঙ্গে যুক্ত করে এবং ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর

ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটস: Historic Mosque City of Bagerhat

মুনতাসীর মামুন, বাংলাদেশের স্থাপত্য ইতিহাস

নাজমুল করিম, খান জাহান আলী ও বাগেরহাটের মসজিদসমূহ

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments