নীলগাই: তৃণভূমির এক অনন্য প্রতীক
নীলগাই (Nilgai),যার অর্থ ‘নীল গরু’ বা ‘নীল ষাঁড়’, এটি এশিয়ার বৃহত্তম হরিণ প্রজাতির একটি সদস্য এবং মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে পাওয়া যায়। যদিও স্থানীয়ভাবে এটিকে অনেক সময় গরুর প্রজাতি মনে করা হয়, বাস্তবে এটি হরিণ বা অ্যান্টিলোপ পরিবারের অন্তর্গত। বৈজ্ঞানিকভাবে এর নাম Boselaphus tragocamelus। পুরুষ নীলগাইদের গায়ের রঙ নীলচে ধূসর হওয়ায় এদের নামকরণ এমন হয়েছে। নারী ও ছানারা সাধারণত বাদামি বর্ণের হয়।
বিবরণ ও শারীরিক গঠন
নীলগাই একটি বড় ও সুঠামদেহী প্রাণী। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ সাধারণত ১.৫ থেকে ১.৭ মিটার (৫ থেকে ৫.৫ ফুট) উচ্চতা বিশিষ্ট এবং ওজন হতে পারে ১২০ থেকে ২৮০ কেজি পর্যন্ত। স্ত্রী নীলগাই সাধারণত কিছুটা ছোট হয়। পুরুষদের গায়ে একটি নীলচে ধূসর ছায়া দেখা যায়, যা একে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ও “ম্যাজেস্টিক” রূপ দেয়। পুরুষদের দুটি ছোট শিং থাকে, যেগুলি সোজা ও কাঁটাবিহীন হয়। শিং সাধারণত ১৫ থেকে ২৪ সেন্টিমিটার লম্বা হয়।
তাদের লম্বা গলা, খাড়া দাঁড়িয়ে থাকা গলা ও মাথা, এবং উঁচু কাঁধের কারণে এদের দেখতে কিছুটা ঘোড়া ও উটের সংমিশ্রণের মতো লাগে। পিছনের পা সামনের চেয়ে কিছুটা ছোট হওয়ায়, দাঁড়ালে বা চলার সময় একটি সামনের দিকে ঢালু দেহ গঠন দেখা যায়।
আবাসস্থল ও বিস্তার
নীলগাই মূলত ভারত, নেপাল, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের কিছু অংশে দেখা যায়, যদিও বাংলাদেশে এটি এখন প্রায় বিলুপ্তপ্রায়। এরা প্রধানত শুষ্ক তৃণভূমি, খোলা ঝোপঝাড়, এবং বনাঞ্চলের কিনারবর্তী এলাকায় বসবাস করতে পছন্দ করে। তবে এদের শহরাঞ্চল ও চাষাবাদকৃত জমিতেও দেখা যায়, বিশেষ করে যেখানে খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে।
ভারতের পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশে নীলগাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। কখনও কখনও এরা শীতকালে জঙ্গলের গভীরে চলে যায়, আবার গ্রীষ্মকালে পানি ও খাদ্যের খোঁজে বসতির কাছাকাছি চলে আসে।
আচরণ ও খাদ্যাভ্যাস
নীলগাই একটি দিবাচর প্রাণী, অর্থাৎ এরা মূলত দিনের বেলায় সক্রিয় থাকে। তারা সাধারণত ছোট ছোট দলবদ্ধভাবে চলাফেরা করে, যদিও প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের অনেক সময় একাকী দেখা যায়। স্ত্রী ও ছানারা মিলে ১০-১৫ জনের একটি দল গঠন করতে পারে।
এরা প্রধানত তৃণভোজী এবং গাছের পাতা, ঘাস, শস্যদানা, ফল এবং ঝোপঝাড় খেয়ে থাকে। শীতকালীন শুষ্ক মৌসুমে এরা পাতাঝরা গাছের পাতা ও শুকনো ঘাস খেয়ে থাকে। গ্রামাঞ্চলে এদের ফসল খাওয়ার প্রবণতার কারণে কৃষকদের সঙ্গে এদের দ্বন্দ্বও সৃষ্টি হয়।
প্রজনন ও বংশবৃদ্ধি
নীলগাই সারা বছর প্রজনন করতে সক্ষম হলেও, সাধারণত অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে প্রজনন বেশি দেখা যায়। গর্ভকাল প্রায় ৮ থেকে ৯ মাস। প্রতিবারে ১ থেকে ২টি ছানা জন্ম দিতে পারে। জন্মের সময় ছানারা বেশ সচল হয় এবং কয়েক ঘন্টার মধ্যেই মায়ের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে।
প্রাকৃতিক শত্রু ও হুমকি
প্রাকৃতিক পরিবেশে নীলগাইয়ের শত্রুর মধ্যে রয়েছে বাঘ, চিতা এবং বন্য কুকুর। তবে প্রাপ্তবয়স্ক নীলগাই এত বড় এবং শক্তিশালী হয় যে শুধুমাত্র শক্তিশালী শিকারিরাই এদের আক্রমণ করতে পারে।
মানুষের দ্বারা বাসস্থান ধ্বংস, ফসলক্ষেতে আক্রমণের কারণে হত্যাকাণ্ড, এবং রাস্তার গাড়ি দুর্ঘটনা এদের প্রধান হুমকি। তবে ভারতের অনেক রাজ্যে এদের “পবিত্র প্রাণী” মনে করা হয়, বিশেষ করে গরুর সঙ্গে সাদৃশ্যের কারণে, ফলে অনেক জায়গায় এদের হত্যা আইনত নিষিদ্ধ।
রক্ষণাবেক্ষণ ও সংরক্ষণ
নীলগাই বর্তমানে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (IUCN) এর “কম উদ্বেগ” (Least Concern) তালিকাভুক্ত প্রাণী হলেও, কিছু এলাকায় এদের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। তবে ভারতে এদের সংখ্যা তুলনামূলক স্থিতিশীল। কৃষকদের সঙ্গে সংঘাত এবং চাষাবাদের ক্ষতির কারণে কিছু রাজ্যে এদের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, যদিও সেটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সাংস্কৃতিক গুরুত্ব
নীলগাই শুধু একটি প্রাণীই নয়, বরং ভারতের গ্রামীণ সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুরাণ ও লোককথায় এই প্রাণীর উল্লেখ পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মে অনেক সময় এদের গরুর সঙ্গে তুলনা করা হয় এবং পবিত্র হিসেবে গণ্য করা হয়। অনেক সময় বনদেবতা বা গ্রামের রক্ষাকর্তা দেবতার বাহন হিসেবেও এদের চিত্রিত করা হয়েছে।
নীলগাই ভারতের প্রাকৃতিক ঐশ্বর্যের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর সৌন্দর্য, আকার, গাম্ভীর্য এবং ঐতিহাসিক-সাংস্কৃতিক তাৎপর্য একে অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আলাদা করে তোলে। এই প্রাণীটি ভারতীয় তৃণভূমির জীববৈচিত্র্যের এক প্রতীকস্বরূপ। আমাদের উচিত এই প্রাণীটির জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষা করা এবং গ্রামীণ জনজীবনের সঙ্গে এদের সহাবস্থান নিশ্চিত করা।
তথ্যসূত্র:
IUCN Red List
“Mammals of South Asia” – Cambridge University Press
India Biodiversity Portal
National Geographic India