মমিকরণ প্রক্রিয়া
মমিকরণ (Mummification) হলো একটি জটিল ও পদ্ধতিগত প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে মৃতদেহকে দীর্ঘ সময় ধরে সংরক্ষণযোগ্য করে তোলা হয়। এই প্রক্রিয়া মূলত প্রাচীন মিশরে সর্বাধিক জনপ্রিয় হলেও, বিশ্বের বিভিন্ন প্রাচীন সভ্যতায়ও মমিকরণের নানা রকম কৌশল গড়ে উঠেছিল। তবে মিশরীয় মমিকরণ পদ্ধতি ছিল সবচেয়ে পরিশীলিত এবং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে গভীরভাবে অন্তর্নিহিত।
মমিকরণ প্রাকৃতিকভাবে ঘটতে পারে অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে করা যেতে পারে। প্রাচীন মিশরীয়রা অনেক মানুষ এবং প্রাণীর (যেমন বিড়াল, কুকুর এবং পাখি) মমিকরণ করত। প্রাকৃতিক মমিকরণ বিরল, তবে মাঝে মাঝে এমন অঞ্চলে ঘটে যেখানে অম্লীয় , খুব ঠান্ডা এবং বাতাস বইছে, অথবা খুব গরম এবং শুষ্ক। প্রতিটি মহাদেশে উভয় ধরণের মমি (মানব এবং প্রাণীর মমি সহ) পাওয়া গেছে ।
প্রাচীন মিশরের বিশ্বাস ও মমিকরণের প্রয়োজনীয়তা
প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতেন, মৃত্যুর পর আত্মা ও জীবনীশক্তি পরকালীন জীবনে প্রবেশ করে, কিন্তু দেহটি অক্ষত না থাকলে আত্মা পুনরায় দেহে ফিরে আসতে পারবে না। ফলে মৃতদেহকে অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়োজন ছিল। এটি থেকেই মমিকরণের জন্ম।
মমিকরণ প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ
প্রাচীন মিশরে একটি পূর্ণাঙ্গ মমিকরণ প্রক্রিয়া প্রায় ৭০ দিন পর্যন্ত চলত। নিচে প্রক্রিয়াটি ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো:
ধোয়া ও প্রস্তুতি
মৃতদেহকে প্রথমে বিশুদ্ধ নীল নদীর পানি ও পামওয়াইন দিয়ে পরিষ্কার করা হতো। এরপর দেহটি একটি ঢালু পাথরের টেবিলে রেখে কাজ শুরু হতো।
মস্তিষ্ক অপসারণ
মস্তিষ্ককে মূল্যহীন বলে গণ্য করা হতো। বিশেষ ধাতব হুকের মাধ্যমে নাকের ছিদ্র দিয়ে মস্তিষ্কের টিস্যু বের করে ফেলা হতো। তারপর খালি খুলি কপার দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করা হতো।
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অপসারণ
বুকের বাম পাশ কেটে পাকস্থলী, যকৃত, ফুসফুস ও অন্ত্রসহ প্রধান অভ্যন্তরীণ অঙ্গগুলি বের করে নেওয়া হতো। এসব অঙ্গকে সংরক্ষণের জন্য “ক্যানোপিক জার” নামক চারটি পাত্রে রাখা হতো। প্রতিটি পাত্র একেকজন দেবতার প্রতিনিধিত্ব করতো—আইমসেটি, ডুওয়ামুটেফ, হ্যাপি ও কেবেহসেনুএফ।
হৃদয়কে কখনো কখনো রেখে দেওয়া হতো কারণ এটিকে আত্মার কেন্দ্রবিন্দু মনে করা হতো। তবে কিছু সময়ে হৃদয়ও সরিয়ে কৃত্রিম পাথরের হৃদয় রাখা হতো।
নাট্রনের মাধ্যমে শুকানো
অঙ্গ সরানোর পর শরীরকে নাট্রন (এক ধরনের প্রাকৃতিক লবণের মিশ্রণ) দিয়ে পূর্ণ করে দিতো এবং নাট্রনের মধ্যে সম্পূর্ণ দেহটি রেখে দেওয়া হতো প্রায় ৪০ দিন ধরে। এই সময়ে দেহের সমস্ত আর্দ্রতা শুকিয়ে যেত এবং ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যেত।
মরদেহের পুনর্গঠন
শুকানোর পর দেহটি নাট্রন থেকে বের করে ফেলা হতো এবং কৃত্রিমভাবে চোখে পাথর বা পেঁচানো কাপড় বসানো হতো। বুক ও পেটের ফাঁকা জায়গাগুলো কাঠ, কাপড়, মাটি কিংবা কর্পূর দিয়ে ভরাট করা হতো যাতে দেহটি জীবিত অবস্থার মতো দেখতে লাগে।
মৃতদেহে সুগন্ধি প্রয়োগ ও মোড়ানো
দেহে মোম ও সুগন্ধি তেল প্রয়োগ করে মৃতদেহকে মোড়ানো হতো লিনেন কাপড় দিয়ে। এই মোড়ানো ছিল একটি পবিত্র ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একেকটি আঙুল আলাদা করে মোড়ানো হতো, মুখ, হাত ও পা বিশেষ যত্নে মোড়ানো হতো। মাঝে মাঝে মন্ত্রোচ্চারণ ও জাদুবিদ্যার প্রতীক হিসেবে তাবিজ, স্কারাব বিটল ইত্যাদি কাপড়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হতো।
মৃতদেহের মুখ উন্মোচন অনুষ্ঠান (Opening of the Mouth)
এই একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আচার যেখানে মমির মুখে একটি বিশেষ কাঠি ব্যবহার করে মুখ ‘খুলে দেওয়া’ হতো যাতে আত্মা পরজগতে খাওয়া-দাওয়া করতে পারে। এই আচারটি পুরোহিত দ্বারা সম্পাদিত হতো।
সারকোফেগাসে সংরক্ষণ ও সমাধিস্থান
মোড়ানো মমিকে প্রথমে কাঠ বা পাথরের একটি অভ্যন্তরীণ কফিনে এবং তারপর বাহ্যিক সাজানো কফিনে (সারকোফেগাস) রাখা হতো। এরপর মমিকে পিরামিড বা সমাধিক্ষেত্রে অন্যান্য গয়না, খাবার, সেবা ও প্রয়োজনীয় সামগ্রীর সাথে কবর দেওয়া হতো, যেন পরজীবনে এগুলো তার কাজে লাগে।
ব্যবহৃত উপকরণসমূহ
নাট্রন লবণ – শুকানোর জন্য
লিনেন কাপড় – মোড়ানোর জন্য
তেল ও গন্ধদ্রব্য – সংরক্ষণ ও সুগন্ধির জন্য
তাবিজ ও প্রতীক – ধর্মীয় রক্ষার জন্য
ক্যানোপিক জার – অভ্যন্তরীণ অঙ্গ সংরক্ষণের জন্য
অন্যান্য সভ্যতায় মমিকরণ
চিলির চিনচোরো সংস্কৃতি (৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): মিশরেরও আগে মানুষের মমি বানাতো, কাদামাটি ও কাপড় ব্যবহার করে।
ইনকা সভ্যতা: পবিত্র ও রাজকীয় মৃতদেহকে পর্বতের গুহায় সংরক্ষণ করত।
তিব্বত ও মঙ্গোলিয়া: “স্কাই বারিয়াল” ও সংরক্ষণের ভিন্ন রীতি।
চীন ও জাপান: কিছু বৌদ্ধ সন্ন্যাসী স্ব-সংরক্ষণের মাধ্যমে মমি হয়ে থাকতেন (Sokushinbutsu)।
আধুনিক গবেষণা ও মমিকরণের গুরুত্ব
আজকের দিনে, মমিকরণ পদ্ধতি ইতিহাস, আর্কিওলজি, এবং জীববিজ্ঞান চর্চার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। আধুনিক স্ক্যানিং পদ্ধতি, যেমন CT scan ও DNA বিশ্লেষণের মাধ্যমে মমির অন্তর্গত রোগ, খাদ্যাভ্যাস, বংশানুক্রমিক তথ্য জানা সম্ভব হয়েছে।
মমিকরণ শুধুই মৃতদেহ সংরক্ষণের একটি কৌশল নয়; এটি ছিল বিশ্বাস, ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির এক অনন্য সম্মিলন। প্রাচীন মিশরীয়দের এই জটিল এবং ধর্মীয় রীতি আমাদের মানব সভ্যতার ইতিহাসে এক অমর চিহ্ন রেখে গেছে। আজও মমিগুলি প্রাচীন সভ্যতার এক জীবন্ত দলিল হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে,যা আমাদের অতীতকে বুঝতে সাহায্য করে।
তথ্যসূত্র:
The British Museum
National Geographic
History Channel
Encyclopedia Britannica
Egyptian Ministry of Antiquities