মুড় সাংস্কৃতি: এক বৈচিত্র্যপূর্ণ ঐতিহ্য
মুড় বা মুরিশ (Moorish) সাংস্কৃতি হলো এক অসাধারণ ঐতিহ্য যা মূলত উত্তর আফ্রিকার বারবার এবং আরব জনগোষ্ঠীর ইসলামিক সংস্কৃতির সাথে মিশে স্পেন, পর্তুগাল এবং দক্ষিণ ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল।
৭১১ খ্রিস্টাব্দে টারিক ইবনে জিয়াদের নেতৃত্বে মুরিশরা ইবেরিয়ান উপদ্বীপে (আজকের স্পেন ও পর্তুগাল) প্রবেশ করে এবং প্রায় ৮০০ বছর ধরে তারা অঞ্চলটি শাসন করে। এই দীর্ঘ সময়কালে তারা শুধুমাত্র রাজনৈতিক শক্তি অর্জন করেনি, বরং এক অসামান্য সাংস্কৃতিক, স্থাপত্য, বিজ্ঞান ও শিল্পকলা আন্দোলনের সূচনা করেছিল যা ইউরোপের রেনেসাঁর পথপ্রদর্শক ছিল।
উৎপত্তি ও পরিচিতি
মুড় শব্দটি এসেছে ল্যাটিন “Mauri” থেকে, যা মূলত উত্তর আফ্রিকার মাওরিটানিয়া অঞ্চলের অধিবাসীদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। মধ্যযুগে এই শব্দটি আরব, বারবার ও মুসলিম আফ্রিকান জনগোষ্ঠীর সমন্বিত পরিচয় বোঝাতে ব্যবহৃত হত যারা ইউরোপে প্রবেশ করে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন। এদের প্রধান কেন্দ্র ছিল আন্দালুসিয়া (বর্তমান স্পেনের দক্ষিণাংশ), যেখানে তারা আল-আন্দালুস নামে এক সমৃদ্ধ শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলে।
ধর্ম ও দার্শনিক চিন্তা
মুরিশ সমাজ ছিল মূলত ইসলামভিত্তিক। তবে এরা ধর্মীয় সহনশীলতায় বিশ্বাসী ছিল এবং ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সুরক্ষা দিত। এই ‘ধিম্মি’ ব্যবস্থা সমাজে বহুসাংস্কৃতিক সহাবস্থান সৃষ্টি করে। ইসলামি ধর্মচিন্তার পাশাপাশি মুরিশ সমাজে গ্রিক ও রোমান জ্ঞান, দর্শন এবং বিজ্ঞানকেও সম্মান করা হতো। তারা গ্রিক দার্শনিকদের লেখাকে অনুবাদ ও ব্যাখ্যা করে ইউরোপে নতুন জ্ঞানের সঞ্চার ঘটায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অগ্রগতি
মুরিশদের প্রভাবিত অঞ্চলগুলো ছিল শিক্ষা ও গবেষণার কেন্দ্র। কর্ডোবা, সেভিলা, ও গ্রানাডার মতো শহরগুলোতে বিশাল গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও বিশ্ববিদ্যালয় ছিল। আল-আন্দালুসে জ্যোতির্বিজ্ঞান, গণিত, চিকিৎসাবিজ্ঞান, রসায়ন ও কৃষি বিজ্ঞানে অসাধারণ উন্নতি ঘটে।
আল জাহরাভি ছিলেন মুরিশ চিকিৎসা বিজ্ঞানের পথিকৃত।
আল-কিন্দি, আল-ফারাবি ও ইবনে রুশদ (Averroes) এর দর্শন ইউরোপীয় রেনেসাঁর উপর গভীর প্রভাব ফেলে।
আল-ইদরিসির মানচিত্রবিদ্যা বিশ্ব ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে।
ভাষা ও সাহিত্য
মুরিশরা আরবি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করলেও স্প্যানিশ ভাষাতেও প্রভাব ফেলেছিল। বহু আরবি শব্দ স্প্যানিশে প্রবেশ করে যেমন – “almohada” (বালিশ), “aceituna” (জলপাই), “azúcar” (চিনি)।
আল-আন্দালুসে গজল ও কবিতা ছিল জনপ্রিয়, যা পরবর্তীতে স্প্যানিশ কবিতায় প্রভাব ফেলে। আন্দালুসিয়ান কবি ইবনে হাযমের “The Ring of the Dove” প্রেম ও হৃদয় বিদারক অভিজ্ঞতার এক অসাধারণ সাহিত্যিক নিদর্শন।
স্থাপত্য ও শিল্পকলা
মুরিশ স্থাপত্য ছিল দৃষ্টিনন্দন ও অত্যন্ত জটিল। তাদের কাজের মধ্যে জ্যামিতিক নকশা, অ্যারাবেস্ক ডিজাইন, কলাম ও খিলান ছিল উল্লেখযোগ্য।
বিশ্বখ্যাত কিছু মুরিশ স্থাপত্য:
আলহামব্রা প্রাসাদ (গ্রানাডা): অলংকরণ ও সৌন্দর্যে অতুলনীয়, যা রাজকীয় ও ধর্মীয় স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন।
মস্ক অব কর্ডোবা (Mezquita): এক ধর্মীয় সিম্বোল যেখানে ইসলাম ও খ্রিস্টান স্থাপত্য একত্রে বিরাজমান।
গিরালদা মিনার (সেভিলা): ইসলামিক মিনার যা পরবর্তীতে গির্জার অংশে পরিণত হয়।
সংগীত ও নৃত্য
মুরিশ সংগীতে প্রাচ্যরীতি, আরব লাউড (oud), তবলা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হত। এদের সুর পরবর্তীতে স্পেনীয় ফ্লামেঙ্কো সংগীতের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। অনেক গবেষক মনে করেন যে ফ্লামেঙ্কোর উৎপত্তি মুরিশ, আন্দালুসিয়ান ও ঘাতানো সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে।
পোশাক ও খাদ্য
মুরিশ পোশাকে ছিল হালকা কাপড়, টুপি (টার্বান), লম্বা আলখাল্লা, যা পরে ইউরোপীয় অভিজাতদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
খাবারের ক্ষেত্রে তারা আনারস, সাইট্রাস ফল, জলপাই তেল, চাল ও মসলা ব্যবহার শুরু করে যা ইউরোপে নতুন রন্ধনশৈলীর সূচনা করে।
মুড় সংস্কৃতির পতন ও উত্তরাধিকার
১৪৯২ সালে গ্রানাডা পতনের মাধ্যমে আল-আন্দালুসে মুরিশ শাসনের অবসান ঘটে। ক্যাথলিক রাজারা মুসলমান ও ইহুদিদের জোরপূর্বক ধর্মান্তর বা দেশত্যাগে বাধ্য করে। যদিও অনেক কিছু ধ্বংস করা হয়, মুরিশ সাংস্কৃতির চিহ্ন আজও স্পেন ও ইউরোপে রয়ে গেছে।
আধুনিক ইউরোপীয় বিজ্ঞান, স্থাপত্য, রন্ধনশৈলী, ভাষা ও দর্শনে মুরিশদের অবদান অনস্বীকার্য।
মুরিশ সাংস্কৃতি এক স্বর্ণযুগের প্রতিচ্ছবি যা শুধু মুসলিম বিশ্ব নয় বরং সমগ্র ইউরোপীয় ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে। জ্ঞান, বিজ্ঞান, সৌন্দর্য ও সহনশীলতার যে ধারাটি তারা রেখে গেছেন, তা আজও বিশ্বের বিভিন্ন অংশে প্রতিফলিত হয়। মুরিশরা ছিলেন এক অনন্য সংস্কৃতির বাহক, যাদের উত্তরাধিকার যুগে যুগে মানব সভ্যতার বিবর্তনে আলোকবর্তিকা হয়ে রয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
Fletcher, R. (2006). Moorish Spain.
Kennedy, H. (1996). Muslim Spain and Portugal: A Political History of al-Andalus.
Bloom, J. & Blair, S. (2003). Islam: A Thousand Years of Faith and Power.
Encyclopedia Britannica – “Moors and Al-Andalus”.