মেসোপটেমিয়া সভ্যতা
মেসোপটেমিয়া, যার অর্থ “নদীর মধ্যবর্তী দেশ”(গ্রিক ভাষায় meso = মধ্যবর্তী, potamos = নদী),বর্তমান ইরাক এবং সিরিয়ার অংশজুড়ে অবস্থিত এক প্রাচীন অঞ্চল। এটি টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ্যবর্তী এলাকায় গড়ে ওঠা পৃথিবীর প্রথম কিছু সভ্যতার জননী।মেসোপটেমিয়া হল প্রায় ১০,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের নবোপলীয় বিপ্লবের প্রাচীনতম বিকাশের স্থান ।
এটি “মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু উন্নয়নের অনুপ্রেরণা হিসেবে চিহ্নিত,যার মধ্যে রয়েছে চাকা আবিষ্কার,প্রথম শস্য ফসল রোপণ ,কার্সিভ লিপির বিকাশ,গণিত,জ্যোতির্বিদ্যা এবং কৃষি “। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম কিছু সভ্যতার জন্মস্থান হিসেবে স্বীকৃত।
মেসোপটেমিয়া সভ্যতা পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতার অন্যতম। খ্রিস্টপূর্ব ৩১০০ হতে খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৫৩৯ মধ্যে মেসোপটেমিয়ায় অতি উন্নত এক সভ্যতার উন্মেষ ঘটেছিল। সভ্যতার আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত এই অঞ্চল মিশরীয় সভ্যতার থেকে অনেকটাই ভিন্ন ছিল এবং বহিঃশত্রুদের থেকে খুব একটা সুরক্ষিত ছিল না বলে বারবার এর উপর আক্রমণ চলতে থাকে এবং পরবর্তীতে এখান থেকেই ব্রোঞ্জ যুগে আক্কাদীয়, ব্যবিলনীয়,আসিরীয় ও লৌহ যুগে নব্য-আসিরীয় এবং নব্য-ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে উঠে।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫০ সালের দিকে মেসোপটেমিয়া পার্সিয়ানদের নিয়ন্ত্রণেই ছিল কিন্তু পরে এই ভূখণ্ডের আধিপত্য নিয়ে রোমানদের সাথে যুদ্ধ হয় এবং রোমানরা এই অঞ্চল ২৫০ বছরের বেশি শাসন করতে পারে নি॥ দ্বিতীয় শতকের শুরুর দিকে পার্সিয়ানরা এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় এবং সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত এই অঞ্চল তাদের শাসনেই থাকে, এরপর মুসলিম শাসনামল শুরু হয়। মুসলিম খিলাফত শাসনে এই অঞ্চল পরবর্তীতে ইরাক নামে পরিচিতি লাভ করে।
ভূগোল ও কৃষির ভিত্তি
মেসোপটেমিয়ার ভূপ্রকৃতি ছিল উর্বর সমভূমি, কারণ প্রতিবছর টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদী প্লাবন ঘটিয়ে নতুন পলিমাটি এনে দিত। তবে এ অঞ্চল ছিল অল্প বৃষ্টিপাতপ্রাপ্ত,তাই কৃষির জন্য নির্ভর করতে হতো সেচব্যবস্থার ওপর। প্রাচীন মেসোপটেমীয়রা ক্যানেল,বাঁধ ও জলাধার নির্মাণ করে কৃষিকে সমৃদ্ধ করেন। তারা গম,যব,খেজুর,ডাল ও বিভিন্ন ফলমূল চাষ করতেন। গবাদি পশুপালনও ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান সভ্যতা ও নগরসমূহ
সুমের (Sumer): খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ সালের দিকে দক্ষিণ মেসোপটেমিয়ায় সুমেরীয়রা প্রথম শহর-রাষ্ট্র (City-State) গঠন করে। উর, উরুক, লাগাশ, কিশ — এই শহরগুলো ছিল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কেন্দ্র। উরুক শহরেই লেখা ও পাথরের স্থাপত্যের প্রাথমিক নিদর্শন পাওয়া যায়। সুমেরীয়রা আবিষ্কার করেন কিউনিফর্ম (Cuneiform) নামক লিখনপদ্ধতি।
আক্কাড (Akkad): খ্রিস্টপূর্ব ২৩৩৪ সালে সর্গন (Sargon the Great) সুমের এবং আশেপাশের অঞ্চল একত্র করে প্রথম সাম্রাজ্য গঠন করেন — আক্কাডীয় সাম্রাজ্য। এটি ইতিহাসের প্রথম বৃহৎ কেন্দ্রীয় শাসিত সাম্রাজ্য হিসেবে পরিচিত।
ব্যাবিলন (Babylon): খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকে হাম্মুরাবির নেতৃত্বে ব্যাবিলন নগর উত্থিত হয়। তিনি “হাম্মুরাবির বিধিসংহিতা” নামে বিখ্যাত আইন সংকলন করেন, যেটি পৃথিবীর প্রাচীনতম আইনি নথি হিসেবে বিবেচিত। ব্যাবিলন ছিল জ্যোতির্বিদ্যা, গণিত ও সাহিত্য চর্চার কেন্দ্র।
আশুর (Assur): উত্তর মেসোপটেমিয়ায় গড়ে ওঠা আশুরীয় সাম্রাজ্য ছিল একটি সামরিক শক্তিধর রাজ্য। তারা যুদ্ধজয়ী, কঠোর শাসনব্যবস্থা ও প্রশাসনিক দক্ষতার জন্য খ্যাত। খ্রিস্টপূর্ব ৭ম শতকে আশুরবানিপাল রাজা বিশাল গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে হাজার হাজার কিউনিফর্ম ফলক সংরক্ষিত ছিল।
ধর্ম ও দেবতা
প্রতিটি শহরের ছিল নিজস্ব উপাস্য দেবতা। যেমন উর শহরের প্রধান দেবতা ছিলেন নানা (চাঁদের দেবতা), ব্যাবিলনের ছিল মারদুক, আশুরের ছিল আশুর। দেবতারা প্রকৃতি ও মানবজীবনের নানা দিক যেমন বৃষ্টি,যুদ্ধ,প্রেম ও মৃত্যু নিয়ন্ত্রণ করতেন বলে বিশ্বাস করা হতো।
জিগুরাত (Ziggurat) নামক সোপানাকৃতির বিশাল মন্দির ছিল দেবতাদের আরাধনার স্থান। এগুলি ছিল শহরের কেন্দ্রবিন্দু এবং ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র। মেসোপটেমিয়ানদের বিশ্বাস ছিল যে পৃথিবী একটি বিশাল ফাঁকবিশিষ্ট স্থানে অবস্থিত একটি গোলাকার চাকতি। তারা আরও বিশ্বাস করত যে আকাশে স্বর্গ এবং মাটির নিচে রয়েছে নরক। পানি সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল যে পৃথিবী পানি দিয়েই তৈরী এবং এর চারপাশজুড়ে পানিই আছে।
প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানরা বহুইশ্বরবাদে বিশ্বাসি ছিলো তবে সময়ের ধারার সাথে কিছু কিছু গোষ্ঠির ধর্মমত পরিবর্তীত হতে শুরু করে। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ানদের মধ্যে বিভিন্ন দেবদেবির মূর্তিপূজার প্রমাণ পাওয়া যায়।
ধর্ম পালনের দিক দিয়ে মেসোপমিয়া সভ্যতার মানুষেরা অনেক অগ্রগামী ছিলো। প্রতিটি জিগুরাট ও মন্দিরেই বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষ যেমন ধনি, দরিদ্র, ব্যবসায়ী,কামার,মজুরটে,কৃষক ইত্যাদি শ্রেণীর লোকেদের বসার ব্যবস্থা ছিল। এসব লোকজন যার যার নিজস্ব জায়গায় গিয়ে নগরদেবতাদের প্রনামভক্তি ও বিভিন্ন জিনিস উৎসর্গ করত। এতে এই সভ্যতার সার্বজনীন ধর্মব্যবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়।
ভাষা
মেসোপটেমীয়রা যে বা ভাষায় কথা বলত তাকে সেমিটিক ভাষা হিসেবে ইতিহাসবিদরা চিহ্নিত করেছেন। তাদের এই ভাষায় দৈনন্দিন ভাবের আদান প্রদান সহ বিজ্ঞানচর্চা, প্রশাসনিক কাজে এবং ধর্মকর্ম পরিচালনা করত। মেসোপোটেমীয়দের প্রধান কৃতিত্ব হল প্রয়োজনীয় ভাব বা বার্তা বোঝানোর জন্য আদিম লেখন পদ্ধতির উদ্ভাবন। প্রথম দিকে এই ভাষা কিছু অর্থবোধক ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করা হত।
চিত্রধর্মী এই পদ্ধতিকে বিজ্ঞানীরা পীকটোগ্রাফি বলে থাকেন। মেসোপটেমীয়রা প্রধানত কাদামাটির উপর নলখাগড়ার সূচালো মাথা দিয়ে লিখে শুকিয়ে নিত কিন্তু পরবর্তীকালে তা আরো পরিশীল হয়ে বর্ণমালায় রূপ নেয়। আনুমানিক ৩৪০০ খৃষ্টপূর্ব অব্দের এই বর্ণমালার মাধ্যমে লিখিত দলিল পাওয়া যায়। সেই সময়ের লেখালেখি শুধুমাত্র হিসাব নিকাশ সংরক্ষণের কাজে ব্যবহার হত। আধুনিক যে দফতরীয় দলিল দেখতে পাওয়া যায় তা সুমেরীয়দের মধ্যেই প্রথম দেখা যায়।
সাহিত্যের জন্য মেসোপটেমীয়রা যে ভাষা ব্যবহার করত তাকে বিজ্ঞানীরা হেমেটিক ভাষা বলে চিহ্নিত করেছেন। প্রখ্যাত লেখক হোমার তার ইলিয়াড এবং ওডেসি লেখার ও প্রায় এক হাজার বছর পূর্বে সুমেরীয়রা তাদের নিজস্ব ভাষায় সাহিত্য রচনা করেছিল। এর নাম ছিল গিলগামেশ। এই সাহিত্য থেকে জানা যায় যে এখানকার লোকজন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ ছিলো। ব্যাবিলোনীয় শাসন আমলে তাদের লেখালেখিতে পরলৌকিক চিন্তার প্রভাব লক্ষ্যণীয়। বস্তুত এইগুলো ছিল ধর্মাশ্রয়ী সাহিত্যচিন্তা।
সমাজব্যবস্থা ও আইন
মেসোপটেমিয়ান সমাজ ছিল শ্রেণিভিত্তিক:
শীর্ষে ছিল রাজা, পুরোহিত ও অভিজাত শ্রেণি
এরপর ছিল সাধারণ কৃষক ও কারিগর
নিম্নস্তরে ছিল দাস ও যুদ্ধবন্দি
হাম্মুরাবির বিধিসংহিতা সমাজে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল। এই বিধিতে “চোখের বদলে চোখ” নীতির (Lex Talionis) প্রতিফলন দেখা যায়, যদিও এটি শ্রেণি অনুসারে ভিন্নভাবে প্রয়োগ হতো।
বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি
লিখনপদ্ধতি: সুমেরীয় কিউনিফর্ম ছিল পাঁপড়ি-আকৃতির চিহ্নে খোদাই করা একটি লিখনরীতি। এটি কাদামাটির ফলকে লিপিবদ্ধ করা হতো এবং প্রায় ২০০০ বছরের বেশি সময় ব্যবহৃত হয়েছে।
গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা: মেসোপটেমীয়রা ৬০ ভিত্তিক সংখ্যা পদ্ধতি ব্যবহার করত, যার ফলে আধুনিক সময় গণনা (৬০ সেকেন্ড = ১ মিনিট) এবং কোণ পরিমাপ (৩৬০°) এসেছে। তারা জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ পারদর্শী ছিল, চন্দ্র মাসের গণনা ও গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ক্যালেন্ডার তৈরি করত।
সাহিত্য: মেসোপটেমিয়ার সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম হলো “গিলগামেশের মহাকাব্য” (Epic of Gilgamesh)। এটি বিশ্বের প্রাচীনতম মহাকাব্য, যেখানে জীবনের অর্থ,বন্ধুত্ব এবং মৃত্যুর অমোচনীয়তা নিয়ে কাব্যিক আলোচনা রয়েছে।
পতনের কারণ
মেসোপটেমিয়ার সভ্যতা বহু শতাব্দী ধরে বিকাশ লাভ করলেও বিভিন্ন কারণে তা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়:
বারবার বিদেশি আক্রমণ (হিট্টাইট,পার্সিয়ান, গ্রিক ও অবশেষে মুসলিম বিজয়)
পরিবেশগত অবক্ষয় ও নদীপথ পরিবর্তন
রাজনৈতিক বিভাজন ও অন্তর্দ্বন্দ্ব
মেসোপটেমিয়ার উত্তরাধিকার
মেসোপটেমিয়া শুধু প্রাচীন ইতিহাসের একটি অধ্যায় নয়, বরং সমগ্র মানবসভ্যতার ভিত্তিভূমি। আধুনিক শহর-পরিকল্পনা, আইনের শাসন, প্রশাসন, সময় গণনা, শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ধর্মীয় ধারণা—সবকিছুর মধ্যে এই সভ্যতার ছাপ রয়েছে।
মেসোপটেমিয়া ছিল মানব ইতিহাসের প্রথম ‘নাগরিক সভ্যতা’। সুমেরীয়দের প্রথম শহর,ব্যাবিলনের আইনি ব্যবস্থা, আশুরীয়দের সামরিক দক্ষতা এবং তাদের লিখিত সাহিত্য—সবকিছু মিলিয়ে এটি একটি বিস্ময়কর ও মৌলিক সভ্যতা। মেসোপটেমিয়া আমাদের শেখায়, সভ্যতা কিভাবে গড়ে ওঠে এবং ইতিহাস কিভাবে মানুষের চিন্তা, ধর্ম, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিকে গঠিত করে।
তথ্যসূত্র:
Kramer, S.N. History Begins at Sumer
Bertman, Stephen. Handbook to Life in Ancient Mesopotamia
British Museum Archives on Mesopotamian Civilization