Friday, October 3, 2025
Homeসমাজমায়া মূর্তি আবিষ্কার: প্রাচীন শিল্প, ধর্ম ও সমাজের জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি

মায়া মূর্তি আবিষ্কার: প্রাচীন শিল্প, ধর্ম ও সমাজের জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি

মায়া মূর্তি আবিষ্কার: প্রাচীন শিল্প, ধর্ম ও সমাজের জ্যান্ত প্রতিচ্ছবি

মধ্য আমেরিকার প্রাচীনতম ও অন্যতম বিস্ময়কর সভ্যতা হলো মায়া সভ্যতা। এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল মূলত আজকের মেক্সিকো, গুয়াতেমালা, বেলিজ, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরের কিছু অংশজুড়ে। মায়ারা ছিলো এক অসাধারণ জ্যোতির্বিদ, স্থ্যপতি ও ভাস্কর। তাদের ভাস্কর্যশিল্পের অন্যতম আকর্ষণীয় নিদর্শন হচ্ছে মূর্তি। এই মূর্তিগুলো কেবল সৌন্দর্যের প্রতীক নয়, বরং ধর্ম, রাজনীতি, সমাজব্যবস্থা এবং ইতিহাসের অমূল্য তথ্যবাহক। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে পাওয়া মায়া মূর্তিগুলো আজ আমাদের সেই অতীতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, যা হাজার বছর ধরে মাটির নিচে লুকিয়ে ছিলো।

মায়া মূর্তির বৈশিষ্ট্য ও ধরণ

মায়া মূর্তিগুলো সাধারণত তৈরি হত চুনাপাথর, বেসাল্ট, পোড়ামাটি, এমনকি কাঠ দিয়েও। এদের বেশিরভাগই:

পূজা বা বলির উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হত,

রাজা বা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিকৃতি ছিলো,

কিংবা পৌরাণিক দেবতা ও প্রাণীর রূপে তৈরি করা হত।

এগুলোর কিছু দাঁড়িয়ে থাকা স্টেলা (স্তম্ভের মতো খোদাইচিত্র), আবার কিছু বসা বা আধাশোয়া মানবমূর্তি। অনেক মূর্তিতে মায়া লিপি খোদাই করা থাকতো, যাতে রাজাদের নাম, দিনপঞ্জি, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি উল্লেখ থাকতো।

কোথা থেকে এই মূর্তিগুলি আবিষ্কৃত হয়েছিলো?

১. Copán (হন্ডুরাস)
Copán হচ্ছে মায়া সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর। এখানকার খননে আবিষ্কৃত হয়েছে শতাধিক স্টেলা (Stelae) – বিশালাকার খোদাইকৃত স্তম্ভ। স্টেলা ৪, ৬ এবং ১৩-এ রাজা “১৮ খাস টুন” এর মুখচ্ছবি খোদাই করা হয়েছে। এসব মূর্তিতে তাঁর শাসনকাল, ধর্মীয় অনুশীলন ও জ্যোতির্বিদ্যা বিষয়ক বার্তা খোদাই করা আছে। এগুলোর উচ্চতা প্রায় ৩-৫ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে এবং খোদাই করা অলঙ্কার ও পোশাকের সূক্ষ্মতা সত্যিই আমাদের অবাক করে।

২. Tikal (গুয়াতেমালা)
এটি ছিলো একটি বিশাল শহর। এখানে অনেক মন্দির এবং বেদির কাছে পাওয়া গেছে পাথরের মূর্তি, যেগুলিতে দেখা যায় রাজা বলি উৎসর্গ করছেন, যোদ্ধারা যুদ্ধ করছে অথবা পুরোহিতরা ধর্মীয় আচার পালন করছেন। একটি মূর্তিতে রাজাকে চাঁদের দেবতার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, যা থেকে বোঝা যায় ধর্ম ও রাজনীতির কতটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো।

৩. Palenque (মেক্সিকো)
এখানে “পাকাল দ্য গ্রেট”-এর সমাধি আবিষ্কার হয় ১৯৫২ সালে। তার সমাধিসৌধের পাথরের ঢাকনায় পাওয়া এক অসাধারণ খোদাইচিত্রে রাজাকে দেখানো হয়েছে মৃত্যু ও পুনর্জন্মের প্রতীক ‘ওয়ার্ল্ড ট্রি’র নিচে বসে আছেন – যেন দেবতায় পরিণত হয়েছেন। এই মূর্তির মাধ্যমে মায়া ধর্মে আত্মার পরকালীন ভ্রমণের ধারণা বোঝা যায়।

৪. Chichen Itza
এই বিখ্যাত নগরীতে পাওয়া গেছে চাক মুল (Chac Mool) নামের মূর্তি। এটি একটি আধাশোয়া মানবমূর্তি, যার বুকে একটি ট্রে রাখা আছে – যেখানে বলির পশু বা খাদ্যদ্রব্য রাখা হত দেবতাকে উৎসর্গ করার জন্য। এই ধরনের মূর্তি মায়া ও পরবর্তীতে অ্যাজটেক সভ্যতায়ও দেখা গেছে।

মায়া মূর্তির শিল্পশৈলী ও বার্তা

মায়া মূর্তিগুলিতে দেখা যায় অত্যন্ত সূক্ষ্ম কারুকাজ – পোশাক, অলঙ্কার, অস্ত্র, এমনকি মুখভঙ্গিমাও অত্যন্ত জীবন্ত ও বাস্তবসম্মত। তাদের চোখ, নাক, কানের গঠন, দাঁত ঝকঝকে বা কখনও পাথরের খোঁপা – সবই বাস্তবধর্মী।

মূর্তিগুলিতে যেসব বার্তা পাওয়া যায়:

রাজনৈতিক প্রচার: রাজাকে দেবতার মতো উপস্থাপন করা হতো,

ধর্মীয় নির্দেশনা: কোন দেবতাকে কবে, কীভাবে পূজা করতে হবে,

জ্যোতির্বিদ্যা: অনেক মূর্তির খোদাই লিপিতে বিশেষ জ্যোতিষ-ঘটনা বা চাঁদের পর্যায় লিপিবদ্ধ রয়েছে,

ঐতিহাসিক তথ্য: যুদ্ধ, শাসনকাল, জোট বা সংঘর্ষের বিবরণ।

সাম্প্রতিক আবিষ্কার

গত এক দশকে LIDAR (Light Detection and Ranging) প্রযুক্তির মাধ্যমে গুয়াতেমালার গভীর জঙ্গলে নতুন মায়া শহরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই শহরগুলোতে নতুন মূর্তি ও স্তম্ভের সন্ধান মিলেছে। বিশেষ করে ২০২২ সালে “El Zotz” নামক এক এলাকায় প্রাচীন একটি দেবতার মূর্তি উদ্ধার হয়, যার গায়ে সূর্য ও পাখির পাখনার প্রতীক ছিলো।

২০২৪ সালে গুয়াতেমালার পেটেন অঞ্চলে একটি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়, যেখানে একটি দেবীকে চাঁদের ওপর বসে থাকতে দেখা যায়, আর নিচে রয়েছে তৃতীয় চোখবিশিষ্ট এক প্রাণী – যা পূর্বে কখনো দেখা যায়নি। এটি সম্ভবত নতুন কোনও দেবতা অথবা পৌরাণিক গল্পের প্রতীক।

প্রত্নতত্ত্ববিদদের দৃষ্টিভঙ্গি

বিশেষজ্ঞদের মতে, মায়া মূর্তি হলো এক ধরনের “ভিজ্যুয়াল টেক্সট” – যা শুধু চিত্র নয়, বরং লিখিত ইতিহাসও। অনেক সময় এগুলোর সাহায্যে প্রাচীন মায়া লিপি ও দিনপঞ্জি ব্যাখ্যা করা যায়।

ড. লিন্ডা শেলি, একজন বিখ্যাত মায়া বিশেষজ্ঞ, বলেন:

“মায়া মূর্তিগুলো হচ্ছে প্রাচীন মায়া সমাজের মঞ্চ – যেখানে ধর্ম, রাজনীতি ও মহাজাগতিক চিন্তাধারা একসঙ্গে অভিনীত হয়েছে।”

মায়া মূর্তি কেবল শিল্প বা ধর্মীয় উপাসনার মাধ্যম নয়, বরং এটি ইতিহাসের জীবন্ত দলিল। হাজার বছরের পুরনো হলেও, এগুলো আমাদের জানায় প্রাচীন মানুষের কল্পনা, বিশ্বাস, শাসনপ্রণালী ও দৈনন্দিন জীবনের কথা। প্রতিটি মূর্তি যেন সময়ের এক খণ্ডিত প্রতিচ্ছবি, যেখান থেকে আধুনিক মানুষ শিখতে পারে প্রাচীন সমাজের অমর গল্প।

তথ্যসূত্র:

National Geographic – Maya Art and Civilization

Smithsonian Magazine – The Secrets of Maya Glyphs and Stelae

Linda Schele and David Freidel – A Forest of Kings

INAH, Mexico – Museo Nacional de Antropología

Archaeology.org – New LIDAR Discoveries in Guatemala

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments