Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসলোহাগড় দুর্গের ইতিহাস

লোহাগড় দুর্গের ইতিহাস

লোহাগড় দুর্গের ইতিহাস

লোহাগড় দুর্গ ভারতের রাজস্থানের ভরতপুরে অবস্থিত ১৮ শতকের একটি দুর্গ । এটি ভরতপুরের জাট শাসকদের, বিশেষ করে মহারাজা সুরজমলের , যিনি ১৭৩২ সালে এর নির্মাণকাজ শুরু করেছিলেন, শক্তি এবং চতুরতার প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে । ব্রিটিশ সেনাবাহিনী ১৩ বার এই দুর্গ জয় করার চেষ্টা করেছিল কিন্তু একবারও দুর্গে প্রবেশ করতে পারেনি।

১৮০৫ সালের জানুয়ারি এবং ফেব্রুয়ারিতে ভরতপুর অবরোধের সময় লর্ড লেকের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনীর বারবার আক্রমণের মুখোমুখি হয়েছিল দুর্গম লোহাগড় দুর্গ, যখন তারা দুর্গ আক্রমণের চারটি প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। এটি “লোহার দুর্গ” নামেও পরিচিত। দুর্গটির অবস্থান পাহাড়ি অঞ্চলে, যা প্রায় ২,০৩০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। মধ্যযুগীয় ভারতের সামরিক ইতিহাসে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ হিসেবে বিবেচিত হয়। নিচে এর ইতিহাস, গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় প্রেক্ষাপট

লোহাগড় দুর্গের সঠিক নির্মাণকাল নির্দিষ্টভাবে জানা না গেলেও ধারণা করা হয় এটি সাতবাহন রাজবংশ বা পরবর্তী প্রাচীন রাজ্যগুলোর সময় থেকে প্রতিরক্ষা ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে যখন বিভিন্ন আঞ্চলিক শক্তি নিজেদের সামরিক অবস্থান দৃঢ় করছিল, তখন লোহাগড় পাহাড়ের উপরে একটি সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ কৌশলগত দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। মধ্যযুগে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ চলাকালে এই দুর্গটি ক্রমে একটি সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত হয়।

মারাঠা যুগে লোহাগড় দুর্গ

১৭শ শতকে ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ যখন মারাঠা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন, তখন লোহাগড় দুর্গ তাঁর কৌশলগত দুর্গগুলির একটি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। দুর্গটির প্রাকৃতিক পাহাড়ি অবস্থান শত্রুপক্ষকে প্রতিরোধ করার জন্য উপযুক্ত ছিল। শিবাজির সময় লোহাগড় দুর্গ শুধু প্রতিরক্ষা ঘাঁটি নয়, বরং আঞ্চলিক প্রশাসনিক কার্যক্রম এবং অস্ত্রশস্ত্র সংরক্ষণের স্থান হিসেবেও ব্যবহৃত হতো। শিবাজির উত্তরসূরিরা এবং মারাঠা সাম্রাজ্যের অন্যান্য সেনানায়কেরাও এই দুর্গকে সামরিক অভিযানের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন।

মুঘল ও ব্রিটিশদের সঙ্গে সংঘর্ষ

শিবাজির মৃত্যুর পর মারাঠা-মুঘল সংঘর্ষ তীব্রতর হলে লোহাগড় দুর্গও একাধিকবার দখলের লড়াইয়ের কেন্দ্র হয়ে ওঠে। মুঘলরা দাক্ষিণাত্য অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চাইলেও পাহাড়ি দুর্গগুলির কারণে তারা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি।

১৮শ শতকে ব্রিটিশরা যখন ভারতে তাদের প্রভাব বাড়াচ্ছিল, তখন লোহাগড় দুর্গও তাদের নজরে আসে। ১৮১৮ সালে অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সেনারা বহু দুর্গের মতো লোহাগড় দুর্গকেও দখল করে নেয়। এর পর থেকে দুর্গটি ধীরে ধীরে সামরিক গুরুত্ব হারাতে থাকে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

দুর্গটি পাহাড়ের গায়ে নির্মিত, যা প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা প্রদান করে। এর প্রাচীর পাথর দিয়ে নির্মিত এবং একসময় শক্ত লোহার দরজা দ্বারা সুরক্ষিত ছিল। দুর্গের ভেতরে পানির ট্যাংক, অস্ত্র সংরক্ষণের ঘর এবং সৈন্যদের থাকার ব্যবস্থা ছিল। চারপাশের খাড়া পাহাড় ও বনভূমি এটিকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করত। দুর্গের দুটি ফটকের মধ্যে, উত্তর দিকেরটি অষ্টধাতু (আটটি ধাতব) ফটক নামে পরিচিত এবং দক্ষিণ দিকেরটি চৌবুর্জ (চার স্তম্ভযুক্ত) ফটক নামে পরিচিত।

দুর্গের স্মৃতিস্তম্ভগুলির মধ্যে রয়েছে কিশোরী মহল,মহল খাস এবং কোঠি খাস। দুর্গের এই অংশগুলিকে রাজস্থানে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষিত সৌধের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে – কামারা খাস, কিশোরী মহল, হংসরানি মহল, কাছাহারী কালা, চমন বাগিচি, হাম্মাম ও মাটিওয়াল গেট অর্থাৎ মথুরা গেট, বিনারাইন গেট, অটল বাঁধ গেট, আনাহ গেট, কুমদহের গেট, কুমদহের গেট। গেট, এবং সুরজ পোলের কাছে বুরুজ।

আধুনিক যুগে লোহাগড় দুর্গ

ব্রিটিশ দখলের পর থেকে দুর্গটি সামরিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। স্বাধীনতার পর এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে গুরুত্ব পায়। আজকে দুর্গটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় স্থান, বিশেষত ইতিহাস ও প্রকৃতিপ্রেমীদের জন্য। পাহাড়ি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে সাথে মারাঠা ইতিহাসের গৌরবময় স্মৃতি বহন করে চলেছে এই দুর্গ।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

মারাঠা সাম্রাজ্যের প্রতিরক্ষা কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। মুঘল ও মারাঠাদের সংঘর্ষের সাক্ষী। অ্যাংলো-মারাঠা যুদ্ধের ইতিহাসে এটি একটি কৌশলগত ঘাঁটি ছিল। দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের সামরিক স্থাপত্যের উৎকৃষ্ট নিদর্শন।

লোহাগড় দুর্গ শুধু একটি স্থাপত্যকীর্তি নয়, বরং দাক্ষিণাত্য অঞ্চলের রাজনৈতিক ও সামরিক ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। শিবাজির বীরত্ব, মারাঠাদের সংগ্রাম এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির প্রসারের গল্প এই দুর্গের পাথর আর প্রাচীরের ভেতর লুকিয়ে আছে। আজ এটি ভারতের ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায়, যা গবেষক, পর্যটক ও ইতিহাসপ্রেমীদের কাছে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

তথ্যসূত্র

গাজেটিয়ার অফ বোম্বে প্রেজিডেন্সি, ভলিউম XV (মহারাষ্ট্র) – ব্রিটিশ আমলের ঐতিহাসিক নথি।

জাদুনাথ সরকার, শিবাজি অ্যান্ড হিজ টাইমস (১৯২০)।

সি. ভি. ভৈরাগড়ে, হিস্ট্রি অফ দ্য মারাঠা ফোর্টস।

মহারাষ্ট্র ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন (MTDC) – লোহাগড় দুর্গ সম্পর্কিত তথ্য।

ইন্ডিয়ান আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে রিপোর্টস।

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments