লেমুর: মাদাগাস্কারের প্রতীক
লেমুর হল মাদাগাস্কারের প্রাইমেট গোত্রভুক্ত কিছু প্রাণীর সমষ্টিগত নাম। ল্যাটিন শব্দ lemurs থেকে লেমুর শব্দটির উৎপত্তি যার অর্থ ভূতের মত। রাতের আধারে লেমুরের মুখে আলো ফেললে অনেকটা ভূতের মত দেখায় তাই এর নামকরণ এভাবে করা হয়েছে।
প্রাকৃতিক ভাবে লেমুর সাধারনত আফ্রিকার মাদাগাস্কারেই দেখতে পাওয়া যায়। এই প্রজাতিটি খুব সম্ভবত সাড়ে ছয় কোটি বছর আগে মাদাগাস্কারে আবির্বূত হয়েছিল। তখন থেকেই এই প্রজাতিটি মাদাগাস্কারের আবহাওয়ার সাথে খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
প্রায় ২০০০ বছর আগে মাদাগাস্কারে মানুষের আবির্ভাব ঘটার আগে একটি পূর্নবয়স্ক পুরুষ গরিলা আকৃতির লেমুর বসবাস করত। এখন মাদাগাস্কারেই প্রায় ১০০ প্রজাতীর লেমুর দেখতে পাওয়া যায়।
অনেকে ধারণা করেন যে লেমুর বানর বা মানুষের পূর্বপূরুষ থেকে বিবর্তীত হয়ে এসেছে তবে তা একেবারে সত্য নয়। এরা মূলত মাদাগাস্কারেই উৎপন্ন ও বিকশিত হয়েছে।
উদ্ভব ও বিবর্তন
লেমুরদের আবাসভূমি মূলত একমাত্র মাদাগাস্কার দ্বীপ এবং এর পার্শ্ববর্তী কয়েকটি ছোট দ্বীপ, যেমন কোমোরোস। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রায় ৪–৫ কোটি বছর আগে আফ্রিকা মহাদেশ থেকে কিছু আদিম প্রাইমেট ভেসে এসে মাদাগাস্কারে পৌঁছায়।
সেখানে প্রতিযোগিতা ও শিকারির অনুপস্থিতিতে এরা ধীরে ধীরে বিবর্তিত হয়ে বিভিন্ন ধরণের লেমুরে পরিণত হয়। বর্তমানে প্রায় ১১৩টির মতো স্বীকৃত লেমুর প্রজাতি রয়েছে, যেগুলোর আকার, আচরণ, খাদ্যাভ্যাস এবং বাসস্থান একেকরকম।
এগুলো একে অপরের থেকে এতটাই আলাদা যে, কেউ কেউ ছোট বিড়ালের মতো আবার কেউ কেউ মাঝারি সাইজের কুকুরের মতো দেখতে।
বাসস্থান ও জীবনধারা
লেমুররা প্রধানত মাদাগাস্কারের বনাঞ্চলে বসবাস করে। বিশেষ করে:
রেইনফরেস্ট (উষ্ণ ও আর্দ্র বন)
ড্রাই ডেসিডুয়াস বন (শুকনো পাতাঝরা বন)
স্পাইনি ফরেস্ট (কাঁটাযুক্ত গাছপালার বন)
এরা সাধারণত গাছে গাছে লাফিয়ে বেড়ায় এবং দিনে অথবা রাতে সক্রিয় থাকে, প্রজাতি ভেদে এদের দৈনন্দিন রুটিন আলাদা।
সামাজিক আচরণ
লেমুররা অনেক সময় দলে দলে বসবাস করে, এবং আকর্ষণীয়ভাবে কিছু প্রজাতিতে মহিলারাই দলনেতা। এই নারী নেতৃত্বের প্রথা প্রাণীজগতে বিরল। এরা পরস্পরের সঙ্গে গন্ধ ছড়িয়ে, মুখ চেটে বা শব্দ করে যোগাযোগ করে।
লেমুরের বিভিন্ন প্রজাতীর মধ্যে আচরণের অনেক পার্থক্য দেখা যায়। বড় আকারের লেমুররা সচরাচর দিনের বেলা ঘুরাফেরা করলেও ছোট আকারের গুলো নিশাচর হয়।
এদের মধ্যে সামাজিক ব্যবস্থা, কার্যকলাপ, শিকার থেকে সুরক্ষিত থাকার কৌশল, প্রজনন এবং বুদ্ধিমত্তার পার্থক্যও দেখা যায়। দলবদ্ধ ভাবে থাকার পরও খাদ্য সংগ্রহের জন্য এরা একা বিচরণ করে এবং খাদ্যগ্রহণ শেষে পুররায় দলে ফিরে আসে।
খাদ্যাভ্যাস
লেমুররা ফলভোজী প্রাণী হলেও এদের খাদ্য তালিকায় কীট পতঙ্গোও থাকে। সচরাচর লেমুররা অনেক ধরনের খাদ্য গ্রহণ করে। তবে ছোট আকারের লেমুররা পতঙ্গ এবং ফল ফলাদি খেয়ে থাকে অপরদিকে বড় আকারের লেমুররা গাছপালা ও লতাপাতা খেয়ে জীবন ধারণ করে।
তাদের প্রিয় খাদ্যের তালিকায় থাকুক আর নাই থাকুক ক্ষুধার্ত লেমুররা হজমযোগ্য প্রায় সবকিছুই খেতে পারে। রিং টেইল্ড লেমুররা(গোলাকৃতি লেজের) তৃণভোজীও হয়ে থাকে তাই এদেরকে খাদ্যের প্রাপ্যতা সাপেক্ষে সর্বোভূক বলা চলে।
ধারণা করা হয় যে ছোট আকৃতির লেমুররা শুধুমাত্র তৃণ জাতীয় খাদ্য গ্রহণ করে তাদের শক্তির পর্যাপ্ত যোগান সংগ্রহ করতে পারে না, তাই কীট-পতঙ্গের মত উচ্চ ক্যালরী বিশিষ্ট ও আমিষ জাতীয় খাদ্য তাদের খাদ্য তালিকায় রাখে।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে যে পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট আকৃতির এই স্তন্যপায়ীরা কীট পতঙ্গের চেয়ে ফল ফলাদিই বেশি খেয়ে থাকে।
যোগাযোগ
লেমুররা সাধারনত দৃষ্টিগোচর শারিরীক শংকেত, ঘ্রাণ এবং বিভিন্ন প্রকার শব্দ উৎপন্ন করার মাধ্যমে একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে। রিং টেইল্ড লেমুররা গন্ধ শোঁকার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন প্রকার শব্দ উৎপাদনের মাধ্যমেই যোগাযোগ বজায় রাখে।
যোগাযোগের ক্ষেত্রে শারিরীক সংকেত এরা খুব একটা ব্যবহার করে না। এই প্রজাতীর লেমুরকে হাই তুলে অপর লেমুরকে হুমকি দিতে দেখা গেছে। যোগাযোগ করতে এরা অনেকসময় মুখায়ববেরও পরিবর্তন করে।
লেমুরদের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রজাতি
Ring-tailed Lemur (Lemur catta)
সবচেয়ে পরিচিত প্রজাতি
লম্বা, সাদা-কালো ডোরা যুক্ত লেজ
মাটিতে বেশি সময় কাটায়
Indri (Indri indri)
বৃহত্তম জীবিত লেমুর
গাছের ওপরে চলাফেরায় দক্ষ
জোরে জোরে ডাকতে পারে, যেন গান গায়
Mouse Lemur
বিশ্বের ক্ষুদ্রতম প্রাইমেট
ওজন মাত্র ৩০-৫০ গ্রাম
রাতে সক্রিয় থাকে
Aye-aye (Daubentonia madagascariensis)
অদ্ভুত চেহারার লেমুর
দীর্ঘ ও পাতলা মাঝের আঙুল দিয়ে গাছ খোঁচায়
লোকবিশ্বাসে এটি অপশকুন হিসেবে দেখা হয়, যা একে হুমকির মুখে ফেলেছে
পরিবেশগত গুরুত্ব
লেমুররা মাদাগাস্কারের ইকোসিস্টেমে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ফল খেয়ে বীজ ছড়িয়ে নতুন গাছ জন্মাতে সাহায্য করে। এর ফলে বনাঞ্চলের ভারসাম্য রক্ষা পায়।
বিপন্ন অবস্থা
আইইউসিএন (IUCN) এর মতে, লেমুরদের প্রায় ৯৫% প্রজাতিই এখন বিলুপ্তির ঝুঁকিতে। এর পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো:
বন উজাড়: কৃষিকাজ, বসতবাড়ি এবং জ্বালানির জন্য গাছ কেটে ফেলা
শিকার: মাংস ও পোষা প্রাণী হিসেবে ধরা
অবিশ্বাস ও কুসংস্কার: কিছু প্রজাতিকে অশুভ মনে করে হত্যা করা
জলবায়ু পরিবর্তন: আবাসস্থল পরিবর্তনের ফলে খাদ্যের অভাব
সংরক্ষণ প্রচেষ্টা
বিভিন্ন দেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থা লেমুর সংরক্ষণে কাজ করছে। যেমন:
মাদাগাস্কার সরকার অনেক বনকে সংরক্ষিত অঞ্চলে রূপান্তর করেছে।
Duke Lemur Center (USA) বিশ্বে সবচেয়ে বড় লেমুর গবেষণা কেন্দ্র।
Ecotourism – পর্যটকদের আকৃষ্ট করে স্থানীয় জনগণকে বন সংরক্ষণের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে।
লেমুর সংস্কৃতি ও জনপ্রিয়তা
লেমুররা “Madagascar” নামক জনপ্রিয় অ্যানিমেটেড সিনেমার কারণে বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পায়। “King Julien” চরিত্রটি রিং-টেইলড লেমুর অবলম্বনে তৈরি। এছাড়াও বিভিন্ন তথ্যচিত্রে যেমন BBC, National Geographic ইত্যাদিতে লেমুরের জীবনচক্র দেখানো হয়েছে।
লেমুর শুধু একটি প্রাণী নয়, বরং মাদাগাস্কারের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের প্রতীক। তাদের হারিয়ে ফেলা মানে পুরো একটি প্রাকৃতিক ভারসাম্য ধ্বংস হয়ে যাওয়া। লেমুরদের টিকিয়ে রাখতে হলে আমাদের আরও সচেতন হতে হবে, বন সংরক্ষণে এগিয়ে আসতে হবে এবং স্থানীয় সম্প্রদায়কে সম্পৃক্ত করতে হবে।
তথ্যসূত্র:
IUCN Red List
National Geographic
Duke Lemur Center
Madagascar Fauna and Flora Group