মধ্যযুগীয় ইউরোপের স্যানিটেশন ব্যবস্থা
মধ্যযুগ(প্রায় ৫ম থেকে ১৫শ শতক) ইউরোপের ইতিহাসে এক বিশেষ সময়কাল, যা প্রায়শই “অন্ধকার যুগ” নামে পরিচিত। এই সময়কালে বিজ্ঞান ও জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ অগ্রগতি না থাকায় স্যানিটেশন ব্যবস্থাও ছিল দুর্বল ও অপরিকল্পিত। তবে এটি সম্পূর্ণরূপে অনুন্নত ছিল না; বরং বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে শহর ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে, কিছু কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। মধ্যযুগীয় ইউরোপের স্যানিটেশন ব্যবস্থা আজকের মানদণ্ডে বেশ অপরিকল্পিত এবং অস্বাস্থ্যকর ছিল। বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য তেমন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা ছিল না। শহরগুলোতে নর্দমা ব্যবস্থা থাকলেও সেগুলো প্রায়ই নোংরা এবং উপচে পড়ত। সাধারণ মানুষ তাদের বাড়ির বর্জ্য রাস্তায় ফেলত, যা রোগের বিস্তারে সহায়তা করত।
পায়খানা ও মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা
ক্যাসল ও দুর্গে ল্যাট্রিন
অনেক দুর্গ ও প্রাসাদে “গার্ডারোব” (garderobe) নামে পরিচিত ল্যাট্রিন ব্যবস্থা ছিল। এটি একটি উঁচু টাওয়ার বা প্রাচীরের ধারঘেঁষা ছোট ঘর, যেখান থেকে বর্জ্য নিচে মাটিতে অথবা পরিখায় পড়ে যেত।
শহরাঞ্চলে উন্মুক্ত পায়খানা
শহরের সাধারণ মানুষের জন্য নির্দিষ্ট পায়খানার ব্যবস্থা ছিল না। মানুষ প্রায়শই পাত্রে বা জানালার নিচে বর্জ্য ফেলে দিত এবং অনেকেই তা রাস্তার মাঝখানে ঢেলে দিত — এই জন্যই “Gardez l’eau!” (“জল সাবধান!”) বলে চিৎকার করার রেওয়াজ ছিল।
বর্জ্য নিষ্কাশন ও ড্রেনেজ
কিছু শহরে প্রাকৃতিক জলধারা বা নালা ব্যবহার করে বর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ছিল। তবে অনেক সময়ই তা অচল হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াতো।
স্নান ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা
স্নানাগার বা পাবলিক বাথহাউস
রোমানদের প্রভাব থাকা শহরগুলোতে (যেমন: প্যারিস, কোলোন, বাথ) পাবলিক বাথহাউস ছিল। তবে চার্চ স্নানকে বিলাসিতা ও নৈতিক দুর্বলতার প্রতীক হিসেবে দেখতে শুরু করলে এই প্রথা কমে আসে।
গ্রামে বা গৃহে স্নান
সাধারণ মানুষ মাঝে মধ্যে নদী বা পুকুরে স্নান করতো। কিন্তু শীতের সময় স্নান খুবই বিরল ছিল।
আবর্জনা ও মৃত পশু অপসারণ
রাস্তার আবর্জনা
শহরের রাস্তায় মৃত পশু, আবর্জনা ও বর্জ্য জমে দুর্গন্ধ ছড়াতো। মাঝে মাঝে নগর কর্তৃপক্ষ এদের সরিয়ে নিতো, তবে তা ছিল অনিয়মিত।
নিষিদ্ধ ঘোষণা ও আইন
কিছু শহর যেমন লন্ডন ও প্যারিসে নাগরিকদের রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য আইন তৈরি করা হয়, যেমন জানালা দিয়ে বর্জ্য ফেলায় জরিমানা।
স্বাস্থ্য ও রোগব্যাধি
পানির দূষণ ও পানযোগ্যতা
অধিকাংশ শহরের মানুষ দূষিত জল ব্যবহার করত। কিছু গির্জা বা মঠে কুয়া বা পাথরের জলাধার থাকলেও তা ছিল সীমিত।
প্লেগ ও মহামারী
অপরিচ্ছন্নতা ও জনঘনত্বের কারণে প্লেগ ও অন্যান্য রোগ দ্রুত ছড়াতো। ১৪শ শতকে “কালো মৃত্যু” (Black Death) প্রায় ইউরোপের এক-তৃতীয়াংশ মানুষকে নিঃশেষ করে দেয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক প্রভাব
গির্জা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো মাঝে মাঝে পরিচ্ছন্নতা সংক্রান্ত কিছু নিয়ম চালু করলেও এগুলো বেশি করে নৈতিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল, স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে নয়। “শরীর নয়, আত্মার পরিচ্ছন্নতা বেশি গুরুত্বপূর্ণ” — এমন বিশ্বাস স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মধ্যযুগীয় ইউরোপের স্যানিটেশন ব্যবস্থা আধুনিক মানদণ্ডে খুবই দুর্বল হলেও, তা সময় ও প্রেক্ষাপট অনুযায়ী ক্রমান্বয়ে উন্নতির দিকে গিয়েছিল। শহরের প্রসার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা, এবং রোগব্যাধির তাণ্ডব — সবকিছু মিলিয়ে সময়ের চাপে ধীরে ধীরে নতুন স্বাস্থ্যবিধি গড়ে ওঠে, যা পরবর্তীকালে রেনেসাঁ এবং আধুনিক ইউরোপের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি তৈরি করে।
তথ্যসূত্র:
Carlin, M. (1996). Medieval English Hospitals
Rawcliffe, C. (2013). Urban Bodies: Communal Health in Late Medieval English Towns and Cities
Museum of London Archaeology (MOLA) archives