লালবাগ শাহী জামে মসজিদ
লালবাগ শাহী মসজিদ বা ফররুখ সিয়ার মসজিদ ঢাকার লালবাগ কেল্লার সন্নিকটে অবস্থিত একটি মসজিদ। মসজিদটি ১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে নির্মাণ করা হয়। তৎকালীন ঢাকার উপ-শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফর্রুখশিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় মসজিদটি নির্মিত হয়। বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার ঐতিহাসিক লালবাগ এলাকার ভেতরে অবস্থিত লালবাগ শাহী মসজিদ একটি অনন্য মুঘল স্থাপত্য নিদর্শন। ১৬৭৯ সালে প্রায় সমাপ্ত হওয়া লালবাগ কেল্লার দক্ষিণ–পশ্চিম প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটি আজও ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে।
লালবাগ শাহী মসজিদের প্রেক্ষাপট
মুঘল শাসনামলে ঢাকা ছিল সুবাহ বাংলার অন্যতম প্রধান রাজধানী। ইসলাম খান চিশতি যখন ১৬০৮ সালে বাংলার সুবাহদার নিযুক্ত হন, তখন তিনি রাজধানীকে রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তরিত করেন। এরপর থেকেই ঢাকা হয়ে ওঠে প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এই সময়ে অসংখ্য মসজিদ, ইমারত ও কেল্লা নির্মাণ করা হয়। লালবাগ কেল্লা ছিল শায়েস্তা খানের আমলে শুরু হওয়া এক মহৎ প্রকল্প। এর দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে নির্মিত লালবাগ শাহী মসজিদ ছিল কেল্লার বাসিন্দাদের জন্য ধর্মীয় উপাসনালয়।
লালবাগ শাহী মসজিদের নির্মাতা
মসজিদটির সঠিক নির্মাণকাল নিয়ে ভিন্নমত থাকলেও বেশিরভাগ ঐতিহাসিক মনে করেন যে এটি ১৬৭৮–১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে (১০৮৯ হিজরি) সুবাহ বাংলার মুঘল শাসক মোহাম্মদ আজম শাহ বা তার উত্তরসূরি নওয়াব শায়েস্তা খানের নির্দেশে নির্মিত হয়। লালবাগ কেল্লার মূল প্রকল্পটি অসমাপ্ত থেকে গেলেও মসজিদটি পরিপূর্ণভাবে নির্মিত হয়েছিল। এর অবস্থান কেল্লার পশ্চিম সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে, কারণ ইসলামি স্থাপত্য অনুযায়ী মসজিদ সবসময় পশ্চিমমুখী হয়। এই মসজিদটি আসলে লালবাগ কেল্লার একটি অংশ এবং এটি একই সাথে নির্মিত হয়।
লালবাগ শাহী মসজিদের স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
লালবাগ শাহী মসজিদ (ফররুখসিয়ার মসজিদ নামেও পরিচিত) ঢাকার লালবাগ দুর্গের কাছে অবস্থিত একটি মুঘল মসজিদ, যা ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফর্রুখশিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়। এর স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য হলো: এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত, এর তিনটি গম্বুজ ও চারটি মিনার রয়েছে, এবং এটি বাংলার মুঘল মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম বৃহত্তম। লালবাগ শাহী মসজিদ মুঘল আমলের মসজিদের অনন্য নিদর্শন।
(ক) কাঠামো
এটি একটি আয়তাকার গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ।
মসজিদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬৭ ফুট এবং প্রস্থ প্রায় ৩২ ফুট।
এর উপরে তিনটি গম্বুজ রয়েছে। মাঝের গম্বুজটি বড় এবং পাশের দুটি তুলনামূলক ছোট।
মিনার: এর চারটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে, যা এর সম্মুখভাগকে শোভিত করে।
কেন্দ্রীয় গম্বুজ: মসজিদটিতে একটি কেন্দ্রীয় গম্বুজ রয়েছে যা এর আকৃতিকে একটি ঐতিহ্যবাহী মুঘল স্থাপত্যের রূপ দিয়েছে।
আয়তক্ষেত্রাকার প্রাঙ্গণ: মসজিদটি একটি আয়তক্ষেত্রাকার প্রাঙ্গণের উপর নির্মিত, যা মুঘল স্থাপত্যের একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
(খ) প্রবেশপথ
পূর্ব দিকে তিনটি খিলানযুক্ত প্রবেশপথ রয়েছে।
উত্তর ও দক্ষিণ দিকেও একটি করে দরজা আছে।
খিলানগুলো অর্ধবৃত্তাকার, যা মুঘল শৈলীর পরিচায়ক।
(গ) ভেতরের অংশ
ভেতরে তিনটি আয়তাকার ভাগ রয়েছে, প্রতিটি গম্বুজের নিচে একটি কক্ষ।
দেয়ালে মেহরাব খোদাই করা হয়েছে। মধ্য মেহরাবটি সবচেয়ে বড় ও সুন্দরভাবে সজ্জিত।
মেহরাবের চারপাশে ফুল-লতা ও জ্যামিতিক নকশা দেখা যায়।
(ঘ) বাইরের সৌন্দর্য
গম্বুজগুলো উঁচু ড্রাম বা বৃত্তাকার ভিত্তির উপর স্থাপিত।
প্রতিটি গম্বুজের শীর্ষে ফুলকুঁড়ি আকৃতির ফিনিয়াল রয়েছে।
মসজিদের চার কোনায় উঁচু মিনার-সদৃশ গম্বুজাকার অলংকরণ আছে।
(ঙ) উপকরণ
মসজিদ নির্মাণে ইট, চুন-সুরকি, চুনাপাথর ও মাটির গাঁথুনি ব্যবহার করা হয়েছে।
বাইরের দেয়াল পালিশ করা চুন-সুরকি দিয়ে আবৃত ছিল, যা আজ ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে।
লালবাগ শাহী মসজিদের ধর্মীয় গুরুত্ব
লালবাগ শাহী মসজিদ ঢাকার একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক মোঘল আমলের মসজিদ, যা ধর্মীয়ভাবে তাৎপর্যপূর্ণ কারণ এটি মুঘল শাসনামলে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে ভূমিকা রেখেছে, এবং আজও এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক অন্যতম নিদর্শন এবং স্থানীয় মুসলিমদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। লালবাগ শাহী মসজিদ নির্মাণকাল থেকেই নিয়মিত নামাজের স্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।প্রথমে এটি কেল্লার অভ্যন্তরে সৈন্য ও অভিজাতদের উপাসনালয় ছিল। পরে সাধারণ মানুষকেও এখানে নামাজ আদায়ের সুযোগ দেওয়া হয়। বর্তমানে এটি লালবাগ এলাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জুমার মসজিদ।
লালবাগ শাহী মসজিদের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য
লালবাগ শাহী মসজিদটি ঢাকার লালবাগ দুর্গের পাশে অবস্থিত একটি প্রাচীন মসজিদ, যা ১৭০৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন ঢাকার উপ-শাসক সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফর্রুখশিয়র কর্তৃক নির্মিত হয়। এটি মুঘল স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এবং এর নির্মাণকাল ও পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ।
এটি মুঘল স্থাপত্যকলার উৎকৃষ্ট নিদর্শন।
লালবাগ কেল্লার অংশ হিসেবে এটি পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্র।
স্থানীয় মুসলিম সমাজের কাছে এটি একটি ঐতিহ্যবাহী জায়গা।
মসজিদটির অবস্থান কেল্লার জায়গার সাথে মিলে যায়, যা আমাদেরকে ১৭শ শতাব্দীর রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের পরিচয় দেয়।
লালবাগ শাহী মসজিদের বর্তমান অবস্থা
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর লালবাগ শাহী মসজিদকে সংরক্ষিত স্মৃতিস্তম্ভ ঘোষণা করেছে।
নিয়মিত সংস্কার ও সংরক্ষণ কার্যক্রম চলছে।
মসজিদের বাইরের দেয়াল পুনরায় মেরামত ও পরিষ্কার করা হয়েছে।
এর ভেতরে এখনো নামাজ আদায় করা হয়, ফলে এটি জীবন্ত ঐতিহ্য হিসেবে টিকে আছে।
লালবাগ শাহী মসজিদের তুলনামূলক বিশ্লেষণ
লালবাগ শাহী মসজিদকে মুঘল আমলের অন্যান্য মসজিদের সাথে তুলনা করলে দেখা যায়:
এটি ঢাকার অন্যান্য শাহী মসজিদের (যেমন সাত গম্বুজ মসজিদ, কারাত্তলি মসজিদ) মতোই তিন গম্বুজ বিশিষ্ট।
তবে আকারে ছোট হলেও এর কারুকাজ নিখুঁত।
এর অবস্থান (কেল্লার প্রাচীরের সাথে) মুঘল সামরিক ও ধর্মীয় প্রয়োজনের ইঙ্গিত দেয়।
লালবাগ শাহী মসজিদের লোককথা ও জনপ্রিয়তা
স্থানীয় লোকদের মধ্যে বিশ্বাস আছে যে লালবাগ কেল্লার নির্মাণ অসম্পূর্ণ থাকলেও এই মসজিদ নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়েছিল আল্লাহর ইচ্ছায়।
লালবাগ শাহী মসজিদ ঢাকার লালবাগ কেল্লার সন্নিকটে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক এবং স্থাপত্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ, যা মূলত ১৭০৩ থেকে ১৭০৬ সালের মধ্যে সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রপৌত্র ফররুখসিয়রের পৃষ্ঠপোষকতায় নির্মিত হয়। এটি মুঘল স্থাপত্যশৈলীর এক চমৎকার নিদর্শন এবং ঢাকার অন্যতম প্রাচীন ও বড় মসজিদগুলোর মধ্যে অন্যতম। এর লোককথা হিসেবে, মুঘল আমলের এই মসজিদটি ঢাকা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে এলাকার সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং এর সুউচ্চ মিনার সবসময়ই স্থানীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া, প্রতি শুক্রবার ও ঈদের নামাজে এখানে হাজারো মানুষ সমবেত হয়।
লালবাগ শাহী মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, বরং এটি মুঘল আমলের শিল্প, স্থাপত্য ও সমাজজীবনের এক অমূল্য দলিল। চার শতাব্দীরও বেশি আগে নির্মিত হলেও আজও এটি একই সঙ্গে জীবন্ত মসজিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে টিকে আছে। এর প্রতিটি গম্বুজ, খিলান, মেহরাব এবং অলংকরণ আমাদের সামনে মুঘল যুগের শৈল্পিক কৌশল ও নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে তোলে।
এই মসজিদ নির্মাণের মাধ্যমে বোঝা যায়, মুঘল শাসকেরা কেবল রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি প্রদর্শনেই সীমাবদ্ধ ছিলেন না; বরং ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনযাপনেও গুরুত্ব দিয়েছিলেন। লালবাগ কেল্লার মতো সামরিক দুর্গের ভেতরে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল এই কারণে যে, তারা চাইতেন ধর্মীয় চর্চা এবং আল্লাহর উপাসনা যেন রাজকীয় আবাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়।
আজকের দিনে লালবাগ শাহী মসজিদ কেবল ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং ঢাকার মুসলিম সমাজের জীবন্ত কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিদিনের নামাজ, শুক্রবারের জুমা কিংবা ঈদে এখানে হাজারো মানুষ একত্রিত হয়। এতে বোঝা যায়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মারক হয়েও এটি নিছক জাদুঘরের নিদর্শন হয়ে যায়নি; বরং একটি সক্রিয় ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেঁচে আছে।
তাছাড়া পর্যটন, প্রত্নতত্ত্ব এবং গবেষণার দিক থেকেও লালবাগ শাহী মসজিদের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশি–বিদেশি গবেষক, পর্যটক এবং শিক্ষার্থীরা এই মসজিদ থেকে শিখতে পারে মুঘল স্থাপত্যকলার বিবর্তন, বাংলার নগর সংস্কৃতি এবং ইসলামি শিল্পরীতি সম্পর্কে।
অতএব বলা যায়, লালবাগ শাহী মসজিদ আমাদের ঐতিহ্যের এমন এক দ্যুতিময় রত্ন, যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ—এই তিন সময়ের সেতুবন্ধন রচনা করে। এর সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা শুধু একটি স্থাপত্য রক্ষাই নয়; বরং এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়, সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার এবং আধ্যাত্মিক জীবনধারার প্রতি সম্মান প্রদর্শনের প্রতীক। লালবাগ শাহী মসজিদের মতো ঐতিহ্য যদি সযত্নে রক্ষিত হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও একদিন দাঁড়িয়ে দেখতে পাবে—কীভাবে এক যুগের আধ্যাত্মিকতা ও শিল্পকলা আজও মানবসভ্যতার অমূল্য সম্পদ হয়ে অটুট রয়েছে।
তথ্যসূত্র
আহমেদ, নাজিমুদ্দিন। বাংলাদেশের প্রাচীন মসজিদসমূহ। ঢাকা: বাংলা একাডেমি, ১৯৮১।
রহমান, সিদ্দিকুর। ঢাকার ঐতিহাসিক মসজিদ। ঢাকা: ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৫।
Hasan, Perween. Sultans and Mosques: The Early Muslim Architecture of Bangladesh. London: I.B. Tauris, 2007.
Ahmed, Nazimuddin. Discover the Monuments of Bangladesh. Dhaka: University Press Limited, 1984.
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সরকার। সংরক্ষিত প্রত্নসম্পদ তালিকা। ঢাকা, ২০১৫।
সেলিম, মুহাম্মদ আলী। ঢাকার মুঘল স্থাপত্য। ঢাকা: ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০০১।