Friday, October 3, 2025
Homeস্থাপত্যলালবাগ কেল্লা: মুঘল ঐতিহ্যের অমর নিদর্শন

লালবাগ কেল্লা: মুঘল ঐতিহ্যের অমর নিদর্শন

লালবাগ কেল্লা: মুঘল ঐতিহ্যের অমর নিদর্শন

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা তার ঐতিহাসিক ও স্থাপত্য নিদর্শনের জন্য সুপরিচিত। পুরান ঢাকার কোলঘেঁষে অবস্থিত লালবাগ কেল্লা বা আউরঙ্গাবাদ দুর্গ মুঘল আমলের অন্যতম স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুর্গ শুধু একটি স্থাপনা নয়, বরং এটি ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও শিল্পকলার সাক্ষী। কেল্লাটি যদিও অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে, তবুও এর মহিমা, সৌন্দর্য এবং ঐতিহাসিক মূল্য আজও অম্লান।

নির্মাণের সূচনা

লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র মুহাম্মদ আজম শাহ-এর নির্দেশে। তিনি তখন বাংলার সুবাদার ছিলেন। আওরঙ্গজেবের শাসনামলে ঢাকা ছিল বাংলা সুবাহর রাজধানী। আজম শাহ এখানে একটি বিশাল দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা নেন যা প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষামূলক উভয় উদ্দেশ্য পূরণ করবে। প্রথমে কেল্লার নাম রাখা হয় আউরঙ্গাবাদ দুর্গ, তবে সময়ের সাথে সাথে এর নাম হয় লালবাগ কেল্লা, কারণ কেল্লার চারপাশে ব্যবহৃত লালচে ইটের রঙের কারণে এ নামটি জনপ্রিয়তা পায়।

অসম্পূর্ণতার কারণ

মুহাম্মদ আজম শাহ মাত্র এক বছর বাংলার সুবাদার ছিলেন। ১৬৭৯ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেবের ডাকে দিল্লি ফিরে গেলে কেল্লার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যায়। তার স্থলাভিষিক্ত হন সুবাদার শায়েস্তা খান। শায়েস্তা খান প্রথমে কেল্লার কাজ চালিয়ে গেলেও, তার কন্যা পরীবিবির অকাল মৃত্যুর পর তিনি নির্মাণকাজে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বলা হয়ে থাকে যে, পরীবিবিকে কেল্লার ভেতরেই সমাহিত করা হয়। এরপর থেকে লালবাগ কেল্লা অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই থেকে যায়।

ইতিহাসের বাঁক

১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দ: নির্মাণ শুরু।

১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দ: আজম শাহ দিল্লি ফিরে যান।

১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দ: শায়েস্তা খান লালবাগ ছেড়ে ঢাকা ত্যাগ করেন এরপর থেকে লালবাগ কেল্লা আর সম্পূর্ণ হয়নি এবং ধীরে ধীরে এটি একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভে পরিণত হয়।

স্থাপত্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য

লালবাগ কেল্লা মুঘল স্থাপত্যশৈলীর অসাধারণ উদাহরণ। মুঘল স্থাপত্যে প্রধানত ইট, চুন-সুরকি, মার্বেল পাথর এবং সাদা পাথরের ব্যবহার দেখা যায়। কেল্লার নকশা করা হয়েছিল এক বিশাল দুর্গ হিসেবে, যেখানে থাকবে প্রশাসনিক ভবন, বসতবাড়ি, উদ্যান, মসজিদ, জলাধার ও প্রতিরক্ষামূলক প্রাচীর।

অবকাঠামো

দীর্ঘ সময় যাবত এটি ধারণা করা হত যে, দুর্গটি হচ্ছে তিনটি ভবন স্থাপনার সমন্বয় (মসজিদ, পরী বিবির সমাধি ও দেওয়ান-ই-আম), সাথে দুটি বিশাল তোরণ ও আংশিক ধ্বংসপ্রাপ্ত মজবুত দুর্গ প্রাচীর। বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক উৎখননে অন্যান্য অবকাঠামোর অস্তিত্ব প্রকাশ পেয়েছে। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে একটি বিরাট বুরূজ ছিল। দক্ষিণস্থ দুর্গ প্রাচীরের উত্তরে ছিল কয়েকটি ভবন, আস্তাবল, প্রশাসনিক ভবন, এবং পশ্চিম অংশে জলাধার ও ফোয়ারা সহ একটি সুন্দর ছাদ-বাগানের ব্যবস্থা ছিল।

আবাসিক অংশটি ছিল দুর্গ প্রাচীরের পশ্চিম-পূর্বে, প্রধানত মসজিদটির দক্ষিণ-পশ্চিমে। দক্ষিণের দুর্গ প্রাচীরে নির্দিষ্ট ব্যবধানে ৫ টি বুরুজ ছিল উচ্চতায় দুই তালার সমান, এবং পশ্চিমের দুর্গ প্রাচীরে ছিল ২ টি বুরুজ যার সবচেয়ে বড়টি ছিল দক্ষিণস্থ প্রধান প্রবেশদ্বারে। বুরুজ গুলোর ছিল একটি ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গ। কেল্লাটির কেন্দ্রীয় এলাকা দখল করে ছিল তিনটি প্রধান ভবন। পূর্বে দেওয়ান-ই-আম ও হাম্মাম খানা, পশ্চিমে মসজিদটি এবং পরী বিবির সমাধি দুটোর মাঝখানে এক লাইনে, কিন্তু সমান দূরত্বে নয়। নির্দিষ্ট ব্যবধানে কয়েকটি ফোয়ারা সহ একটি পানির নালা তিনটি ভবনকে পূর্ব থেকে পশ্চিমে ও উত্তর থেকে দক্ষিণে সংযুক্ত করেছে।

দেওয়ান-ই-আম

হাম্মাম খানা মূলত সুবেদারদের বাস ভবন হিসেবে ব্যবহার হত । লালবাগ কেল্লার এই দালান কে দুটি কাজে ব্যবহার করা হতঃ হাম্মাম খানা (বাস ভবন হিসেবে), দেওয়ানে আম (বিচারালয় হিসেবে)। এই দালানের নিচ তালা ছিল বাস ভবন তথা হাম্মাম খানা আর উপরের তলা ছিল আদালত বা দেওয়ানে আম। শায়েস্তা খাঁ এই ভবনে বাস করতেন এবং এটাই ছিল তার আদালত। এখান থেকে তিনি সমস্ত বিচারকার্য পরিচালনা করতেন ।

পরীবিবির সমাধি

লালবাগ কেল্লার তিনটি স্থাপনার মধ্যে অন্যতম এটি। এখানে পরী বিবি সমাহিত আছেন। শায়েস্তা খান তার কন্যার স্মরণে এই মনমুগ্ধকর মাজারটি নির্মাণ করেন। লালবাগ কেল্লার তিনটি বিশাল দরজার মধ্যে বর্তমানে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত । এই দরজা দিয়ে ঢুকলে বরাবর সোজা চোখে পড়ে পরী বিবির সমাধি। আসলে “লালবাগ কেল্লা” বলতে যেই ছবিটি বেশি পরিচিত সেটি মূলত পরী বিবির সমাধির ছবি। পরী বিবি যার অন্য নাম ইরান দুখত রহমত বানু ছিলেন সুবাহ বাংলার মুঘল সুবেদারশায়েস্তা খানের কন্যা।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ আজমের সাথে ১৬৬৮ সালের ৩ মে পরী বিবির বিয়ে হয়। ১৬৮৪ সালে পরী বিবির অকালমৃত্যুর পর তাকে নির্মাণাধীন লালবাগ কেল্লার অভ্যন্তরে সমাহিত করা হয়। তার সমাধীস্থলকে চিহ্নিত করে পরী বিবির মাজার নির্মিত হয়। পরী বিবির মাজারের স্থাপনাটি চতুষ্কোণ। মার্বেল পাথর, কষ্টি পাথর ও বিভিন্ন রং এর ফুল-পাতা সুশোভিত চাকচিক্যময় টালির সাহায্যে অভ্যন্তরীণ নয়টি কক্ষ অলংকৃত করা হয়েছিল।

মাঝের একটি ঘরে পরী বিবির সমাধিস্থল এবং এই ঘরটি ঘিরে আটটি ঘর আছে। স্থাপনাটির ছাদ করবেল পদ্ধতিতে কষ্টি পাথরে তৈরি এবং চারকোণে চারটি অষ্টকোণ মিনার ও মাঝে একটি অষ্টকোণ গম্বুজ আছে। মূল সমাধিসৌধের কেন্দ্রীয় কক্ষের উপরের এই গম্বুজটি একসময়ে স্বর্ণখচিত ছিল, পরবর্তীতে পিতলের/তামার পাত দিয়ে পুরো গম্বুজটিকে মুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। স্থাপনাটির অভ্যন্তর ভাগ সাদা মার্বেল পাথর দিয়ে আচ্ছাদিত ছিল। ২০.২ মিটার বর্গাকৃতির এই সমাধিটি ১৬৮৮ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে নির্মিত। তবে বিশেষজ্ঞদের অভিমত বর্তমানে এখানে পরি বিবির মরদেহ নেই বলে।

লালবাগ শাহী মসজিদ

সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয় পুত্র শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন তিন গম্বুজওয়ালা দুর্গ মসজিদ এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন ১৬৭৮-৭৯ খ্রিষ্টাব্দে। আয়তাকারে (১৯.১৯ মি: × ৯.৮৪ মি) নির্মিত তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদটি এদেশের প্রচলিত মুঘল মসজিদের একটি আদর্শ উদাহরণ। বর্তমানেও মসজিদটি মুসল্লিদের নামাজের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

উদ্যান ও জলাধার

কেল্লার ভেতরে ছিল সুন্দর উদ্যান, ফোয়ারা এবং সুদৃশ্য জলাধার। এখনো এর কিছু অংশ সংরক্ষিত আছে।

লালবাগ কেল্লার কিংবদন্তি ও রহস্য

লালবাগ কেল্লার সাথে জড়িয়ে আছে অনেক গল্প ও রহস্য। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো পরীবিবির গল্প।

পরীবিবি কে ছিলেন?
অনেকে বলেন তিনি শায়েস্তা খানের কন্যা, আবার অনেকে মনে করেন তিনি আজম শাহের স্ত্রী।

মৃত্যুর কারণ
বলা হয়, লালবাগ কেল্লার নির্মাণকাজ চলাকালীন পরীবিবির মৃত্যু হয়। এরপর শায়েস্তা খান শোকগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতির এক অমূল্য সম্পদ। এর গুরুত্ব নিম্নরূপ:

মুঘল শাসনামলের সাক্ষী: এটি প্রমাণ করে যে ঢাকা একসময় মুঘল প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।

স্থাপত্যকলার নিদর্শন: মুঘল শিল্পকলা ও স্থাপত্যশৈলীর এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ।

পর্যটন কেন্দ্র: বর্তমানে এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

বর্তমান অবস্থা

আজ লালবাগ কেল্লা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এটি পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। কেল্লার ভেতরে রয়েছে একটি জাদুঘর, যেখানে মুঘল আমলের অস্ত্রশস্ত্র, পোশাক, গহনা এবং বিভিন্ন নিদর্শন সংরক্ষিত আছে।

লালবাগ কেল্লা ভ্রমণ নির্দেশিকা

অবস্থান: পুরান ঢাকা, লালবাগ

খোলার সময়:

শীতকাল: সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা

গ্রীষ্মকাল: সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা

প্রবেশমূল্য:

বাংলাদেশি নাগরিক: ২০ টাকা

বিদেশি পর্যটক: ২০০ টাকা

সেরা সময়: শীতকাল

লালবাগ কেল্লার সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ

যদিও কেল্লাটি সংরক্ষিত, তবুও এর চারপাশে অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ন, বায়ু দূষণ এবং ভিড়ের কারণে এর ক্ষতি হচ্ছে। তাই এটি রক্ষার জন্য প্রয়োজন সঠিক সংরক্ষণ নীতি।

লালবাগ কেল্লা বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য রত্ন, যা শুধু একটি স্থাপত্যকর্ম নয় বরং মুঘল যুগের ক্ষমতা, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য নৈপুণ্যের জ্যোতির্ময় সাক্ষী। ঢাকা শহরের বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এই দুর্গ আমাদের অতীতের গল্প বলে, যা গৌরবের পাশাপাশি শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।

যদিও লালবাগ কেল্লার নির্মাণ অসম্পূর্ণ থেকে গেছে, তবুও এর প্রতিটি ইট, প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি নকশা মুঘল স্থাপত্যকলার পরিশীলিত সৌন্দর্য বহন করে। কেল্লার ভেতরের পরীবিবির সমাধি, লালবাগ মসজিদ, শায়েস্তা খানের বাসভবন – সবকিছু মিলিয়ে এটি এক অনন্য ঐতিহাসিক নিদর্শন।

এটি শুধু পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং আমাদের পরিচয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক। প্রতি বছর হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে আসে, যার ফলে দেশের অর্থনীতিতেও এটি অবদান রাখে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, নগরায়ন, পরিবেশ দূষণ এবং জনসচেতনতার অভাবে কেল্লার কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এই ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে হলে কার্যকর সংরক্ষণ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। সরকারকে আরও কঠোর নীতি প্রণয়ন করতে হবে এবং জনগণের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি করতে হবে যে, ঐতিহাসিক স্থাপনা শুধু অতীতের নিদর্শন নয়, এটি আমাদের গৌরবময় ইতিহাসের জীবন্ত দলিল।

আগামী প্রজন্মের জন্য লালবাগ কেল্লাকে অক্ষত রাখা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এ ধরনের স্থাপনা হারিয়ে গেলে আমরা শুধু একটি ভবন হারাব না, হারাব আমাদের জাতীয় পরিচয়, ঐতিহ্য ও গৌরব। তাই লালবাগ কেল্লার সংরক্ষণ শুধু প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ নয়, এটি জাতীয় দায়িত্ব।

শেষ পর্যন্ত বলা যায়, লালবাগ কেল্লা আমাদের অতীতের জ্যোতির্ময় অধ্যায়ের প্রতীক। এর মহিমা ও সৌন্দর্য অম্লান রাখতে হলে এখনই আমাদের কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের প্রকাশনা

ঢাকা ইতিহাস গ্রন্থ – ড. মুহাম্মদ এনামুল হক

“Dhaka: The Mughal Capital” – Syed Mahmudul Hasan

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments