কাজী নজরুল ইসলামের জীবনী
কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯ – ২৯ আগস্ট ১৯৭৬) ছিলেন বাংলা সাহিত্য ও সঙ্গীতের এক অনন্য প্রতিভা, যিনি “বিদ্রোহী কবি” নামে পরিচিত। তিনি ছিলেন কবি, গীতিকার, সুরকার, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও সাংবাদিক—একইসঙ্গে সামাজিক ন্যায়বিচার, সাম্য, মানবতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার জোরালো কণ্ঠস্বর। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
শৈশব ও শিক্ষাজীবন
নজরুল ইসলাম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম কাজী ফকির আহমেদ এবং মাতার নাম জাহেদা খাতুন। ছোটবেলায় গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ করতেন। দারিদ্র্যের কারণে আনুষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন খুব বেশি দীর্ঘ হয়নি। প্রাথমিক পড়াশোনা স্থানীয় মক্তবে, পরে লেটো দলে (গ্রামীণ নাটকের সংগঠন) যোগ দেন, যেখানে গান, অভিনয় ও সাহিত্যর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়।
সেনাবাহিনীতে যোগদান
১৯১৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি ৪৯তম বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত ছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন করাচিতে অবস্থানকালে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেন এবং সৈনিক জীবনের অভিজ্ঞতা তাঁর রচনায় প্রভাব ফেলে। সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি পেয়ে তিনি কলকাতায় সাহিত্য ও সাংবাদিকতার জগতে প্রবেশ করেন।
সাহিত্য ও সাংবাদিকতা
১৯২২ সালে তাঁর বিখ্যাত কবিতা “বিদ্রোহী” প্রকাশিত হয়, যা তাঁকে রাতারাতি “বিদ্রোহী কবি”তে পরিণত করে। একই বছর “অগ্নিবীণা” কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর লেখায় তীব্র বিপ্লবী চেতনা, ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে।
নজরুল ছিলেন বিভিন্ন সাময়িকীর সম্পাদক, যেমন—ধূমকেতু, যেখানে তিনি রাজনৈতিক সচেতনতা, স্বাধীনতার আহ্বান এবং সাম্যবাদী ভাবধারা তুলে ধরতেন। তাঁর এই লেখনী ব্রিটিশ সরকারের বিরাগভাজন হয় এবং তাঁকে কারাবরণ করতে হয় (১৯২৩-১৯২৪)। কারাগারে থেকেও তিনি “রাজবন্দীর জবানবন্দী”সহ বহু রচনা প্রকাশ করেন।
বিদ্রোহী নজরুল
তখন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। নজরুল কুমিল্লা থেকে কিছুদিনের জন্য দৌলতপুরে আলী আকবর খানের বাড়িতে থেকে আবার কুমিল্লা ফিরে যান ১৯ জুনে- এখানে যতদিন ছিলেন ততদিনে তিনি পরিণত হন একজন সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মীতে।
তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। তখনকার সময়ে তার রচিত ও সুরারোপিত গানগুলির মধ্যে রয়েছে “এ কোন পাগল পথিক ছুটে এলো বন্দিনী মার আঙ্গিনায়, আজি রক্ত-নিশি ভোরে/ একি এ শুনি ওরে/ মুক্তি-কোলাহল বন্দী-শৃঙ্খলে” প্রভৃতি। এখানে ১৭ দিন থেকে তিনি স্থান পরিবর্তন করেছিলেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। ২১ নভেম্বর ছিল সমগ্র ভারতব্যাপী হরতাল- এ উপলক্ষে নজরুল আবার পথে নেমে আসেন; অসহযোগ মিছিলের সাথে শহর প্রদক্ষিণ করেন আর গান করেন, “ভিক্ষা দাও! ভিক্ষা দাও! ফিরে চাও ওগো পুরবাসী”- নজরুলের এ সময়কার কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়েছে।
এর সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বিদ্রোহী নামক কবিতাটি। বিদ্রোহী কবিতাটি ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় এবং সারা ভারতের সাহিত্য সমাজে খ্যাতিলাভ করে।
গান ও সঙ্গীত
নজরুল বাংলা গানের ভাণ্ডারে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। তিনি প্রায় ৪,০০০ গান রচনা ও সুরারোপ করেছেন, যা “নজরুলগীতি” নামে পরিচিত। তাঁর গানে প্রেম, প্রকৃতি, বিপ্লব, ইসলামি সঙ্গীত (গজল, হামদ, নাত) এবং হিন্দু ভক্তিমূলক গান (ভজন, কীর্তন) সমানভাবে স্থান পেয়েছে। হিন্দু-মুসলিম মিলনের প্রতীক হিসেবে তিনি দুই ধর্মের সুর ও ছন্দকে একত্রিত করেন।
প্রেম ও পারিবারিক জীবন
১৯২৪ সালে তিনি প্রমীলা দেবীর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের দুই পুত্র সন্তান ছিল, তবে উভয়েই অল্প বয়সে মারা যান। পারিবারিক জীবনে দুঃখ-কষ্ট ও ব্যক্তিগত বিপর্যয় তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলে। ১৯২১ সালের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন।
তার সাথেই তিনি প্রথম কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। আর এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সাথে যার সাথে তার প্রথমে প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়েছিল।তবে এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নী নার্গিস আসার খানমের সাথে। বিয়ের আখত সম্পন্ন হবার পরে কাবিনের নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে।
নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকার করেন এবং বাসর সম্পন্ন হবার আগেই নার্গিসকে রেখে কুমিল্লা শহরে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান। তখন নজরুল খুব অসুস্থ ছিলেন এবং প্রমিলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবন
- নজরুল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন এবং “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে পরিচিত হন। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কারণে কারাবরণও করতে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ছিল তাঁর সাহিত্যের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশে আগমন ও শেষ জীবন
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর গান ও কবিতা স্বাধীনতার প্রেরণা যুগিয়েছে। ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে সপরিবারে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করেন। তাঁকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ঢাকার ধানমন্ডিতে একটি সরকারি বাসভবন বরাদ্দ করা হয়।
মূল্যায়ন
- কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও মানুষকে অনুপ্রাণিত করে। অসাম্প্রদায়িক ও বিপ্লবী চেতনা তাঁর সাহিত্যকে আজও প্রাসঙ্গিক করে তুলেছে।
মৃত্যু ও স্মৃতি
১৯৪২ সালে তিনি অসুস্থ হয়ে বাকশক্তি হারান। ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট নজরুল ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। আজও তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত ও আদর্শ বাংলাভাষী মানুষের হৃদয়ে জীবন্ত।
সাহিত্যকীর্তি
নজরুলের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ:
অগ্নিবীণা (১৯২২)
বিষের বাঁশি (১৯২৪)
সিন্দুরের কৌটা (১৯২৬)
চন্দ্রবিন্দু (১৯৩১)
গল্পগ্রন্থ:
ব্যথার দান
রিক্তের বেদন
নাটক:
মৃত্যুক্ষুধা
ঝিলমিল
সঙ্গীতে তাঁর সৃষ্টি ও সুরারোপিত গজল, ইসলামি গান, ভজন, কীর্তন, প্রেমের গান আজও সমান জনপ্রিয়।
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন কেবল এক বিদ্রোহী কবি নন, বরং বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির এক অদম্য প্রেরণাসূত্র। তিনি মানবতা, প্রেম, সাম্য, স্বাধীনতা এবং অসাম্প্রদায়িকতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর সাহিত্য ও সঙ্গীত বাংলার ইতিহাসে চিরস্মরণীয়, যা যুগে যুগে স্বাধীনতা ও ন্যায়ের পথে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
তথ্যসূত্র
কাজী নজরুল ইসলাম, অগ্নিবীণা, প্রথম প্রকাশ: ১৯২২।
আহমদ শরীফ, কাজী নজরুল ইসলাম: জীবন ও সাহিত্য, বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
মোহিতুল আলম, নজরুল জীবনী, নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা।
Abdul Mannan Syed, Nazrul: The Rebel and the Romantic, Dhaka: University Press Limited.
বাংলা একাডেমি, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম প্রবন্ধ সংকলন।