কার্ল মার্ক্সের জীবনী
কার্ল হাইনরিখ মার্ক্স (Karl Heinrich Marx) ছিলেন উনিশ শতকের একজন জার্মান দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ, সমাজবিজ্ঞানী ও বিপ্লবী, যিনি সমাজতন্ত্র এবং কমিউনিজমের তাত্ত্বিক ভিত্তি স্থাপন করেন। তিনি তার যুগান্তকারী চিন্তাধারার মাধ্যমে আধুনিক সমাজবিজ্ঞান, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও ইতিহাসের ব্যাখ্যায় এক বিপ্লব ঘটান। তার রচনার মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালী হল “দ্য কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” (১৮৪৮, ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এর সঙ্গে যৌথভাবে) এবং “দাস ক্যাপিটাল” (প্রথম খণ্ড ১৮৬৭)।
প্রারম্ভিক জীবন ও শিক্ষা
কার্ল মার্ক্স জন্মগ্রহণ করেন ৫ মে ১৮১৮ সালে, প্রুশিয়ার (বর্তমানে জার্মানির) ট্রিয়ের শহরে। তার পিতা হাইনরিখ মার্ক্স ছিলেন একজন আইনজীবী এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী পরিবার থেকে খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। শিক্ষাবিদ পরিবারে জন্ম নেয়া মার্ক্স ছোটবেলা থেকেই অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণে আগ্রহী ছিলেন।
কার্ল মার্ক্স ১৩ বছর বয়স পর্যন্ত বাড়িতেই পড়াশোনা করেন। বাল্যপাঠ শেষে Trier Gymnasium এ ভর্তি হন, ১৭ বছর বয়সে সেখান থেকে স্নাতক হন। এরপর ইউনিভার্সিটি অফ বন-এ আইন বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তার ইচ্ছা ছিল সাহিত্য ও দর্শন নিয়ে পড়া, কিন্তু তার বাবা মনে করতেন কার্ল স্কলার হিসেবে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারবে না।
কিছুদিনের মধ্যেই তার বাবা তাকে বার্লিনের Humboldt-Universität এ বদলি করিয়ে দেন। সে সময় মার্ক্স জীবন নিয়ে কবিতা ও প্রবন্ধ লিখতেন, তার লেখার ভাষা ছিল বাবার কাছ থেকে পাওয়া ধর্মতাত্ত্বিক তথা অতিবর্তী ঈশ্বরবাদের ভাষা। এ সময়ই তরুণ হেগেলিয়ানদের নাস্তিকতাবাদ গ্রহণ করেন। ১৮৪১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভের বিষয় ছিল “The Difference Between the Democritean and Epicurean Philosophy of Nature” (প্রকৃতি সম্বন্ধে দেমোক্রিতোসীয় ও এপিকুরোসীয় দর্শনের মধ্যে পার্থক্য)। উল্লেখ্য, ১৮৩৫ সালে তিনি বন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, কিন্তু পরে বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়ে দর্শন ও ইতিহাসে মনোনিবেশ করেন।
পিএইচডি অভিসন্দর্ভ তিনি বার্লিনের বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দিয়ে ইউনিভার্সিটি অফ জেনা-তে জমা দেন। কারণ তরুণ হেগেলিয়ান রেডিক্যাল হওয়ার কারণে বার্লিনে তার ভাবমূর্তি ভাল ছিল না।
সাংবাদিকতা ও প্রাথমিক বিপ্লবী কাজ
১৮৪২ সালে মার্ক্স রাইনিশে জাইতুং নামক পত্রিকার সম্পাদক হন, যেখানে তিনি সমাজ ও অর্থনীতির নানা দিক নিয়ে প্রবন্ধ লিখতেন। কিন্তু প্রুশিয়ান সরকারের চাপে পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেলে মার্ক্স প্যারিসে চলে যান। সেখানে তিনি ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস-এর সঙ্গে পরিচিত হন এবং তাদের গভীর মিত্রতা গড়ে ওঠে।
প্যারিসে তিনি সমাজতান্ত্রিক চিন্তা ও অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের দিকে আরও বেশি মনোযোগী হন। ১৮৪৫ সালে মার্ক্সকে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি ব্রাসেলস (বেলজিয়াম) চলে যান এবং সেখানেই তার লেখায় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের বীজ বপন শুরু হয়।
“কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো” ও বিপ্লবের সময়
১৮৪৮ সালে ইউরোপে বিপ্লবের ঢেউ উঠলে মার্ক্স ও এঙ্গেলস যৌথভাবে লেখেন “The Communist Manifesto”। এতে শ্রেণীসংগ্রাম, উৎপাদন উপকরণের মালিকানা এবং শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির ধারণা তুলে ধরা হয়। এটি শ্রমিক আন্দোলনের একটি মৌলিক দলিল হয়ে ওঠে।
মার্ক্স মনে করতেন ইতিহাস মূলত শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস, যেখানে এক শ্রেণি অপর শ্রেণিকে শোষণ করে এসেছে। শিল্পবিপ্লবের পর এই দ্বন্দ্ব মূলত পুঁজিপতি (বুর্জোয়া) এবং শ্রমিক (প্রলেতারিয়েত)-এর মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। এই দ্বন্দ্ব একসময় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে অবসান ঘটবে এবং একটি শ্রেণীহীন সাম্যবাদী সমাজ কায়েম হবে – এটাই মার্ক্সের মূল তত্ত্ব।
নির্বাসন ও লন্ডন জীবন
১৮৪৮-এর বিপ্লব ব্যর্থ হলে মার্ক্স বিভিন্ন দেশে ঘুরে শেষ পর্যন্ত ১৮৪৯ সালে লন্ডনে স্থায়ী হন এবং জীবনের বাকি অংশ সেখানেই কাটান। লন্ডনে থাকাকালীন তিনি লেখালেখি ও গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন।
এ সময় তিনি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে অধ্যয়ন করে “দাস ক্যাপিটাল” (Das Kapital) রচনা করেন। ১৮৬৭ সালে প্রকাশিত এই গ্রন্থে তিনি পুঁজিবাদের বিশ্লেষণ দেন এবং দেখান কিভাবে শ্রমের উদ্বৃত্ত মূল্য (surplus value) পুঁজিপতিরা আত্মসাৎ করে থাকে। পরবর্তী খণ্ড দুটি মৃত্যুর পর ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস সম্পাদনা করে প্রকাশ করেন।
প্যারিসে প্রত্যাবর্তন
১৮৪৮ সালে ইউরোপ জুড়ে অনেকগুলি বিপ্লব সংঘটিত হয়। অনেক কিছুই বদলে যায়। মার্ক্সকে বন্দী করা হয় এবং পরবর্তীতে বেলজিয়াম থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরই মধ্যে বিপ্লবীরা ফ্রান্সের রাজা লুই-ফিলিপ কে রাজি করিয়ে মার্ক্সকে প্যারিসে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে। রাজার আমন্ত্রণেই তিনি প্যারিসে প্রত্যাবর্তন করেন। এ সময় প্যারিসে জুন ডেইস আপরাইজিং নামে পরিচিত বিপ্লবটি সংঘটিত হয় যা মার্ক্স প্রত্যক্ষ করেন।
আন্তর্জাতিক শ্রমিক আন্দোলন
১৮৬৪ সালে কার্ল মার্ক্স “ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিংমেনস অ্যাসোসিয়েশন” (First International)-এর প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হন। তিনি সংগঠনটির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণিকে সংগঠিত করার চেষ্টা চালান।
তবে নেতৃত্ব ও আদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে (বিশেষ করে অ্যানার্কিস্ট নেতা বাকুনিনের সঙ্গে) সংগঠনটি ভেঙে পড়ে। তবুও, মার্ক্স তার জীবনভর শ্রেণীসংগ্রামের তত্ত্বের বাস্তব রূপ দিতে শ্রমিক সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।
পারিবারিক জীবন ও দারিদ্র্য
মার্ক্স ১৮৪৩ সালে জেনি ফন ভেস্টফালেনকে বিয়ে করেন, যিনি ছিলেন এক অভিজাত পরিবারের কন্যা। তাদের সংসারে ছয়টি সন্তান জন্মায়, যাদের মধ্যে কেবল তিনজন বেঁচে ছিলেন। লন্ডনে থাকার সময় তারা চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটিয়েছেন। প্রায়ই তাদের না খেয়ে থাকতে হতো, সন্তানেরা উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে মারা গেছে।
ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস তার বন্ধু হিসেবে আর্থিকভাবে তাকে সারাজীবন সাহায্য করেছেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
কার্ল মার্ক্স ১৪ মার্চ ১৮৮৩ সালে লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে লন্ডনের হাইগেট কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুর সময় তার কাজের মূল্য ও প্রভাব খুবই সীমিত পরিসরে স্বীকৃত ছিল।
তবে মৃত্যুর পর তার চিন্তাধারা পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, বিপ্লব, রাষ্ট্রগঠন এবং একাডেমিক গবেষণায় ব্যাপক প্রভাব ফেলে। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব (১৯১৭), চীনের কমিউনিস্ট বিপ্লবসহ বহু আন্দোলনের আদর্শিক ভিত্তি হয় মার্ক্সবাদ।
কার্ল মার্ক্স শুধু একজন দার্শনিক ছিলেন না, তিনি ছিলেন যুগান্তকারী এক চিন্তাবিদ যিনি ইতিহাস, অর্থনীতি ও সমাজের নতুন বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। তার দর্শন ও আন্দোলন বহু বিতর্ক, প্রশংসা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। আজও “মার্ক্সবাদ” একটি শক্তিশালী তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক ধারা হিসেবে বর্তমান।
তথ্যসূত্র:
Marx, Karl. The Communist Manifesto (1848)
Marx, Karl. Das Kapital (1867)
McLellan, David. Karl Marx: A Biography
Encyclopedia Britannica
Marxists.org