Friday, October 3, 2025
Homeস্থাপত্যকান্তজির মন্দির: স্থাপত্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত সাক্ষী

কান্তজির মন্দির: স্থাপত্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত সাক্ষী

কান্তজির মন্দির: স্থাপত্য ও সংস্কৃতির জীবন্ত সাক্ষী

কান্তজীর মন্দির বা কান্তনগর মন্দির বাংলাদেশের দিনাজপুর জেলায় অবস্থিত একটি মধ্যযুগীয় হিন্দু মন্দির। মহারাজা প্রাণনাথ রায় মন্দিরটি শ্রীকৃষ্ণ ও তাঁর স্ত্রী রুক্মিণীকে উৎসর্গ করে নির্মিত করেন। এটির নির্মাণ ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয় এবং ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তাঁর পুত্র রাজা রামনাথ রায়ের রাজত্বকালে শেষ হয়। মন্দিরটির নবরত্ন বা ‘নয় শিখর’ ছিল, কিন্তু ১৮৯৭ সালে সংঘটিত একটি ভূমিকম্পে সবগুলোই ধ্বংস হয়ে যায় । এ মন্দিরে বাংলাদেশের সর্বোৎকৃষ্ট টেরাকোটা শিল্পের নিদর্শন রয়েছে । পৌরাণিক কাহিনীসমূহ পোড়ামাটির অলঙ্করণে দেয়ালের গায়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

সুদূর পারস্য থেকে নির্মাণ শিল্পীদের আনা হয়েছিল এই মন্দিরের নির্মাণ এবং সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য। মন্দিরের দক্ষিণ দিকে নয়াবাদ নামক গ্রামে রাজা প্রাণনাথ নির্মাণ শিল্পী এবং শ্রমিকদের বসবাসের জন্য জমি দান করেন। এই শ্রমিকদের বেশিরভাগই ছিলেন ইসলাম ধর্মাবলম্বী। তাই ধর্মীয় প্রার্থনা পালনের জন্য তারা নয়াবাদ মসজিদ নির্মাণ করেন যা একই এলাকার আরেকটি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে।

প্রতি বছর শীতের শুরুতে মন্দির প্রাঙ্গণে এক মাস ব্যাপী রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়। জানা যায় মহারাজা রামনাথ রায়ের সময়কাল থেকেই এই রাস মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। মেলা চলাকালীন সময় অনেক তীর্থ যাত্রী ভারত ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মন্দিরে তীর্থ যাত্রা করেন। কান্তজির মন্দির বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন ও শৈল্পিক নিদর্শন, যা তার অসাধারণ পোড়ামাটির শিল্পকর্মের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। এটি মূলত কৃষ্ণকে উৎসর্গকৃত একটি হিন্দু মন্দির এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত।

অবস্থান

মন্দিরটি দিনাজপুর শহর থেকে ২০ কিলোমিটার উত্তরে এবং কাহারোল উপজেলা সদর থেকে ৮ কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে সুন্দরপুর ইউনিয়নে, দিনাজপুর-তেঁতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিমে ঢেঁপা নদীর তীরবর্তী গ্রাম কান্তনগরে অবস্থিত। মন্দিরটি পলাশবাড়ি এবং খানসামা উপজেলার কাছাকাছি। এর চারপাশের পরিবেশে গ্রামীণ সৌন্দর্য, সবুজ ক্ষেত, এবং ঐতিহাসিক আবহ মিলে এক অনন্য দৃশ্য তৈরি করেছে।

ইতিহাস

মন্দিরের উত্তর দিকের ভিত্তিবেদীর শিলালিপি থেকে জানা যায়, তৎকালীন দিনাজপুরের মহারাজা জমিদার প্রাণনাথ রায় তার শেষ বয়সে মন্দিরের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তার মৃত্যুর পরে তার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তার পোষ্যপুত্র মহারাজা রামনাথ রায় ১৭৫২ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটির নির্মাণ কাজ শেষ করেন। শুরুতে মন্দিরের চূড়ার উচ্চতা ছিলো ৭০ ফুট। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরটি ভূমিকম্পের কবলে পড়লে এর চূড়াগুলো ভেঙে যায়। বিশ শতকের শুরুর দিকে মহারাজা গিরিজানাথ মন্দিরের ব্যাপক সংস্কার করলেও মন্দিরের চূড়াগুলো আর সংস্কার করা হয়নি।

২০১৭ সালের কলকাতা বইমেলায় বাংলার নিজস্ব স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন হিসাবে বাংলাদেশ সরকার তাদের প্যাভিলিয়নটি কান্তজিউ মন্দিরের আদলে গড়েন। ২০২৪ সালের ২৭ এপ্রিল ২০ হাজারের বেশি মানুষের কণ্ঠে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা পাঠ অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরটি মূলত কৃষ্ণকে উৎসর্গ করা হয়, তাই এর নাম কান্তজির মন্দির। এখানে কান্তজিউ (কৃষ্ণ) এর একটি প্রতিমা স্থাপন করা হয়েছিল। এটি ছিল রাজপরিবারের পূজার কেন্দ্রবিন্দু এবং বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক ২০ টাকার নোটে কান্তজিউ মন্দিরের ছবি যুক্ত করে।

স্থাপত্যশৈলী

পোড়ামাটির অলংকরণ – পুরো মন্দিরের বাইরের দেয়াল জুড়ে অসাধারণ পোড়ামাটির কারুকাজ রয়েছে। এই কারুকাজে রামায়ণ, মহাভারত, কৃষ্ণলীলা, সামাজিক জীবন, গ্রামীণ দৃশ্য, পশুপাখি এবং ফুল-লতার নকশা চিত্রিত হয়েছে।

তিন তলা বিশিষ্ট – মন্দিরটি তিন তলা বিশিষ্ট ছিল এবং এর উচ্চতা প্রায় ৫০ ফুট।

প্ল্যাটফর্মে নির্মিত – মন্দিরটি একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের উপর নির্মিত, যাতে বন্যার পানি থেকে রক্ষা করা যায়।

পোড়ামাটির শিল্পকলা

কান্তজির মন্দিরের প্রধান আকর্ষণ এর পোড়ামাটির কাজ। এশিয়ার অন্যতম সেরা পোড়ামাটির কারুকাজের উদাহরণ এটি।

বিষয়বস্তু

পুরাণ ও ধর্মীয় কাহিনী – রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন দৃশ্য, কৃষ্ণের লীলা, গোপী-কৃষ্ণের রাসলীলা।

গ্রামীণ জীবন – কৃষিকাজ, গরু চরানো, নৌকা বাইচ, শিকার।

রাজকীয় জীবন – রাজা-রানির শোভাযাত্রা, সেনাবাহিনী, যুদ্ধের দৃশ্য।

প্রাণী ও প্রকৃতি – হাতি, ঘোড়া, সিংহ, ময়ূর, ফুল ও লতা।

শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য

কান্তজিউ মন্দিরের প্রধান শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যগুলো হলো এর পোড়ামাটির ফলকে ফুটিয়ে তোলা পৌরাণিক কাহিনীসমূহ, যা ইন্দো-পারস্য স্থাপত্য শৈলীর এক অপূর্ব নিদর্শন। অষ্টাদশ শতাব্দীর এই ইটের তৈরি মন্দিরটি তার সমৃদ্ধ অলংকরণ এবং টেরাকোটার মাধ্যমে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা ও রামায়ণ-মহাভারতের কাহিনীর চিত্রায়ণে অনন্য। এই অলংকরণগুলো এত সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে যে প্রতিটি দৃশ্য জীবন্ত মনে হয়। পোড়ামাটির টালি দিয়ে গড়া এই কারুকাজে সমসাময়িক সমাজের প্রতিফলনও দেখা যায়।

টেরাকোটা অলংকরণ: মন্দিরের দেয়ালজুড়ে প্রায় ২৫০টিরও বেশি পোড়ামাটির ফলক (টেরাকোটা) রয়েছে, যেখানে কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ ও মহাভারতের বিভিন্ন কাহিনী জীবন্তভাবে চিত্রিত করা হয়েছে।

ইন্দো-পারস্য স্থাপত্য: মন্দিরটি ইন্দো-পারস্য স্থাপত্যশৈলীর এক উল্লেখযোগ্য নিদর্শন, যেখানে ইটের তৈরি কাঠামো এবং সমৃদ্ধ অলংকরণ দেখা যায়।

নবরত্ন বা নয়টি শিখর: এটি মূলত একটি নবরত্ন বা নয়টি শিখরযুক্ত মন্দির, যদিও ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এর আসল নয়টি শিখর ধ্বংস হয়ে যায়।

স্তম্ভ ও খিলান: মন্দিরের নিচতলার প্রবেশপথগুলিতে বহু খাঁজযুক্ত খিলান রয়েছে, যা দুটি ইটের স্তম্ভ দ্বারা পৃথক করা হয়েছে। এই স্তম্ভগুলোও অলংকরণে সমৃদ্ধ।

মানবীয় চরিত্র অঙ্কন: মন্দিরের টেরাকোটা ফলকগুলোতে দেবদেবীদের মানবিক চরিত্রকে উপেক্ষা না করে, সেগুলোকে মানবিক রূপে চিত্রায়িত করা হয়েছে, যা এর একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।

অষ্টাদশ শতাব্দীর নির্মাণ: ইটের তৈরি এই মন্দিরটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে নির্মিত, যা এর সময়ের স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।

নিভৃত পরিবেশ: মন্দিরটি একটি শান্ত ও নিভৃত গ্রাম কান্তনগরে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত, যা এর পরিবেশগত ও শৈল্পিক আবেদন আরও বাড়িয়ে তোলে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব

কান্তজির মন্দির শুধু একটি স্থাপত্য নয়, এটি ছিল বৈষ্ণব ধর্মীয় কেন্দ্র। প্রতি বছর রাস পূর্ণিমা উপলক্ষে এখানে মেলা বসত, যেখানে অসংখ্য ভক্ত সমবেত হতেন। এই মেলা আজও অনুষ্ঠিত হয়।

বর্তমান অবস্থা

বিগত শতাব্দীতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অবহেলার কারণে মন্দিরটির অনেক অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে এর নবরত্ন চূড়া ধসে যায়। তবে মন্দিরের মূল কাঠামো এবং পোড়ামাটির অলংকরণ এখনো বিদ্যমান। বর্তমানে এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সংরক্ষিত এবং পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত। স্থানীয় ও বিদেশি পর্যটকরা প্রতিদিন এখানে আসেন।

পর্যটন গুরুত্ব

কান্তজির মন্দির দিনাজপুরের প্রধান পর্যটন আকর্ষণ। এটি দেখতে প্রতি বছর হাজারো মানুষ আসে। এর শৈল্পিক সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে এটি UNESCO-এর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য প্রচেষ্টা চলছে।

কান্তজির মন্দির কেবল একটি ধর্মীয় স্থাপনা নয়, এটি বাংলার ঐতিহ্য, শিল্পকলা এবং ইতিহাসের এক অমূল্য সম্পদ। মন্দিরের প্রতিটি পোড়ামাটির ফলক শুধু অলংকরণের জন্য নয়, বরং সমসাময়িক সমাজের জীবনধারা, বিশ্বাস, কৃষি, বাণিজ্য, বিনোদন, যুদ্ধ, রাজনীতি ও ধর্মীয় কাহিনির এক জীবন্ত দলিল। এর স্থাপত্যশৈলীতে গৌড়ীয় বৈষ্ণব আন্দোলনের প্রভাব যেমন স্পষ্ট, তেমনি বাংলার গ্রামীণ জীবনের বহুমাত্রিক রূপও ফুটে উঠেছে।

শতাব্দী পেরিয়েও কান্তজির মন্দির আজও তার শৈল্পিক মহিমা ধরে রেখেছে, যদিও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অবহেলা ও সময়ের ক্ষয়ে এর কিছু অংশ নষ্ট হয়েছে। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে চূড়াগুলি ধসে পড়লেও মূল কাঠামো ও পোড়ামাটির কাজ এখনো অতীতের গৌরব বহন করছে। এটি শুধু বাংলাদেশ নয়, বরং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়ার পোড়ামাটির শিল্পের অন্যতম সেরা নিদর্শন।

আজকের দিনে কান্তজির মন্দিরের গুরুত্ব কেবল ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় দিক থেকে নয়, বরং পর্যটন, গবেষণা ও সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বপূর্ণ। এটি আমাদের ঐতিহ্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার জন্য একটি বড় সম্ভাবনা। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মন্দিরটি সংরক্ষণে উদ্যোগী হলেও, আরও আধুনিক প্রযুক্তি ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা প্রয়োজন যাতে এর সৌন্দর্য ও ঐতিহাসিক মূল্য অক্ষুণ্ণ থাকে।

ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই নিদর্শন সংরক্ষণ করা আমাদের দায়িত্ব। কারণ এটি শুধু একটি মন্দির নয়, বরং বাংলার শৈল্পিক ঐতিহ্য, স্থাপত্যের উৎকর্ষ, এবং ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। সঠিক সংরক্ষণ ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির মাধ্যমে কান্তজির মন্দির একদিন UNESCO বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে—যা বাংলাদেশের গৌরব আরও বাড়াবে।

তথ্যসূত্র

বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর

স্থানীয় ইতিহাসবিদদের গবেষণা

দিনাজপুর জেলা গেজেট

ঐতিহাসিক গ্রন্থ: বাংলার মন্দির স্থাপত্য

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments