জাপানি সংস্কৃতি
জাপানি সংস্কৃতি হাজার বছরের পুরনো ঐতিহ্য,শিল্প,ধর্ম ও সামাজিক আচরণের এক সমৃদ্ধ ধারা,যা সময়ের সাথে সাথে পরিশীলিত হয়েছে এবং বিশ্বে এক অনন্য স্থান অধিকার করেছে। এটি ঐতিহ্য ও প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিকতার মেলবন্ধন,যেখানে প্রাচীন শিন্তো ধর্মের আচার ও জেন বৌদ্ধ দর্শন পাশাপাশি আধুনিক পপ-সংস্কৃতি ও প্রযুক্তি বিকাশও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
ধর্ম ও দর্শন
জাপানি সংস্কৃতির মূল ভিত্তি হলো ধর্ম ও দর্শন। শিন্তো ধর্ম, যা প্রকৃতি, আত্মা ও পূর্বপুরুষদের উপাসনায় বিশ্বাস করে, জাপানি জাতিসত্তার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পাশাপাশি বৌদ্ধ ধর্ম, বিশেষ করে জেন (Zen) মতবাদ, ষষ্ঠ শতকে চীন থেকে আসার পর জাপানে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এই দর্শন মানুষের মনের শুদ্ধতা, ধ্যান, ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করতে শেখায়। আজও বহু জাপানি ধর্মীয় উৎসব, মন্দির, ও আচার-অনুষ্ঠানে এই ধর্মীয় বিশ্বাসগুলোর ছাপ পাওয়া যায়।
জাপানের প্রধান ধর্ম হলো শিন্তো এবং বৌদ্ধধর্ম। জাপান সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার ২০১৮ সালের ধর্মের উপর বার্ষিক পরিসংখ্যানগত গবেষণা অনুসারে, জনসংখ্যার ৬৬.৭ শতাংশ বৌদ্ধধর্ম ,২৫.৬ শতাংশ শিন্তোধর্ম,৭.৭ শতাংশ অন্যান্য ধর্ম পালন করে। জাপান সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থার ২০১৮ সালের ধর্মের উপর বার্ষিক পরিসংখ্যানগত গবেষণা অনুসারে ,জাপানের জনসংখ্যার প্রায় দুই মিলিয়ন বা প্রায় ১.৫% খ্রিস্টান। অন্যান্য ধর্মের মধ্যে রয়েছে ইসলাম (৭০,০০০) এবং ইহুদি ধর্ম (২,০০০),যা মূলত অভিবাসী সম্প্রদায় এবং কিছু জাতিগত জাপানি অনুশীলনকারী।
শিন্তো
শিন্তো একটি জাতিগত ধর্ম যা অনুষ্ঠান এবং আচার-অনুষ্ঠানের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। শিন্তোতে, অনুসারীরা বিশ্বাস করেন যে কামি – শিন্তো দেবতা বা আত্মা – পাথর, গাছ এবং পাহাড় সহ প্রকৃতির সর্বত্র বিদ্যমান। মানুষকেও কামি বলে মনে করা যেতে পারে। শিন্তোর একটি লক্ষ্য হল মানুষ, প্রকৃতি এবং কামির মধ্যে সংযোগ বজায় রাখা বা শক্তিশালী করা । ষষ্ঠ শতাব্দীর আগে জাপানে এই ধর্মের বিকাশ ঘটেছিল, যার পরে অনুসারীরা কামি পূজা করার জন্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন ।
শিল্প ও স্থাপত্য
জাপানি শিল্পজগৎ তার সরলতা, সংযম ও প্রাকৃতিক অনুপ্রেরণার জন্য পরিচিত। ঐতিহ্যবাহী ক্যালিগ্রাফি (শোদো), কাগজ ভাঁজের শিল্প ওরিগামি, কাঁসার বা পোর্সেলিনের তৈজসপত্র এবং প্রাকৃতিক মোটিফে আঁকা ছবিগুলো জাপানের নান্দনিকতাবোধের সাক্ষ্য দেয়।
স্থাপত্যেও এই সৌন্দর্যবোধ প্রতিফলিত হয়। প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির (যেমন: কিয়োটোর কিঙ্কাকুজি – “গোল্ডেন প্যাভিলিয়ন”), শিন্তো ধর্মালয় এবং ঐতিহ্যবাহী চা-বাড়ি বা মাচিয়া গৃহগুলো কাঠ, কাগজ ও প্রাকৃতিক উপাদানে নির্মিত এবং পরিবেশের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
চা সংস্কৃতি ও রীতিনীতি
“চা অনুষ্ঠান” (茶道 – সাদো বা চাদো) জাপানি সংস্কৃতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এটি শুধু চা পান নয়, বরং ধ্যান, শৃঙ্খলা, সৌন্দর্য এবং আন্তরিক আতিথেয়তার এক প্রতীক। অনুষ্ঠানটি এক অনাড়ম্বর পরিবেশে, নির্দিষ্ট নিয়মে চা তৈরি ও পরিবেশনের মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও ঐতিহ্যের অভিজ্ঞতা দেয়।
পোশাক ও কিমোনো
জাপানি ঐতিহ্যবাহী পোশাক ‘কিমোনো’ তার জটিল নকশা ও নিপুণ হাতের কাজের জন্য বিশ্বজুড়ে খ্যাত। বিশেষ করে উৎসব, বিয়ের অনুষ্ঠান কিংবা প্রথাগত অনুষ্ঠানে কিমোনো পরা একটি সাংস্কৃতিক গর্ব। যদিও আজকের দিনে পশ্চিমা পোশাক বেশি প্রচলিত, তবুও কিমোনো এখনো সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ।
ভাষা ও সাহিত্য
জাপানি ভাষা তিনটি প্রধান বর্ণমালায় গঠিত—হিরাগানা, কাটাকানা এবং কাঞ্জি। সাহিত্যেও জাপান বিশ্ববাসীকে সমৃদ্ধ করেছে। হেইয়ান যুগে (৯৪৫–১১৮৫) লেখা “দ্য টেল অফ গেনজি” বিশ্বসাহিত্যের প্রথম উপন্যাস হিসেবে ধরা হয়। এছাড়া হাইকু (Haiku)—মাত্র ১৭ অক্ষরের ছোট কবিতা—প্রকৃতি ও অনুভূতির নিপুণ প্রকাশ করে। জাপানি সাহিত্যের প্রাথমিক রচনাগুলি চীনের সাথে সাংস্কৃতিক যোগাযোগ এবং প্রায়শই ধ্রুপদী চীনা ভাষায় লেখা চীনা সাহিত্যের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল ।
অবশেষে, জাপানি লেখকরা জাপান সম্পর্কে তাদের নিজস্ব রচনা লিখতে শুরু করার সাথে সাথে জাপানি সাহিত্য একটি পৃথক ধারায় বিকশিত হয়। হেইয়ান আমলে মুরাসাকি শিকিবুর লেখা ” দ্য টেল অফ গেঞ্জি” বিশ্বব্যাপী একটি অনন্য জাপানি সাহিত্য হিসেবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতে জাপান পশ্চিমা বাণিজ্য এবং কূটনীতির জন্য তার বন্দরগুলি পুনরায় চালু করার পর থেকে, পশ্চিমা এবং পূর্ব সাহিত্য একে অপরকে দৃঢ়ভাবে প্রভাবিত করেছে এবং তা অব্যাহত রেখেছে।
সংগীত ও নৃত্য
জাপানে ঐতিহ্যবাহী সংগীত যেমন ‘গাগাকু’, ‘শামিসেন’ বা ‘কটো’ বাদ্যযন্ত্রের সুরে গঠিত হলেও আধুনিক সংগীতেও দেশটি অনেক এগিয়েছে। পপ (J-pop), রক এবং এনিমে-সংগীত বিশ্বজুড়ে তরুণদের প্রভাবিত করেছে।
নৃত্যেও নো (Noh) এবং কাবুকি (Kabuki) নাট্যরীতি জাপানের ঐতিহ্য বহন করে। কাবুকিতে অভিনেতারা রঙিন পোশাক ও মুখোশ পরে নাট্যনন্দন পরিবেশনায় অংশ নেয়।
রন্ধনশিল্প
জাপানি খাদ্যসংস্কৃতি যেমন সুস্বাদু, তেমনি শৈল্পিক। সুশি, টেম্পুরা, র্যামেন, উডন, এবং মাচা (সবুজ চা) বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। জাপানিরা খাওয়ার সময় খাদ্যের রঙ, রূপ,এবং উপস্থাপনার ওপর অত্যন্ত গুরুত্ব দেন। রান্নার সাথে ঋতু পরিবর্তনের মিল থাকা তাদের সংস্কৃতির একটি বৈশিষ্ট্য।
সামাজিক আচরণ ও মূল্যবোধ
জাপানি সমাজ শৃঙ্খলা, নম্রতা, দলগত কাজ এবং দায়িত্ববোধকে অগ্রাধিকার দেয়। সম্মান (尊敬 – সোনকে), শ্রদ্ধা ও সামাজিক শালীনতা দৈনন্দিন জীবনের অংশ। নমস্কার (বাও করা),সঠিক সময়ানুবর্তিতা এবং ‘ওমোইয়ারি’(অন্যের অনুভূতি বোঝা) জাপানি আচরণগত বৈশিষ্ট্যের পরিচায়ক।
প্রযুক্তি ও আধুনিকতা
জাপান ঐতিহ্যের পাশাপাশি প্রযুক্তি ও আধুনিকতার প্রতীক। বৈদ্যুতিন পণ্য, রোবোটিক্স, গাড়ি ও ট্রেন প্রযুক্তিতে (যেমন শিনকানসেন – বুলেট ট্রেন) জাপান বিশ্বে শীর্ষস্থানীয়। টোকিও, ওসাকা বা ইয়োকোহামার মতো শহরগুলো নিপুণভাবে আধুনিক জীবনের প্রতিনিধিত্ব করে।
উৎসব ও প্রথা
জাপানে বছরজুড়ে অসংখ্য উৎসব পালিত হয়। ‘হানামি’ (চেরি ফুল দেখা), ‘তানাবাতা’, ‘গিয়ন মাতসুরি’, ‘ওবন’ প্রভৃতি উৎসবে ধর্ম, প্রকৃতি ও পরিবারের বন্ধন প্রকাশ পায়। এই উৎসবগুলোতে ঐতিহ্যবাহী পোশাক, খাবার ও সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মাধ্যমে জাপানি পরিচয় জাগ্রত হয়।
জাপানের জাতীয় প্রতীক
জাপানি দ্বীপপুঞ্জ এশিয়া মহাদেশের পূর্বে অবস্থিত । জাপানকে সবচেয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়, কারণ জাপানের পূর্বে বিশাল প্রশান্ত মহাসাগর অবস্থিত । মিনামিটোরিশিমা হল জাপানের সবচেয়ে পূর্ব দ্বীপ। সুতরাং জাপান হল সেই দেশ যেখানে এশিয়া মহাদেশের আগে সূর্য উদিত হয়। জাপানের নাম তৈরি করা কাঞ্জির আক্ষরিক অর্থ ‘সূর্যের উৎপত্তি'(日本) । জাপানি ভাষায় এটি ‘নিহোন’ বা ‘নিপ্পন’ হিসাবে উচ্চারিত হয়,এবং প্রায়শই “উদীয়মান সূর্যের ভূমি” উপাধি দ্বারা উল্লেখ করা হয় ।
নিশোকি (日章旗, “সূর্য-উদীয়মান পতাকা”)হল জাপানের জাতীয় পতাকা । এটি উদীয়মান সূর্যের প্রতীক এবং জাপানের নামের সাথে মিলে যায়। উদীয়মান সূর্যের পতাকার প্রাচীনতম বিবরণ খ্রিস্টীয় ৭ম শতাব্দীতে। ৬০৭ সালে,”উদীয়মান সূর্যের সম্রাটের কাছ থেকে” দিয়ে শুরু হওয়া একটি সরকারী চিঠিপত্র সুইয়ের চীনা সম্রাট ইয়াংয়ের কাছে পাঠানো হয়েছিল । সুতরাং জাপানি সংস্কৃতিতে সূর্যের কেন্দ্রীয় গুরুত্ব জাতীয় পতাকা এবং অন্যান্য সাংস্কৃতিক সামগ্রীতে প্রতিফলিত হয়। একইভাবে,জাপান আত্মরক্ষা বাহিনীর পতাকায় রয়েছে সূর্যের প্রতীক।
জাপানি সংস্কৃতি একদিকে যেমন হাজার বছরের ঐতিহ্য ও দর্শনের ধারক, তেমনি আধুনিক প্রযুক্তি, শিল্প ও বৈশ্বিক যোগাযোগে অগ্রসর। এর এই দ্বৈত রূপ—সংযম ও উদ্ভাবন—জাপানকে বিশ্বদরবারে একটি অনন্য জাতি হিসেবে তুলে ধরেছে। জাপানের সংস্কৃতি শুধু একটি দেশের পরিচয় নয়,বরং এটি এক বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সাক্ষ্য।
তথ্যসূত্র:
Nippon.com
Japan National Tourism Organization (JNTO)
Encyclopedia Britannica
“The Culture of Japan” – A Short History by Wm. Theodore de Bary