জেমস ওয়াট: আধুনিক শিল্পযুগের পথপ্রদর্শক
জেমস ওয়াট (James Watt) ছিলেন ১৮শ শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট স্কটিশ উদ্ভাবক, যিনি তার বাষ্প ইঞ্জিনের (steam engine) উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পবিপ্লবে (Industrial Revolution) বিপ্লবী পরিবর্তন নিয়ে এসেছিলেন। যদিও বাষ্প ইঞ্জিন তার আগেও আবিষ্কৃত হয়েছিল, ওয়াট এটিকে অনেক বেশি কার্যকর ও ব্যবহারযোগ্য করে তোলেন, যার ফলে উৎপাদন, পরিবহন এবং কারখানা ব্যবস্থায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তার এই উদ্ভাবন বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তিগত সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
প্রারম্ভিক জীবন
জেমস ওয়াট জন্মগ্রহণ করেন ১৭৩৬ সালের ১৯ জানুয়ারি স্কটল্যান্ডের গ্রিনককে। তার বাবা ছিলেন জাহাজ নির্মাতা এবং মা ছিলেন শিক্ষিত ও বুদ্ধিমতী। ছোটবেলা থেকেই ওয়াট গণিত ও প্রকৌশলের প্রতি আগ্রহী ছিলেন। পড়াশোনার পাশাপাশি তিনি যন্ত্রপাতি খুলে-খুলে বুঝতে ভালোবাসতেন। পরে তিনি লন্ডনে যন্ত্র মেরামতের ওপর প্রশিক্ষণ নেন এবং গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে যুক্ত হন, যেখানে তিনি বিজ্ঞানীদের সংস্পর্শে এসে নিজের চিন্তার পরিধি বাড়ান।
ব্যক্তিত্ব
ওয়াট তাত্ত্বিক বিজ্ঞানের জ্ঞানকে ব্যবহারিক প্রয়োগের দক্ষতার সাথে একত্রিত করেছিলেন। হামফ্রে ডেভি তার সম্পর্কে বলেছিলেন, “যারা জেমস ওয়াটকে শুধুমাত্র একজন মহান ব্যবহারিক যন্ত্র প্রকৌশলী হিসেবে বিবেচনা করেন, তারা তার চরিত্র সম্পর্কে একটি ভুল ধারণা করেন; তিনি সমানভাবে একজন প্রাকৃতিক দার্শনিক এবং রসায়নবিদ হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন, এবং তার উদ্ভাবনগুলো তার এই বিজ্ঞানের গভীর জ্ঞানের সাক্ষ্য দেয়, যা প্রতিভার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ এই জ্ঞানগুলোকে ব্যবহারিক প্রয়োগে রূপান্তরিত করার ক্ষমতা।
তিনি শিল্প বিপ্লবের অন্যান্য বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দ্বারা অত্যন্ত সম্মানিত ছিলেন। তিনি লুনার সোসাইটি অফ বার্মিংহামের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। তার বন্ধুবান্ধব এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক সবসময়ই সৌহার্দপূর্ণ এবং দীর্ঘস্থায়ী ছিল।
যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী লর্ড লিভারপুলের মতে,
জীবনের সমস্ত সম্পর্কের ক্ষেত্রে এত অসাধারণ এবং আমায়িক মানুষ আর কখনও ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি না।
ওয়াট প্রায়শই পত্র লিখতেন। কর্নওয়ালে বসবাসের সময়, তিনি প্রতি সপ্তাহে বহুবার বোল্টনকে দীর্ঘ চিঠি লিখতেন। তবে, তিনি তার ফলাফল প্রকাশ করতে এক প্রকার অপছন্দ করতেন। তিনি একজন অসাধারণ ড্রাফ্টসম্যান ছিলেন।
ওয়াট এবং কেটলি
একটি জনপ্রিয় গল্প রয়েছে যে ওয়াট বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কারের অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন একটি কেটলিতে জল ফুটতে দেখে, যেখানে বাষ্প ঢাকনাটি উঠিয়ে দিচ্ছিল এবং এভাবেই ওয়াট বাষ্পের শক্তি সম্পর্কে জানতে পারেন। এই গল্পটি বিভিন্ন রূপে বলা হয়; কিছু ক্ষেত্রে ওয়াট একজন যুবক, আবার অন্য ক্ষেত্রে তিনি প্রাপ্তবয়স্ক, কখনো এটি তার মায়ের কেটলি, কখনো তার মাসির, যা ইঙ্গিত দেয় যে গল্পটি কাল্পনিক হতে পারে। তবে,যাই হোক না কেন, ওয়াট বাষ্প ইঞ্জিন আবিষ্কার করেননি,বরং নিউকমেন ইঞ্জিনের আলাদা কনডেন্সার যুক্ত করে এর তাপ দক্ষতার নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে উল্লেখযোগ্যভাবে দক্ষতা বৃদ্ধি করেছিলেন।
ঐ গল্পটি সম্ভবত ওয়াটের পুত্র জেমস ওয়াট জুনিয়র দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল, যিনি তার পিতার উত্তরাধিকার সংরক্ষণ এবং বাড়িয়ে তুলতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। এই আলোকে এটি আইজ্যাক নিউটন এবং পড়ন্ত আপেলের গল্প এবং তার মহাকর্ষ আবিষ্কারের মতোই কাল্পনিক হিসেবে দেখা যেতে পারে।
কাল্পনিক হলেও, ওয়াট এবং কেটলির গল্পের বাস্তব ভিত্তি রয়েছে। তাপ এবং বাষ্পের তাপ গতিবিদ্যা বুঝতে গিয়ে জেমস ওয়াট অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান এবং তার দিনলিপিতে রেকর্ড রয়েছে যে,এই গবেষণা চালাতে তিনি একটি কেটলিকে বয়লার হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন বাষ্প তৈরি করার জন্য।
ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন
১৭৬৩ সালে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করার সময় ওয়াট একটি পুরনো নিউকোমেন বাষ্প ইঞ্জিন মেরামতের জন্য পান। এই ইঞ্জিনটি মূলত খনিতে পানি নিষ্কাশনের জন্য ব্যবহৃত হতো,তবে এটি অকার্যকর ও জ্বালানির অপচয় করত। ওয়াট লক্ষ্য করলেন যে এই ইঞ্জিন অতিরিক্ত তাপ হারাচ্ছে এবং ধীরে কাজ করছে।
এই পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে ওয়াট একটি নতুন ধারণা আনেন: ইঞ্জিনের ভেতর একটি “আলাদা কনডেনসার” বসানো। ১৭৬৫ সালে তিনি সফলভাবে একটি উন্নত ইঞ্জিনের নকশা তৈরি করেন যেখানে বাষ্প ঠান্ডা হওয়ার জন্য একটি পৃথক চেম্বার ব্যবহৃত হয়। এর ফলে জ্বালানি অনেক কম লাগত এবং ইঞ্জিনের গতি ও কার্যকারিতা বহুগুণে বেড়ে যায়।
বাণিজ্যিক সাফল্য
ওয়াটের উদ্ভাবনকে বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য করতে সহায়তা করেন ব্যবসায়ী ম্যাথিউ বোলটন। তারা ১৭৭৫ সালে একত্রে “বোলটন অ্যান্ড ওয়াট” কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই কোম্পানি নতুন বাষ্প ইঞ্জিন উৎপাদন করে খনি, কারখানা, বস্ত্র শিল্প, কাগজ কল এবং পরবর্তীতে রেলওয়েতে ব্যবহারের জন্য সরবরাহ করে। ওয়াটের ইঞ্জিন ধীরে ধীরে সারা ইংল্যান্ড এবং ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে।
অবদান ও উদ্ভাবনী দক্ষতা
জেমস ওয়াট শুধু বাষ্প ইঞ্জিনকেই উন্নত করেননি, বরং যন্ত্রবিদ্যার বিভিন্ন দিকেও তার অবদান ছিল অসাধারণ। তিনি “হর্সপাওয়ার” (horsepower) ধারণার প্রচলন করেন, যা ইঞ্জিনের ক্ষমতা পরিমাপের একটি পদ্ধতি। এছাড়া তিনি সূক্ষ্ম মাপজোখের যন্ত্র তৈরি, কপ্লিং গিয়ার এবং প্রেসার গেজের উন্নয়ন করেন।
তার নাম অনুসারেই আধুনিক বৈদ্যুতিক শক্তি পরিমাপের একক “ওয়াট” (Watt) রাখা হয়েছে।
শিল্পবিপ্লবে প্রভাব
ওয়াটের বাষ্প ইঞ্জিন শিল্পবিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে ওঠে। এর মাধ্যমে:
উৎপাদনে গতি আসে এবং শ্রম নির্ভরতা কমে যায়।
কারখানাগুলো নদীর ধারে না গড়ে অন্যত্রও গড়ে ওঠে।
পরিবহনের জন্য রেলওয়ে এবং জাহাজে বাষ্প ইঞ্জিন ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
খনিজ ও লোহা উত্তোলন সহজ হয়। এভাবে সমাজ ও অর্থনীতির কাঠামো আমূল বদলে যায় এবং আধুনিক সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত হয়।
সম্মাননা
ওয়াট তার নিজের সময়কালে বহুল সম্মানিত ছিলেন। ১৭৮৪ সালে, তাকে এডিনবার্গের রাজকীয় সোসাইটির একজন ফেলো করা হয় । ওয়াট ১৭৮৭ সালে নেদারল্যান্ডের রতারদামের বাটাভিয়ান সোসাইটি ফর এক্সপেরিমেন্টাল ফিলোসফির সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৭৮৯ সালে, তিনি পুর প্রকৌশলীদের স্মিটোনিয়ান সোসাইটি নামক এক অভিজাত গোষ্ঠীতে যুক্ত হন। ১৮০৬ সালে, গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডক্টর অফ ল’ উপাধিতে ভূষিত করে। আকাদেমি ফ্রঁসেজ তাকে একজন সংশ্লিষ্ট সদস্য নির্বাচিত করে এবং ১৮১৪ সালে তাকে একজন বিদেশী সহযোগী করা হয়।
২৯ মে ২০০৯-এ, ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ঘোষণা করে যে বোল্টন এবং ওয়াট একটি নতুন £50 নোটে উপস্থিত থাকবেন। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে, ঘোষণা করা হয়েছিল যে নোটগুলি ২ নভেম্বর প্রচলনে প্রবেশ করবে। ২০১১ সালে,তিনি স্কটিশ ইঞ্জিনিয়ারিং হল অফ ফেমের সাতজন অভিষিক্তদের একজন ছিলেন।
ব্যক্তিগত জীবন ও মৃত্যু
জেমস ওয়াটের ব্যক্তিগত জীবন ছিল তুলনামূলকভাবে নিরিবিলি। তার প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি আবার বিয়ে করেন এবং সন্তানদের দেখাশোনা করেন। তিনি জীবনের শেষদিকে অবসর নিয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।
ওয়াট ২৫ আগস্ট ১৮১৯ সালে স্ট্যাফোর্ডশায়ারের হ্যান্ডসওর্থে (বর্তমানে বার্মিংহামের অংশ) তার বাড়ি “হিথফিল্ড হলে” ৮৩ বছর বয়সে মারা যান। ২ সেপ্টেম্বর হ্যান্ডসওর্থের সন্ত মারির গির্জা-সংলগ্ন কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়। গির্জাটি পরবর্তীতে সম্প্রসারিত হয়েছে এবং তার কবরটি এখন গির্জার ভিতরে অবস্থিত।
উত্তরাধিকার
ওয়াটের মৃত্যু হলেও তার প্রভাব যুগের পর যুগ ধরে রয়ে গেছে। ১৮৮৯ সালে তার সম্মানে একটি মূর্তি স্থাপন করা হয় লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবে-তে। আজও তার নাম শ্রদ্ধার সাথে উচ্চারিত হয়, বিশেষত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জগতে।
তার উন্নত বাষ্প ইঞ্জিন ছাড়া শিল্পবিপ্লব হয়তো এতো দ্রুত বাস্তবায়ন হতো না, এবং আধুনিক পৃথিবী যে প্রযুক্তিনির্ভর রূপ ধারণ করেছে, তা বিলম্বিত বা একেবারে ভিন্নরূপে গড়ে উঠত।
জেমস ওয়াট ছিলেন একজন দুরদর্শী উদ্ভাবক, যিনি শুধু একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেননি, বরং একটি যুগ পরিবর্তনের সূচনা করেছিলেন। তার বাষ্প ইঞ্জিন আধুনিক পৃথিবীর প্রযুক্তি, উৎপাদন, এবং জীবনযাত্রার পদ্ধতিকে বদলে দিয়েছিল। তাই ইতিহাসে জেমস ওয়াটের স্থান এক অনন্য উচ্চতায়।
তথ্যসূত্র:
“James Watt” – Encyclopaedia Britannica
National Museums Scotland – James Watt and the Steam Engine
Science Museum, London – James Watt: Making the world work
BBC History – Historic Figures: James Watt (1736–1819)