ইতালীয় রেনেসাঁ সংস্কৃতি
রেনেসাঁ শব্দের অর্থ “পুনর্জন্ম”। ১৪শ শতকের মাঝামাঝি থেকে ১৭শ শতকের শুরু পর্যন্ত সময়ে ইউরোপে যে সাংস্কৃতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং শৈল্পিক বিপ্লব ঘটে, তাকে রেনেসাঁ বলা হয়।
এই বিপ্লবের সূতিকাগার ছিল ইতালি, বিশেষ করে ফ্লোরেন্স শহর। ইতালীয় রেনেসাঁ কেবল শিল্পকলার পরিবর্তন আনেনি, বরং দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত ও সমাজজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলেছিল।
ইউরোপে মধ্যযুগীয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছায়। যার ফলে কুসংস্কার, অজ্ঞতা, বিবেকহীনতার সৃষ্টি হয় এবং স্বাধীন ও মুক্তচিন্তার দ্বার রুদ্ধ হয়। ফলে ব্যক্তি মানসিকতার বিকাশ ব্যাহত হয়।
তাদের মধ্যে সুষ্ঠ চিন্তা-চেতনা, দূর্বার অনুসন্ধিৎসা ও অবারিত জ্ঞানের দ্বার না থাকায় ব্যক্তি মনের প্রকৃত বিকাশ অসম্ভব হয়। এ দুর্বিসহঃ অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের জন্যই রেনেসাঁর সূত্রপাত হয়। আর এই রেনেসাঁ বলতে বুঝি অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্যযুগ থেকে উদ্ধার প্রাপ্তি।
রেনেসাঁর পটভূমি
মধ্যযুগের ইউরোপ ধর্মভিত্তিক এবং নিরঙ্কুশ চার্চ-নির্ভর ছিল। মানুষ তখন ধর্মীয় বিশ্বাসে বন্দি ছিল, যেখানে জীবন মানেই ছিল পাপমুক্তির সংগ্রাম। ১৩০০ সালের দিকে ইতালির শহরগুলোতে ব্যবসা, বাণিজ্য এবং মানবিক চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটতে থাকে।
ধনী প্যাট্রন পরিবার যেমন মেডিচি (Medici) পরিবার শিল্পী, সাহিত্যিক এবং বিজ্ঞানীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতে শুরু করে। এর ফলে “মানবতাবাদ” বা Humanism নামক দর্শনের প্রসার ঘটে, যেখানে মানুষ ও মানবিক গুণাবলিকে সর্বাগ্রে মূল্যায়ন করা হয়।
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য
ইতালীয় রেনেসাঁর সবচেয়ে দৃশ্যমান পরিবর্তন ঘটে চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে। মধ্যযুগীয় চিত্রকলায় যেখানে ধর্মীয় বিষয়ে সীমাবদ্ধতা ছিল, সেখানে রেনেসাঁ চিত্রকলায় মানুষের দৈহিক সৌন্দর্য, প্রকৃতি, অনুভব ও বাস্তবতা উঠে আসে। চিত্রশিল্পীরা মানুষের শরীর, আলো-আঁধারির ব্যবহার এবং গাণিতিক দৃষ্টিকোণকে (perspective) দক্ষতার সাথে চিত্রিত করতে সক্ষম হন।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি – তাঁর “Mona Lisa” এবং “The Last Supper” রেনেসাঁর যুগান্তকারী শিল্পকর্ম। রেনেসাঁ যে ক’জন মহান ব্যক্তির সৃষ্টি করেছিল তার মধ্যে নিঃসন্দেহে শ্রেষ্ঠ ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। উচ্চ রেনেসাঁ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ তিনজন সৃজনশীল শিল্পীদের মধ্যে তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য ও বিশ্বজনীন।
তাঁকে শুধু রেনেসাঁ যুগেই নয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ একজন শিল্পী হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তিনি এমন মানসিক শক্তিতে বলিয়ান ছিলেন যে সেসময়ের পরিপ্রেক্ষিতে ছিলেন এক বিস্ময়। তার বুদ্ধিবৃত্তি এমন উচ্চস্তরের ছিল যে, সে সময়ের দেহ বিজ্ঞান, নৌ-বিদ্যা এবং বিংশ শতাব্দীর বহু বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের নেপথ্য জনক ছিলেন তিনি।
কোন একটা নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে তিনি স্থির থাকতে পারেননি। তার কাজের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলোর মূলে রয়েছে রঙের ব্যবহার, উদ্ভাবনী কৌশল, শরীরস্থান, আলো, উদ্ভিদতত্ত¡ এবং ভ‚-তত্ত¡ সম্পর্কে তার বিস্তারিত জ্ঞান।
একাধারে কবি, দার্শনিক, প্রকৌশলী, স্থপতিবিদ, ভাস্কর, সঙ্গীতজ্ঞ, সমরযন্ত্রশিল্পী, দেহতত্ত¡বিদসহ অন্যান্য পরিচয়েও সুবিদিত এই মানব ইতিহাসের বহু আবিষ্কারের পথিকৃৎ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণোজ্জল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন।
মাইকেলএঞ্জেলো – তিনি “David” এবং সিস্টাইন চ্যাপেলের ছাদচিত্র আঁকেন, যেখানে বাইবেলের কাহিনিকে মানবিক রূপে উপস্থাপন করা হয়। মাইকেল এঞ্জেলো রেনেসাঁ যুগের একজন ইতালীয় ভাস্কর, চিত্রকর, স্থপতি এবং কবি।
তার পুরো নাম মিকেল এঞ্জেলো দি লোদোভিকো বুনোরত্তি সিমোনি। তার বৈচিত্রময়তার ব্যাপ্তি এবং বিস্তৃতির কারণে তাঁকে রেনেসাঁ মানব বলে বর্ননা করা হয়।
তার জীবিতকালেই তাঁকে শ্রেষ্ঠ জীবিত শিল্পী হিসেবে বিবেচনা করা হত এবং ইতিহাসেও তাঁকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পীদের একজন হিসেবে ধরা হয়। ষোড়শ শতাব্দীর শিল্পীদের মধ্যে তারই বিভিন্ন কাজ ও খসড়া চিত্র বেশি পরিমাণে সংরক্ষিত আছে।
রাফায়েল – “School of Athens” চিত্রে প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকদের সঙ্গে রেনেসাঁর ভাবধারার সমন্বয় ঘটান। উচ্চ রেনেসাঁর শিল্পীগণের মধ্যে স্বাতন্ত্র্যের অধিকারী ছিলেন রাফায়েল।
তার বেড়ে ওঠার ধরনটি ছিল অনেকটা পঞ্চদশ শতাব্দীর শিল্পীদের মতো। যদিও তিনি লিওনার্দো ও মিকেল এঞ্জেলোর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন তথাপি তিনি নিজে এক স্বকীয় ধারা নির্মাণ করতে সক্ষম হন।
উপরন্তু উচ্চ রেনেসাঁর শিল্পকর্মের সাথে তার শিল্পকর্ম যথেষ্ট সাযুজ্যপূর্ণ। যাঁর কাছ থেকেই শিখুন না কেন তার শক্তিশালী রীতি সবসময়ই তার শিল্পকর্মের মাঝে অনুধাবন করা যায়।
সাহিত্য
ইতালীয় রেনেসাঁর আরেকটি বড় দিক ছিল সাহিত্য। লেখকেরা ধর্মীয় বিষয় ছাড়াও প্রেম, প্রকৃতি, রাজনীতি, ইতিহাস এবং মানব অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন।
দান্তে আলিগিয়েরি – তার “Divine Comedy” (১৩০৮-২১) রেনেসাঁ সাহিত্যের অন্যতম ভিত্তি। তিনি ইতালীয় ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন, যা ল্যাটিনের একচেটিয়া আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করে।
ফ্রান্সেসকো পেত্রার্ক – তাকে “মানবতাবাদের জনক” বলা হয়।
বোকাচ্চিও – তার “Decameron” গল্পসংকলন মধ্যযুগীয় সমাজের জীবন্ত চিত্র তুলে ধরে।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
ইতালীয় রেনেসাঁ ছিল জ্ঞান-বিজ্ঞানেরও জাগরণ। মানুষ মহাবিশ্বকে ঈশ্বরনির্ভর ব্যাখ্যার পরিবর্তে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির মাধ্যমে বোঝার চেষ্টা করে।
গ্যালিলিও গ্যালিলেই – আধুনিক পদার্থবিদ্যা ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। টেলিস্কোপ আবিষ্কার করে সৌরজগত সম্পর্কে ধারণা বদলে দেন।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি – চিত্রশিল্পী হওয়ার পাশাপাশি ছিলেন বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী ও অ্যানাটমির পথিকৃৎ। তাঁর নোটবুকে হেলিকপ্টার, সাবমেরিন ও মানবদেহের নিখুঁত অঙ্কন পাওয়া যায়।
স্থাপত্য
রেনেসাঁ স্থাপত্যে প্রাচীন গ্রিক ও রোমান স্থাপত্যের সৌন্দর্য ও গাণিতিক নিখুঁততা পুনরায় আবিষ্কৃত হয়। আর্ক, কলাম, গম্বুজ ও ভারসাম্যপূর্ণ অনুপাতের উপর জোর দেওয়া হয়।
ফিলিপ্পো ব্রুনেলেস্কি – ফ্লোরেন্স ক্যাথেড্রালের বিশাল গম্বুজ নির্মাণ করে স্থাপত্যশিল্পে নতুন মাত্রা যোগ করেন।
লিওন বাতিস্তা আলবার্তি – তাঁর লেখা স্থাপত্যবিষয়ক গ্রন্থ “De re aedificatoria” রেনেসাঁ স্থাপত্যের ম্যানুয়াল হিসেবে বিবেচিত হয়।
সংগীত
রেনেসাঁ সংগীতে গীতিকবিতা ও যন্ত্রসংগীত সমানভাবে বিকশিত হয়। নোটেশন পদ্ধতির উন্নয়ন সংগীতকে আরও সুশৃঙ্খল করে তোলে। ধর্মীয় ও ধর্মনিরপেক্ষ সংগীত উভয়ই জনপ্রিয়তা পায়।
জোসকিন দে প্রে, পিয়ারলুইজি দা পালেস্ত্রিনা প্রমুখ সুরকাররা গির্জা সংগীতের পাশাপাশি প্রেম ও প্রকৃতিনির্ভর সংগীত রচনা করেন।
সমাজ ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি
রেনেসাঁ কেবল উচ্চশ্রেণির অভিজাত সমাজে সীমাবদ্ধ ছিল না। শিক্ষা, মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার (গুটেনবার্গ, ১৪৫৫), এবং বইয়ের সহজলভ্যতার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যেও জ্ঞানের প্রসার ঘটে। মানবতাবাদী চিন্তা নারী, শিশু ও শ্রমজীবীদের অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন তোলে। সমাজে নতুনভাবে নাগরিকত্ব, দায়িত্ববোধ ও স্বাধীনতার মূল্যায়ন শুরু হয়।
ইতালিতে রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার কারণ
রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পর কনস্টান্টিনোপলকে কেন্দ্র করে নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে এবং তা পশ্চিম ইউরোপে যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে। পরবর্তীতে বিভিন্ন নগররাষ্ট্রের উৎপত্তি হয়। এসমস্ত নগররাষ্ট্র একটি অপেক্ষা অন্যটি অধিকতর উন্নতি লাভ করতে থাকে।
এতে যে প্রতিযোগিতার সৃষ্টি হয় তাই রেনেসাঁ সৃষ্টির অন্যতম কারণ। ইউরোপের অন্যান্য দেশের চেয়ে ইতালি এতে সর্বাগ্রে অবস্থান নেয়। প্রকৃতপক্ষে রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই ইতালির অর্থনীতি যথেষ্ট শক্ত ভিত্তির ওপর গড়ে ওঠে।
যদিও রেনেসাঁ শুধু ইতালিতেই নয় এর আহবান ইতালির সীমা ছাড়িয়ে আল্পস পর্বতের উত্তরে ফ্রান্স, জার্মানি, স্পেন, পর্তুগাল, হল্যান্ড, ইংল্যান্ড প্রভৃতি দেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। কিন্তু প্রথমে ইতালিতেই রেনেসাঁ সংঘটিত হওয়ার পিছনে কতগুলো বিশেষ কারণ অবশ্যই ছিল।
ভৌগোলিক কারণ:
ইতালির ভৌগোলিক অবস্থান ইতালিবাসীকে রেনেসাঁর দিকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছিল। ভূমধ্য সাগরের মধ্যস্থলে অবস্থিত হওয়ার কারণে ঐ অঞ্চলের বাণিজ্য ও সংস্কৃতির স্বাভাবিক কেন্দ্রস্থল ছিল ইতালি। ক্রুসেডের সূত্র ধরে ইউরোপ ও আরব দেশের মধ্যে যে ব্যবসা-বাণিজ্য গড়ে ওঠেছিল তার সবচেয়ে বেশি সুযোগ গ্রহণ করেছিল ইতালি।
কনস্টান্টিনোপলের পতন:
১৪৫৩ খ্রীষ্টাব্দে উসমানীয় সাম্রাজ্য যখন কনস্টান্টিনোপল দখল করে তখন সেখানকার পন্ডিতগণ ইতালিতে চলে আসে। তাঁদের আগমন ইতালিতে রেনেসাঁ সৃষ্টির পথকে আরও অধিক সহজ করে দেয়। বোকাচ্ছিও, পেত্রার্ক প্রভৃতি হিউম্যানিষ্টদের চেষ্টায় ইতালিতে যে সাহিত্য ও শিল্পনুরাগ জেগেছিল কনস্টান্টিনোপল হতে পণ্ডিতদের আগমনের ফলে সেই অনুরাগ এক ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা লাভ করে।
ইতালীয় শহরের প্রভাব:
ইতালীয় শহরগুলো মধ্যযুগে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে। এই সকল শহরেই মধ্যযুগীয় সভ্যতা সর্বপ্রথম আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য গ্রহণ করতে শুরু করে।
রোমান সভ্যতার সাথে যোগাযোগ:
ইতালিতে রেনেসাঁ শুরু হওয়ার অপর একটি কারণ ছিল ইতালির উপদ্বীপের সাথে রোম নগরের ঘনিষ্ঠতা। ইতালি উপর প্রাচীন রোমান সংস্কৃতি ও সভ্যতার গভীর প্রভাব ইতালিবাসীদের স্বভাবতই প্রাচীনকালের রোমান সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবান করে তুলেছিল।
ইউরোপের অন্য দেশে প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে পঞ্চদশ শতাব্দীর চিন্তাধারার কোন প্রকার যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু ইতালিতে প্রাচীন গ্রিক রোমান সভ্যতা হতে পরবর্তী কালের ধ্যান-ধারণা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়নি। তাই প্রাচীন সভ্যতার সাথে এই যোগাযোগ রেনেসাঁসের পথ সহজ করে দিয়েছিল অনেকটাই।
ইতালির ধর্মাধিষ্ঠানের প্রভাব:
রোমান সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক একতা বিনষ্ট হওয়ার পরও রোমান খ্রীষ্ট ধর্মাধিষ্ঠান রোমের প্রাচীন ঐতিহ্য ও গৌরব অক্ষুণ্ণ রাখতে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এটি ভিন্ন রাজনৈতিক দুর্যোগে ধর্মাধিষ্ঠান গুলোর শিক্ষা ও সংস্কৃতির চর্চা অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। লাতিন ভাষার উন্নতি সাধনে রোমের ধর্মাধিষ্ঠানের দান নেহাত কম ছিল না।
হিউম্যানিষ্টদের প্রভাব:
রেনেসাঁসের পথ প্রদর্শকের অনেকেই ছিলেন ইতালিবাসী। সাহিত্য, শিল্পকলা প্রভৃতি প্রত্যেক দিক দিয়েই ইতালি প্রতিভাবান ব্যক্তিদের জন্মস্থানে পরিণত হয়েছিল। পেত্রার্ক, বোকাচ্চিও প্রভৃতি মানবতাবাদী সাহিত্যিকদের সকলেই ছিলেন ইতালির লোক।
বিভিন্ন জাতির মিলন ক্ষেত্র হওয়ার প্রভাব:
রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংসের সময় (৪৭৬) হতে ইতালি গথ, লোম্বার্ড, ফ্রাঙ্ক, সারমেন, নর্মান ও জার্মান প্রভৃতি জাতির মিলন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। এই সূত্রে রোমান, বাইজান্টাইন, আরব, জার্মান প্রভৃতি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও সভ্যতার যোগাযোগের ফলে ইতালিতে এক নব চেতনা ও সংস্কৃতির ব্যাপক উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।
ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাদান:
গির্জা এবং বিভিন্ন শহরে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষাদান শুরু হওয়ার ফলে মানুষের বাস্তব জীবনেও সুখকর, আধ্যাত্মিক উন্নতি ছাড়াও যে মানুষের জীবনের অপর একটি দিক রয়েছে এবং আত্মার অবনতি না ঘটেও যে মানুষ সহজ সরল সুখকর জীবন যাপন করতে পারে এই ধারণা ইতালির বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্রে সর্বপ্রথম জাগরিত হয়েছিল। এই ধারণাই ইতালিবাসীকে রেনেসাঁর বীজ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত করে দিয়ে ছিল।
রোমান সভ্যতার চিহ্ন:
রেনেসাঁ শুরু হওয়ার পর এর গতি এবং ব্যাপ্ততাকে সাহায্য করবার মত প্রাচীন সভ্যতা, সাহিত্য, শিল্প প্রভৃতির চিহ্ন ইতালিতে যথেষ্ট ছিল। ইতালির প্রায় সর্বত্রই ভাস্কর্য, স্থাপত্য, শিল্পকলার চিহ্ন ছিল।
টাইপ মেশিন ও মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার:
পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে সাহিত্য ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় রচনা হয়। গুটেন বার্গের আবিষ্কার দ্বারা ১৪৫৪-৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ল্যাটিন ভাষায় বাইবেল ছাপানো হয়। মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার ছিল রেনেসাঁ বিস্তারে এক যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা।
ছাপাখানা স্থাপিত হবার ফলে প্রচুর পরিমাণে পুস্তক ছাপা হওয়ার ফলে সকলেই পড়াশোনা করার সুযোগ পায়। বই পুস্তক অধ্যয়নের ফলে অন্ধকারাচ্ছন্ন মানুষের মধ্যে নবচেতনার জন্ম হয়।
রেনেসাঁ যুগের চিত্রশিল্পীর প্রভাব:
এ সময়ে শিল্পকলায় জত্তো, মেসাচ্চিও, দোনাতেল্লো, জ্যান-ভ্যান আইক, ব্রুনেলেস্কি, মিকেল এঞ্জলো, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, রাফয়েল, গিবার্টি প্রমুখ শিল্পীর আবির্ভাব ঘটে। এঁদের মধ্যে জত্তো চিত্রকলায় ত্রিমাত্রিকতার সৃষ্টি করেন, ব্রুনেলেস্কি পরিপ্রেক্ষিত আর জ্যান-ভ্যান আইক তেল রং আবিষ্কারের ফলে চিত্রকলা এগিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়।
এই সময়ের শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ছিল একাধারে চিত্রশিল্পী, স্থপতি, ভাস্কর, কবি, সাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও বৈজ্ঞানিক। তিনি ছিলেন রেনেসাঁসের প্রতীকি স্বরূপ। তার আঁকা ‘মোনালিসা’ ও ‘শেষ ভোজ’ শিল্পীদের কাছে আজও বিষ্ময়ের বস্তু। রাফায়েলের ‘এঞ্জেল’ ও মিকেল এ্যাঞ্জেলোর ‘শেষ বিচার’ চিত্রগুলো শিল্পীদের অমূল্য সম্পদ।
রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞান:
কোপার্নিকাস ছিলেন রেনেসাঁ যুগের বিজ্ঞানী। পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘুরে এই সত্য তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন। এই যুগে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র ও দোলক এবং স্যার আইজাক নিউটন তার বিখ্যাত ‘মহাকর্ষ নীতি’ আবিষ্কার করার মাধ্যমে জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যুগান্তর আনয়ন করেন।
ইতালীয় রেনেসাঁ মানব ইতিহাসের এক অবিস্মরণীয় অধ্যায়, যেখানে শিল্প, বিজ্ঞান ও মানবতাবাদ একত্রে বিকশিত হয়েছে। এটি শুধু অতীতের গৌরব নয়, আধুনিক চিন্তা, শিল্প ও সমাজের জন্মও বটে। মানুষের ভাবনার জগতে “আলো ও যুক্তির” এই যুগ আজও আমাদের জন্য প্রেরণা।
তথ্যসূত্র:
Peter Burke, The Italian Renaissance: Culture and Society in Italy
John Hale, The Civilization of Europe in the Renaissance
Encyclopaedia Britannica