Friday, October 3, 2025
Homeবিজ্ঞানচাকা আবিষ্কার: মানব সভ্যতার গতির সূচনা

চাকা আবিষ্কার: মানব সভ্যতার গতির সূচনা

চাকা আবিষ্কার এর ইতিহাস

চাকা বা চক্র যানবাহনে ব্যবহৃত একপ্রকারের বৃত্তাকার যন্ত্রাংশ। চাকার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত অক্ষ বরাবর এটি ঘুরতে পারে। চাকার উপরে গড়িয়ে গড়িয়ে যানবাহন অবস্থান পরিবর্তন করে থাকে। মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিষ্কারকে একটি যুগান্তকারী ঘটনা হিসাবে ধরা হয়। চাকা মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার, যা পরিবহন, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির বিকাশে বিপ্লব ঘটিয়েছে। এর উৎপত্তি হাজার হাজার বছর আগের, যখন মানুষ প্রাথমিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে জীবনের সুবিধা বাড়াতে শুরু করে।

চাকা আবিষ্কার করে কারা

চাকা আবিষ্কারের কৃতিত্ব সুমেরীয় সভ্যতাকে দেওয়া হয়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে নিম্ন মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) সুমেরীয়রা প্রথম কাঠের শক্ত চাকতিতে ঘূর্ণায়মান অক্ষ স্থাপন করে চাকা আবিষ্কার করে, যা মূলত কুমোরদের কাজে ব্যবহৃত হত। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে মেসোপটেমিয়া অঞ্চলে সুমেরীয় সভ্যতার মানুষ প্রথম চাকার ধারণা নিয়ে আসে।

চাকা আবিষ্কার হয় কোন সভ্যতায়

চাকা মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সুমেরীয়দের দ্বারা আবিষ্কৃত হয়েছিল বলে মনে করা হয়, যা খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে (আনুমানিক ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ঘটেছিল। এটি প্রথমবার কুমোরদের কাজের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল এবং পরবর্তীতে পরিবহন ও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার শুরু হয়। ভারী বস্তু সরানোর জন্য মানুষ গাছের গুঁড়িকে গোল করে কেটে তার উপর জিনিস রেখে গড়িয়ে নিয়ে যেত, যা ছিল চাকা আবিষ্কারের পূর্বসূরী। মেসোপটেমিয়ার সুমেরীয়রা এই ধারণাকে বিকশিত করে কাঠের চাকতি ব্যবহার করে এবং এর কেন্দ্রে একটি ঘূর্ণায়মান অক্ষ স্থাপন করে, যা চাকার প্রথম রূপ ছিল।

প্রাচীন সূচনা

চাকা আবিষ্কারের প্রাচীন সূচনা ঘটেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০-এর দিকে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরান)। প্রথমে এটি মূলত কুমোরদের দ্বারা মৃৎশিল্পে ব্যবহৃত হতো। পরিবহন বা যাতায়াতের জন্য চাকার ব্যবহার এরও প্রায় ৩০০ বছর পরে শুরু হয়, যখন দুটি চাকা ও একটি দণ্ডকে জুড়ে দিয়ে প্রথম গাড়ি তৈরি করা হয়।

চাকার আবিষ্কারের সময়রেখা

প্রথম ব্যবহার (৪২০০-৪০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় কুমোরদের হাতে মৃৎশিল্প তৈরিতে চাকা ব্যবহৃত হতে শুরু করে।

পরিবহন শুরু (৩৫০০-৩৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ): চাকার পরিবহন হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। তখন দুটি চাকা ও একটি দণ্ড যুক্ত করে প্রথম গাড়ি তৈরি করা হয়, যা ভারী জিনিসপত্র টানতে ব্যবহার করা হত।

প্রাচীন প্রমাণ: ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের ককেশাসের উত্তর দিকের কবরগুলিতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অনেক বিশেষজ্ঞের মতে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের দিকে প্রাচীন মেসোপটেমিয়াতে চাকা আবিষ্কৃত হয়। শুরুতে কুমোরদের কাজে এটির ব্যবহার ছিলো। ককেশাসের উত্তর দিকে বেশ কিছু কবর পাওয়া গেছে যাতে ৩৭০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ হতে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেয়া হয়েছে। ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে।

এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরানো নিদর্শন। খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ সহস্রাব্দ নাগাদ চাকার ব্যবহার ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়াতে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় উপমহাদেশের সিন্ধু সভ্যতায় চাকার ব্যবহার শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৩য় সহস্রাব্দের দিকে। চীনে চাকার ব্যবহার দেখা যায় ১২০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, যখন চাকাযুক্ত গাড়ির প্রচলন হয়।

তবে বারবিয়েরি-লো (২০০০) এর মতে আরো পূর্বে খ্রিস্টপূর্ব ২য় সহস্রাব্দের দিকে চীনে চাকার প্রচলন ছিলো। মজার ব্যাপার হলো, প্রথমে চাকা পরিবহনের জন্য নয়, মাটির পাত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল — অর্থাৎ মৃৎশিল্পের ‘পটার্স হুইল’। পরে মানুষ বুঝতে পারে, একই প্রযুক্তি দিয়ে বোঝা বহনের গাড়ি বানানো সম্ভব।

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন

চাকা মানব ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন যা কৃষি, শিল্প, এবং পরিবহন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন এনেছে। এটি কেবল একটি প্রযুক্তিই নয়, বরং বিভিন্ন সভ্যতার অগ্রগতি এবং সামাজিক অগ্রগতির একটি মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রথম চাকাযুক্ত যানবাহন সম্ভবত ছিল দুটি বা চারটি চাকা বিশিষ্ট কাঠের গাড়ি। শুরুতে চাকা ও এক্সেল (axle) আলাদা অংশ ছিল না; পরে আলাদা করে তৈরির ফলে ঘর্ষণ কমে গিয়ে গতি বৃদ্ধি পায়।

প্রাচীন সুমের, সিন্ধু সভ্যতা, মিশর এবং চীন—সব জায়গায়ই চাকা আলাদা আলাদা সময়ে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। উদাহরণস্বরূপ:

সুমের: যুদ্ধরথে (চ্যারিয়ট) চাকার ব্যবহার।

মিশর: দ্রুতগতির হালকা চাকা, যেখানে কাঠের স্পোক (spoke) ব্যবহার করা হতো।

চীন: গাড়ি ও কৃষিকাজে চাকার ব্যবহার।

পরিবহন বিপ্লব

চাকা আবিষ্কার পরিবহন ও সভ্যতার এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে, যা মানুষ ও পণ্য পরিবহনে যুগান্তকারী সাফল্য এনে দেয়। এর মাধ্যমে দীর্ঘ দূরত্বে ভারী বোঝা বহন করা সহজ হয়, যা বাণিজ্য ও বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকে ত্বরান্বিত করে। মেসোপটেমিয়ায় প্রায় ৩৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রথম কঠিন কাঠের চাকতি বা ডিস্ক চাকার উদ্ভাবন হয়। চাকার ব্যবহার শুধু পরিবহনকেই উন্নত করেনি, বরং মৃৎশিল্প, সেচ ও কলকারখানার মতো বিভিন্ন শিল্পে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। আগে যেখানে পণ্য বহন করতে অনেক শ্রমিক ও প্রাণীর প্রয়োজন হতো, সেখানে গাড়ি ব্যবহার করে অনেক বেশি বোঝা একসাথে, দ্রুত ও কম খরচে পরিবহন করা সম্ভব হয়। এটি বাণিজ্য, নগরায়ণ ও সংস্কৃতির বিনিময়কে ত্বরান্বিত করে।

কার্যপ্রণালী

চাকা আবিষ্কারের সঠিক কার্যপ্রণালী অজানা, তবে ধারণা করা হয় যে প্রথমে ভারি বস্তু সরানোর জন্য গাছের গুঁড়ি বা রোলার ব্যবহারের ধারণা থেকে চাকার উদ্ভাবন হয়। এরপর এর একটি অংশ অক্ষকে ধরে রাখার জন্য একটি গর্ত করা হয় এবং একটি শক্ত কাঠের ডিস্ক তৈরি করা হয়, যা থেকে প্রথম চাকাগুলো তৈরি হয়েছিল। প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৩৫০০ অব্দের দিকে মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাক) প্রথম চাকা ব্যবহার শুরু হয়, যা মূলত কুম্ভকারের চাকা হিসেবে এবং পরে স্লেজ গাড়ির কাজে ব্যবহৃত হতো। চাকা এক প্রকারের যন্ত্র যা বলের প্রভাবে কোনো বস্তুকে একটি তলের উপর দিয়ে দক্ষভাবে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। অক্ষদণ্ডের সাথে যুক্ত করে গাড়িতে চাকা ব্যবহার করা হয়। এখানে হয় চাকা ঘুরে অথবা অক্ষদণ্ডটি নিজেই গাড়ির সাপেক্ষে ঘুরে, যার ফলে গাড়িটি চলতে পারে।

চাকা ব্যবহার করলে তলের উপরে টেনে হিচড়ে নেয়ার চাইতে অনেক সহজে বস্তু স্থানান্তর করা যায়। এর ব্যাখ্যা হলো এরকম —

সমতলটির উপরে প্রযুক্ত বল দুই ক্ষেত্রেই সমান থাকে, নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য অতিক্রম করতে গেলে স্লাইডিং দূরত্ব চাকার ক্ষেত্রে কম হয়ে থাকে।চাকার ঘর্ষণের গুণাংক কম হয়। ঘূর্ণনের ঘর্ষণ কমানোর জন্য চাকায় বিয়ারিং ব্যবহার করা হয়। সবচেয়ে প্রাচীন ও সরলতম বিয়ারিং হলো একটা বৃত্তাকার গর্ত যার মধ্য দিয়ে অক্ষদণ্ডটি ঢুকিয়ে দেয়া হয়।

অন্যান্য ব্যবহার

চাকা আবিষ্কার মূলত কুমোরের চাকা (মৃৎশিল্প) হিসেবে শুরু হয়েছিল, যা পরে পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং কৃষি ও কারুশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। আধুনিক জীবনে চাকা ও অ্যাক্সেল শুধুমাত্র পরিবহন, যেমন সাইকেল ও গাড়ির চাকাতেই নয়, বরং ঘড়ি, পিৎজা কাটার, উইন্ডমিল এবং অন্যান্য অসংখ্য যান্ত্রিক ও দৈনন্দিন সরঞ্জামের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

চাকা শুধু পরিবহনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তীতে এটি নানা যন্ত্রে ব্যবহৃত হতে শুরু করে, যেমন—

জলচাকা (Water Wheel), ঘড়ি ও গিয়ার সিস্টেম, কারুশিল্প যন্ত্র, শিল্প বিপ্লবের মেশিনারি, প্রতীকী ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব। অনেক সংস্কৃতিতে চাকা উন্নতি ও জীবনের চক্রের প্রতীক হয়ে ওঠে। উদাহরণস্বরূপ, বৌদ্ধ ধর্মে ‘ধর্মচক্র’ জ্ঞান ও মুক্তির প্রতীক।

আধুনিক যুগে চাকার বিবর্তন

আজকের চাকা আবিষ্কার প্রাচীন কাঠের চাকাগুলোর তুলনায় অনেক উন্নত। রাবার, ধাতু ও বিভিন্ন যৌগিক পদার্থ দিয়ে বানানো হয়, টায়ারে বায়ু চাপ, শক অ্যাবজরবার, ও আধুনিক বেয়ারিং প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয়। বিমানের ল্যান্ডিং গিয়ার থেকে শুরু করে মহাকাশযানের রোভার—চাকা সর্বত্র উপস্থিত। চাকা আবিষ্কার ছিল মানব সৃজনশীলতার এক অসাধারণ উদাহরণ, যা কেবল প্রযুক্তি নয়, সভ্যতার গতিপথকেই বদলে দিয়েছে। এটি প্রমাণ করে যে ছোট একটি ধারণা—একটি ঘূর্ণায়মান কাঠের টুকরা—মানব ইতিহাসের অন্যতম বড় বিপ্লব ঘটাতে পারে।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকা আবিষ্কার একটি মৌলিক মাইলফলক। এটি শুধু একটি যান্ত্রিক উদ্ভাবন নয়, বরং মানব চিন্তা, সৃজনশীলতা এবং প্রযুক্তিগত অগ্রগতির প্রতীক। কৃষিকাজ, পরিবহন, স্থাপত্য, যুদ্ধনীতি থেকে শুরু করে শিল্প বিপ্লব এবং আধুনিক প্রযুক্তি পর্যন্ত—চাকা আবিষ্কার সর্বত্র তার প্রভাব বিস্তার করেছে।

চাকা আবিষ্কার মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজতর করেছে, দূরত্ব কমিয়েছে, পণ্য পরিবহন ও বাণিজ্যকে গতিশীল করেছে এবং সভ্যতাকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করেছে। বর্তমান সময়ে গাড়ি, ট্রেন, বিমান, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক কিংবা মহাকাশযান—সবকিছুতেই চাকার ব্যবহার সরাসরি বা পরোক্ষভাবে যুক্ত।

অতএব বলা যায়, চাকা আবিষ্কার ছাড়া মানবসভ্যতার অগ্রগতি কল্পনা করাই অসম্ভব। এটি শুধু একটি আবিষ্কার নয়; বরং মানবজাতির অগ্রযাত্রার অন্যতম ভিত্তি, যা আজও সভ্যতার উন্নয়নকে অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।

তথ্যসূত্র:

Andrew Sherratt, The First Wheels, Oxford University Press, 2004.

Anthony Harding, The Archaeology of Europe: 3500–1500 BC, Cambridge University Press, 2013.

Piggott, Stuart. The Earliest Wheeled Transport: From the Atlantic Coast to the Caspian Sea, Cornell University Press, 1983.

British Museum – “The Invention of the Wheel” (online collection).

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments