Friday, October 3, 2025
Homeবিজ্ঞানটেলিফোন: শব্দ থেকে সংকেতের যাত্রা

টেলিফোন: শব্দ থেকে সংকেতের যাত্রা

টেলিফোন: শব্দ থেকে সংকেতের যাত্রা

টেলিফোন আবিষ্কার মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল। এর ফলে দূরের মানুষের সঙ্গে সরাসরি কণ্ঠে কথা বলা সম্ভব হয়, যা ডাকপত্র বা টেলিগ্রাফের তুলনায় অনেক দ্রুত ও কার্যকর ছিল।

টেলিফোনের ইতিহাস বলতে সাধারণত বৈদ্যুতিক টেলিফোন উদ্ভাবন ও এর বিকশিত হওয়ার ইতিহাসকে এবং টেলিফোনের পূর্বসূরি যন্ত্রসমূহকে নির্দেশ করে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলকে ১৮৭৬ সালে প্রথম টেলিফোনের পেটেন্ট দেওয়া হয়েছিল।

প্রেক্ষাপট

ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে দ্রুত উন্নয়ন হচ্ছিল। ১৮৩৭ সালে টেলিগ্রাফের আবিষ্কার মানুষের মধ্যে দূরপাল্লার বার্তা বিনিময়ের পথ খুলে দেয়, তবে টেলিগ্রাফে কেবল সংকেত বা কোড পাঠানো যেত, সরাসরি কণ্ঠস্বর নয়। বিজ্ঞানীরা চাচ্ছিলেন এমন একটি যন্ত্র বানাতে, যা মানুষের কণ্ঠকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে আবার মূল রূপে ফিরিয়ে দিতে পারবে।

আবিষ্কারের পথ

টেলিফোনের আবিষ্কারে একাধিক বিজ্ঞানী ও উদ্ভাবকের অবদান রয়েছে। এর মধ্যে দুজন সবচেয়ে বেশি আলোচিত—আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ও ইলিশা গ্রে।

আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল (Alexander Graham Bell) ছিলেন একজন স্কটিশ-জন্ম আমেরিকান বিজ্ঞানী, যিনি বধিরদের শিক্ষা নিয়ে কাজ করতেন। তিনি শব্দ ও শ্রবণ নিয়ে গবেষণার সময় কণ্ঠস্বর বৈদ্যুতিকভাবে স্থানান্তরের ধারণা পান।

ইলিশা গ্রে (Elisha Gray) ছিলেন একজন আমেরিকান উদ্ভাবক, যিনি একই সময়ে প্রায় একই ধরনের প্রযুক্তি উন্নয়ন করছিলেন।

১৮৭৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি, দুজনেই তাদের টেলিফোনের পেটেন্ট আবেদন জমা দেন। ঐতিহাসিকভাবে দেখা যায়, বেল আগে জমা দেওয়ার কারণে পেটেন্ট লাভ করেন। তবে এই বিষয়টি নিয়ে পরে বহু বিতর্ক হয়েছে।

যান্ত্রিক এবং শাব্দিক যন্ত্রসমূহ

তড়িৎচুম্বকীয় টেলিফোন আবিষ্কারের আগে দূরবর্তী কোনো স্থানে কোনো বক্তব্য এবং সংগীত প্রেরণের জন্য যান্ত্রিক শব্দবৈজ্ঞানিক যন্ত্র ব্যবহার করা হতো। পাইপ বা অন্যান্য প্রাকৃতিক মাধ্যমে শব্দ প্রেরণের উপরে ভিত্তি করেই প্রথম দিকের যান্ত্রিক টেলিফোন গুলি ব্যবহার করা হতো।

টিন ক্যানের টেলিফোন, বা “প্রেমীদের ফোন”, বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিল। এটিতে টান টান করে বাধা তন্তু বা তারের সাথে দুটি পাতলা পরদা সংযুক্ত করা হয়, যা তার বরাবর যান্ত্রিক কম্পনের মাধ্যমে শব্দ প্রেরণ করে (কোনও বৈদ্যুতিক প্রবাহের মাধ্যমে নয়)।

সর্বোত্তম উদাহরণটি হল দুটি কাগজের কাপ, ধাতব ক্যান বা প্লাস্টিকের বোতলগুলি টান করা তারের সাথে সংযুক্ত করে তৈরি করা বাচ্চাদের খেলনা। ব্রিটিশ পদার্থবিদ রবার্ট হুক ১৬৬৪ থেকে ১৬৮৫ সাল পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে কিছু পরীক্ষামূলক গবেষণা চালিয়েছিলেন। ১৬৬৭ সালে তিনি একটি অ্যাকোস্টিক স্ট্রিং ফোন তৈরি করেছিলেন।

বৈদ্যুতিক যন্ত্রাদি

বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ তৈরি এবং ক্রমাগত উন্নতির মাধ্যমে টেলিফোন উদ্ভূত হয়েছিল। ১৮০৪ সালে স্প্যানিশ বহুবিদ্যাবিশারদ এবং বিজ্ঞানী ফ্রান্সিসকো সালভা ক্যাম্পিলো একটি তড়িৎরাসায়নিক টেলিগ্রাফ তৈরি করেছিলেন।

১৮১৬ সালে ইংরেজ বিজ্ঞানী ফ্রান্সিস রোনাল্ডস স্থির বিদ্যুৎ ব্যবহার করে প্রথম কার্যকরী টেলিগ্রাফ তৈরি করেছিলেন। ১৮৩২ সালে ব্যারন শিলিং একটি তড়িৎ চৌম্বকীয় টেলিগ্রাফ তৈরি করেছিলেন। কার্ল ফ্রিডরিশ গাউস এবং উইলহেম ওয়েবার ১৮৩৩ সালে গ্যাটিনজেনে আরও একটি তড়িৎ চৌম্বকীয় টেলিগ্রাফ তৈরি করেছিলেন।

স্যার উইলিয়াম ফাদারগিল কুক প্রথমবার বৈদ্যুতিক টেলিগ্রাফ বাণিজ্যিকীকরণ করেছিলেন এবং ইংল্যান্ডের গ্রেট ওয়েস্টার্ন রেলওয়েতে ব্যবহার শুরু হয়েছিল। এটি ১৩ মা (২১ কিমি) দূরে প্যাডিংটন স্টেশন থেকে পশ্চিম ড্রাটন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং ১৮৩৯ সালের ৯ এপ্রিল কার্যকর হয়েছিল।

প্রথম সফল সংযোগ

১৮৭৬ সালের ১০ মার্চ, বেল তার সহকারী থমাস ওয়াটসনকে প্রথম কার্যকর টেলিফোন কল করেন। তিনি বলেছিলেন:
“Mr. Watson, come here, I want to see you.”

ওয়াটসন তখন অন্য ঘরে ছিলেন এবং স্পষ্টভাবে বেলের কণ্ঠ শুনতে পান। এটি ছিল ইতিহাসের প্রথম কণ্ঠস্বর-ভিত্তিক দূরসংযোগ।

প্রযুক্তির মূলনীতি

টেলিফোন মূলত তিনটি প্রধান উপাদান নিয়ে গঠিত—

ট্রান্সমিটার: কণ্ঠস্বরকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে।

রিসিভার: বৈদ্যুতিক সংকেতকে আবার শব্দে রূপান্তর করে।

সংযোগ মাধ্যম: প্রথমদিকে এটি ছিল তামার তার, পরে অপটিক্যাল ফাইবার ও বেতার প্রযুক্তি।

যখন কেউ ট্রান্সমিটারে কথা বলে, শব্দতরঙ্গ একটি পাতলা ঝিল্লি (ডায়াফ্রাম) কাঁপায়। এই কম্পন বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তরিত হয় এবং তারের মাধ্যমে রিসিভারে পৌঁছায়, যেখানে আবার ডায়াফ্রাম সেটি শব্দে ফিরিয়ে আনে।

প্রসার ও উন্নয়ন

টেলিফোন আবিষ্কারের পর বেল টেলিফোন কোম্পানি (পরে AT&T) ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রথমদিকে টেলিফোন কেবল ব্যবসায়ী ও ধনী ব্যক্তিদের জন্য সীমিত ছিল। তবে ১৯শ শতাব্দীর শেষের দিকে শহর ও গ্রামে টেলিফোন লাইন বসানো শুরু হয়।

১৯০০ সালের পর স্বয়ংক্রিয় এক্সচেঞ্জ প্রযুক্তি চালু হয়, যা অপারেটর ছাড়াই কল সংযোগ সম্ভব করে। পরবর্তীতে ২০শ শতাব্দীতে ডায়াল ফোন, পুশ-বাটন ফোন, বেতার ফোন এবং অবশেষে মোবাইল ফোন প্রযুক্তি আসে।

বিতর্ক ও স্বীকৃতি

যদিও গ্রাহাম বেলকে টেলিফোনের প্রধান আবিষ্কারক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, ইলিশা গ্রে এবং আন্তোনিও মেউচ্চি (Antonio Meucci) নামক একজন ইতালীয় উদ্ভাবকও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। মেউচ্চি ১৮৫০-এর দশকেই টেলিফোন-সদৃশ যন্ত্র বানিয়েছিলেন, তবে অর্থাভাবের কারণে তিনি পেটেন্ট পাননি। ২০০২ সালে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস মেউচ্চির অবদান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে।

প্রভাব

টেলিফোন আবিষ্কার মানব ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ বিপ্লব। এটি—

ব্যবসায়িক যোগাযোগকে দ্রুত ও কার্যকর করেছে

দূরত্ব ও সময়ের সীমাবদ্ধতা ভেঙেছে

সংবাদ ও জরুরি সেবা ব্যবস্থাকে দ্রুততর করেছে

পরবর্তীকালে ইন্টারনেট ও মোবাইল যোগাযোগের ভিত্তি তৈরি করেছে

আজকের স্মার্টফোনও মূলত টেলিফোনের ধারাবাহিক উন্নয়নের ফল, যেখানে কণ্ঠস্বর, টেক্সট, ভিডিও কল এবং ডেটা আদানপ্রদানের সুবিধা একত্রিত হয়েছে।

টেলিফোন আবিষ্কার ছিল মানব যোগাযোগে এক অমুল্য অর্জন, যা দূরত্ব ও সময়ের বাধা ভেঙে মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এসেছে। আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেল ও অন্যান্য উদ্ভাবকদের মেধা ও পরিশ্রমের ফলেই সম্ভব হয়েছে শব্দকে বৈদ্যুতিক সংকেতে রূপান্তর করে তা দূরে পৌঁছানোর যন্ত্রের উদ্ভব।

টেলিফোন শুধু তখনকার সামাজিক ও ব্যবসায়িক যোগাযোগকে সহজতর করেনি, বরং পরবর্তীকালে মোবাইল ফোন ও ইন্টারনেট প্রযুক্তির ভিত্তি স্থাপন করেছে। আজকের ডিজিটাল যুগে স্মার্টফোনের মাধ্যমে আমরা যেমন মুহূর্তেই বিশ্বের যেকোন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি, তার পেছনে রয়েছে টেলিফোন আবিষ্কারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব।

তাই এটি শুধু একটি যন্ত্র নয়, বরং মানব সভ্যতার এক বিশাল উন্নয়নের প্রতীক। ভবিষ্যতেও টেলিফোনের এই ধারাবাহিক উন্নয়ন যোগাযোগের নতুন নতুন দ্বার খুলে দেবে বলে আশা করা যায়।

তথ্যসূত্র:

Bellis, Mary. “The Invention of the Telephone.” ThoughtCo, 2020.

Fischer, Claude S. America Calling: A Social History of the Telephone to 1940. University of California Press, 1992.

Kieve, Jeffrey L. The Electric Telegraph: A Social and Economic History. David & Charles, 1973.

Bell Telephone Company Archives.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments