মুদ্রণযন্ত্র: জ্ঞান বিস্তারের এক বিপ্লবী আবিষ্কার
মানব সভ্যতার ইতিহাসে এমন কিছু আবিষ্কার রয়েছে যা জ্ঞানের বিস্তার ও মানব চিন্তার বিকাশে যুগান্তকারী প্রভাব ফেলেছে। মুদ্রণযন্ত্র (Printing Press) সেই তালিকার অন্যতম শীর্ষে। এটি শুধু বই ছাপানোর প্রযুক্তি নয়—বরং তথ্যকে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এক বিপ্লবী মাধ্যম, যা শিক্ষা, সংস্কৃতি, রাজনীতি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতিকে অভূতপূর্ব গতি দিয়েছে।
মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কার করেন জার্মান উদ্ভাবক জোহানেস গুটেনবার্গ। ১৪০০ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে তিনি এই যন্ত্র তৈরি করেন, যা ইউরোপে মুদ্রণ বিপ্লব ঘটিয়েছিল। গুটেনবার্গের আগে পূর্ব এশিয়াতে মুদ্রণযন্ত্রের ব্যবহার থাকলেও, তার তৈরি করা যন্ত্রটি ছিল অনেক বেশি কার্যকর এবং দ্রুত কাজ করতে পারত। এই যন্ত্রের মাধ্যমে অল্প সময়ে এবং কম খরচে অনেক বেশি সংখ্যায় বই মুদ্রণ করা সম্ভব হয়েছিল, যা জ্ঞানচর্চা এবং শিক্ষাব্যবস্থায় ব্যাপক পরিবর্তন আনে।
প্রাচীন যুগের প্রাথমিক মুদ্রণ প্রচেষ্টা
মুদ্রণ প্রযুক্তির সূচনা হয়েছিল হাতে তৈরি কপি থেকে। প্রাচীন মিশর, চীন, ভারত বা রোমে লেখা সংরক্ষণ হতো হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি আকারে।
চীনে কাঠের ব্লক প্রিন্টিং: খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে চীনারা কাঠের ব্লকের সাহায্যে প্রথম মুদ্রণ কাজ শুরু করে। একটি কাঠের তক্তায় উল্টোদিকে লেখা বা ছবি খোদাই করে, তারপর কালি লাগিয়ে কাগজে চাপ দিয়ে লেখা ছাপানো হতো।
প্রথম মুদ্রিত বই: চীনের Diamond Sutra (৮৬৮ খ্রিস্টাব্দ) বিশ্বের প্রাচীনতম তারিখ-সংবলিত মুদ্রিত বই হিসেবে পরিচিত।
মুভেবল টাইপ প্রযুক্তি: একাদশ শতকে চীনের বিয় শেং (Bi Sheng) মাটির তৈরি পৃথক অক্ষর দিয়ে মুভেবল টাইপ প্রিন্টিং আবিষ্কার করেন, যা পরবর্তীতে ধাতব অক্ষরে উন্নত হয় কোরিয়া ও জাপানে।
ইউরোপে মুদ্রণ বিপ্লব: গুটেনবার্গের আবিষ্কার
ইউরোপে মুদ্রণযন্ত্রের বিপ্লব আসে ১৫শ শতকে জার্মানির মাইঞ্জ শহরের স্বর্ণকার ইয়োহানেস গুটেনবার্গ (Johannes Gutenberg)-এর মাধ্যমে।
আবিষ্কারের সময়কাল: আনুমানিক ১৪৪০ সালের দিকে তিনি ধাতব মুভেবল টাইপ প্রযুক্তি, কালি এবং ছাপার প্রেসের সমন্বয়ে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র তৈরি করেন।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
ধাতব মুভেবল টাইপ – অক্ষরগুলি পৃথকভাবে ঢালাই করে অসংখ্যবার ব্যবহার করা যেত।
তেলভিত্তিক কালি – কাগজে ভালোভাবে আঁটত এবং টেকসই হতো।
প্রেস মেকানিজম – আঙুর চেপে ধরা প্রেসের মতো কাঠের প্রেস ব্যবহার করে সমানভাবে চাপ প্রয়োগ।
গুটেনবার্গ বাইবেল: ১৪৫৫ সালে প্রকাশিত Gutenberg Bible ছিল ইউরোপের প্রথম বৃহৎ আকারে মুদ্রিত বই, যা গুণমান ও সৌন্দর্যে হাতে লেখা পাণ্ডুলিপির সমকক্ষ ছিল।
জ্ঞান ও শিক্ষার বিস্তার
মুদ্রণযন্ত্রের আগে বই ছিল দুর্লভ ও ব্যয়বহুল, কেবল ধনী ও শিক্ষিত সমাজেই সীমাবদ্ধ। গুটেনবার্গের প্রযুক্তি বইয়ের দাম কমিয়ে সাধারণ মানুষের নাগালে নিয়ে আসে। ইউরোপজুড়ে গ্রন্থাগার, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বইয়ের প্রাচুর্য ঘটে।
ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন
ষোড়শ শতকে মার্টিন লুথারের ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন (Reformation) মুদ্রণযন্ত্র ছাড়া এত দ্রুত ছড়িয়ে পড়ত না। তাঁর লেখা পুস্তিকা, বাইবেলের অনুবাদ এবং ধর্মীয় বিতর্ক কয়েক সপ্তাহে ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে।
বিজ্ঞান ও আবিষ্কারের প্রসার
গ্যালিলিও, কপারনিকাস, নিউটনের মতো বিজ্ঞানীদের গবেষণা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা বৈজ্ঞানিক বিপ্লবকে ত্বরান্বিত করে।
ভাষা ও সাহিত্য বিকাশ
বইয়ের বহুল প্রচারের ফলে স্থানীয় ভাষায় লেখালিখি বাড়ে। দান্তে, শেক্সপিয়র বা সেরভান্তেসের মতো লেখকদের রচনা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
রাজনৈতিক সচেতনতা
সংবাদপত্রের উদ্ভব ও রাজনৈতিক পুস্তিকা মুদ্রণের মাধ্যমে সাধারণ জনগণ নতুন রাজনৈতিক ধারণার সাথে পরিচিত হয়, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পথে সহায়ক হয়।
প্রযুক্তির বিবর্তন
১৫০০ সালের মধ্যে ইউরোপের প্রায় ২৫০টি শহরে মুদ্রণযন্ত্র চালু হয়েছিল, এবং প্রায় ২০ মিলিয়ন বই ছাপা হয়েছিল।
১৭শ শতকে মুদ্রণযন্ত্র উন্নত হয়ে দ্রুতগতিতে ছাপার সক্ষমতা অর্জন করে।
১৯শ শতকে স্টিম চালিত প্রেস ও লিথোগ্রাফি প্রযুক্তি মুদ্রণকে শিল্প বিপ্লবের অংশে পরিণত করে।
২০শ শতকে অফসেট প্রিন্টিং ও ডিজিটাল প্রিন্টিং নতুন যুগের সূচনা করে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুদ্রণযন্ত্র
বাংলাদেশে মুদ্রণ প্রযুক্তির ইতিহাস ঔপনিবেশিক যুগে শুরু হয়।
প্রথম ছাপাখানা: ১৭৭৭ সালে বাংলায় প্রথম ছাপাখানা স্থাপন হয়েছিল।
বাংলা মুদ্রণযন্ত্র: মুদ্রণযন্ত্রের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় বই, সংবাদপত্র ও পুস্তিকা ছাপা শুরু হয়, যা সাহিত্য ও জাতীয় চেতনা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
বড় প্রভাব: ‘সমাচার দর্পণ’, ‘সংবাদ প্রভাকর’ ইত্যাদি সংবাদপত্র এবং বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন বইগুলি ছাপাখানার সৌজন্যে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
মুদ্রণযন্ত্র মানব ইতিহাসের এক বিপ্লবী প্রযুক্তি, যা জ্ঞানকে অভিজাত শ্রেণির গণ্ডি থেকে বের করে এনে গণমানুষের হাতে তুলে দিয়েছে। এটি কেবল বই ছাপার মাধ্যম নয়, বরং এক সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের হাতিয়ার। গুটেনবার্গের আবিষ্কার মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের অন্যতম প্রধান সোপান।
তথ্যসূত্র:
Eisenstein, Elizabeth L. The Printing Press as an Agent of Change. Cambridge University Press, 1979.
Febvre, Lucien, and Martin, Henri-Jean. The Coming of the Book: The Impact of Printing, 1450–1800. Verso, 1997.
Man, John. Gutenberg: How One Man Remade the World with Words. Wiley, 2002.
Tsien, Tsuen-Hsuin. Paper and Printing. Science and Civilisation in China.