উড়োজাহাজ আবিষ্কার: আকাশ জয়ের সূচনা
মানুষের আকাশে ওড়া ছিল এক সময় শুধুই কল্পনা ও স্বপ্ন। প্রাচীন যুগে ডেডালাস ও ইকারাসের গ্রিক পুরাণ থেকে শুরু করে লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা উড়ন্ত যন্ত্রের নকশা – সব কিছুই মানুষকে আকাশে উড়ার আকাঙ্ক্ষা বোঝায়। তবে এই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় উনবিংশ শতকের শেষভাগ ও বিংশ শতাব্দীর শুরুতে, যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে উড়োজাহাজ আবিষ্কার সম্ভব হয়।
প্রাচীন ধারণা ও প্রাথমিক প্রচেষ্টা
উড়ন্ত যন্ত্র নির্মাণের প্রথম চেষ্টাগুলো ছিল অনেকটাই পরীক্ষামূলক ও অনির্ভরযোগ্য। চীনে খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতকে ঘুড়ি ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়। মধ্যযুগে মুসলিম বিজ্ঞানী আব্বাস ইবনে ফিরনাস স্পেনের কর্ডোবায় ৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে এক ধরনের উড়ন্ত যন্ত্রে আকাশে ওড়ার চেষ্টা করেছিলেন বলে জানা যায়। যদিও তিনি সফলভাবে কিছু সময় আকাশে থাকলেও অবতরণে ব্যর্থ হন এবং আঘাত পান।
আকাশে উড্ডয়ন সূত্র
এর উর্দ্ধগতি এর ডানার সম্মুখগতির কারণে। এই ধরনের আকাশযানের উর্দ্ধগতি ঘূর্ণায়মান ডানা সংবলিত আকাশযানের মত ডানায় বা উপরে অবস্থিত পাখার ঘূর্ণনের কারণে সৃষ্ট হয় না যেমনটি হেলিকপ্টারে হয়।
যদিও রকেট বা মিসাইল আকাশে উড়ে তথাপি তাদের উড়োজাহাজ বলা হয়না কারণ এগুলো ডানার সম্মুখগতি ব্যবহার না করে রকেট থার্স্ট এর সাহায্যে উর্দ্ধগতি অর্জন করে। অনেক উড়োজাহাজ প্রপেলার বা জেট ইঞ্জিন দ্বারা সৃষ্ট ঘাতের প্রভাবে সম্মুখে চালিত হয়।
লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ও উড়ন্ত যন্ত্রের নকশা
১৪৫২ সালে জন্ম নেওয়া ইতালীয় প্রতিভা লিওনার্দো দা ভিঞ্চি উড়ন্ত যন্ত্রের আধুনিক ধারণার পথপ্রদর্শক ছিলেন। তার “অর্ণিথপটার” (ornithopter) নামক যন্ত্রটি পাখির ডানার অনুকরণে ডিজাইন করা হয়েছিল। যদিও তার কোনো যন্ত্রই নির্মিত হয়নি তার জীবদ্দশায়, তবে তার নকশাগুলো ভবিষ্যতের বিমান প্রকৌশলের ভিত্তি গড়ে দেয়।
উড়ন্ত বেলুন ও গ্লাইডার
১৭৮৩ সালে ফরাসি মন্টগলফিয়ার ভ্রাতৃদ্বয় প্রথম সফলভাবে গরম বায়ু চালিত বেলুনে মানুষকে আকাশে ওড়ান। এটি ছিল মানুষের প্রথম মানবচালিত উড্ডয়ন। এর পরপরই জার্মান প্রকৌশলী ওটো লিলিয়েনথাল ১৮৯০-এর দশকে সফলভাবে গ্লাইডার চালান।
তিনি প্রায় ২০০০ বারের বেশি গ্লাইডিং করেন এবং উড্ডয়ন বিজ্ঞানে তথ্যভিত্তিক গবেষণা চালান। তবে এক দুর্ঘটনায় ১৮৯৬ সালে তার মৃত্যু হয়।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সাফল্য: আধুনিক উড়োজাহাজের জন্ম
আধুনিক উড়োজাহাজের আবিষ্কারক হিসেবে সবচেয়ে বেশি স্বীকৃতি পান আমেরিকান দুই ভাই – ওরভিল ও উইলবার রাইট। তারা ছিলেন বাইসাইকেল মেরামতের কারিগর এবং পরবর্তীতে মহাকাশবিজ্ঞানের অগ্রদূত।
বহু বছরের গবেষণা ও পরীক্ষার পর তারা ১৯০৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর উত্তর ক্যারোলিনার কিটি হক এলাকায় ইতিহাস গড়ে তোলেন। তাদের নির্মিত “রাইট ফ্লায়ার” নামক বিমানটি ১২০ ফুট দূরত্বে ১২ সেকেন্ড ধরে ওড়ে – এটি ছিল ইতিহাসে প্রথম নিয়ন্ত্রিত, ইঞ্জিনচালিত, মানবচালিত ওড়ার ঘটনা।
রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের সাফল্যের পেছনে ছিল ওটো লিলিয়েনথালের গবেষণার প্রভাব, তাদের নিজস্ব ডিজাইন করা হালকা ইঞ্জিন, প্রপেলার এবং ফ্লাইট কন্ট্রোল পদ্ধতি। তারা শুধু যন্ত্র তৈরি করেই থেমে যাননি, বরং নিয়মিত অনুশীলন ও উন্নয়নের মাধ্যমে ১৯০৫ সালে রাইট ফ্লায়ার III তৈরি করেন, যা কয়েক মিনিট ধরে আকাশে থাকতে সক্ষম ছিল।
উড়োজাহাজের দ্রুত উন্নতি
রাইট ভাইদের সাফল্যের পরে বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজ উন্নয়নে এক বিপ্লব ঘটে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪–১৯১৮) এই প্রযুক্তিকে সামরিক প্রয়োজনে ব্যাপকভাবে ব্যবহারের সুযোগ দেয়। তখন যুদ্ধবিমান, নজরদারি বিমান এবং বোমারু বিমানের উৎপাদন শুরু হয়।
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন খাত গড়ে ওঠে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ বিমান “অলকক ও ব্রাউন” আটলান্টিক মহাসাগর পার হয়। পরে ১৯২৭ সালে চার্লস লিন্ডবার্গ নামক মার্কিন পাইলট একাই নিরবিচারে নিউইয়র্ক থেকে প্যারিস পর্যন্ত ৩৩ ঘণ্টার ফ্লাইটে যান – এটি ছিল আকাশপথে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও জেট প্রযুক্তির সূচনা
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে উড়োজাহাজ প্রযুক্তিতে ব্যাপক উন্নতি হয়। এই সময়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন যুদ্ধবিমান, রাডার প্রযুক্তি এবং উড়ন্ত দূরত্ব বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নবতর উদ্ভাবন দেখা দেয়। ১৯৩৯ সালে জার্মানিতে প্রথম জেট ইঞ্জিনচালিত বিমান “Heinkel He 178” আকাশে ওড়ে। যুদ্ধ শেষে যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন এই প্রযুক্তিকে বেসামরিক বিমানে রূপ দিতে শুরু করে।
আধুনিক যাত্রীবাহী বিমান ও আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী দশকে বাণিজ্যিক বিমান পরিবহন দ্রুত প্রসার লাভ করে। ১৯৫২ সালে “de Havilland Comet” ছিল বিশ্বের প্রথম জেটচালিত যাত্রীবাহী বিমান। এরপর “Boeing 707” ও “Douglas DC-8” এর মত বিমান বিশ্বজুড়ে বিমানযাত্রাকে সহজ, দ্রুত ও আরামদায়ক করে তোলে।
বর্তমানে বোয়িং (Boeing), এয়ারবাস (Airbus), এমব্রেয়ার (Embraer) ইত্যাদি সংস্থাগুলো বড় আকারের, অধিক গতিসম্পন্ন, কম জ্বালানির খরচে অধিক যাত্রী পরিবহন সক্ষম বিমান তৈরি করছে। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ প্রতিদিন বিমানযাত্রা করে থাকে, যা এই প্রযুক্তির শক্তি ও গ্লোবাল কানেক্টিভিটির নিদর্শন।
সাম্প্রতিক ও ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি
বর্তমানে বৈদ্যুতিক উড়োজাহাজ, স্বচালিত ড্রোন, হাইপারসনিক জেট ও পরিবেশবান্ধব গ্রীন এভিয়েশন প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণা চলছে। এর পাশাপাশি মহাকাশ পর্যটন ও সাব-অরবিটাল ফ্লাইটও ভবিষ্যতের একটি নতুন অধ্যায় হতে যাচ্ছে।
উড়োজাহাজ প্রযুক্তির এই শত বছরের যাত্রা শুরু হয়েছিল রাইট ভাইদের ছোট্ট একটি ফ্লাইট দিয়ে, আর আজ তা ছুঁয়েছে মহাকাশের দ্বারপ্রান্ত।
উড়োজাহাজ আবিষ্কার শুধু প্রযুক্তির এক অর্জন নয়, এটি মানুষের কল্পনাশক্তি, সাহস ও অধ্যবসায়ের প্রতীক। এক সময় আকাশপথে ওড়া ছিল শুধুই পাখির কিংবা কল্পনার বিষয়, আজ তা বাস্তব এবং দৈনন্দিন জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। উড়োজাহাজ মানুষের সীমাহীন সম্ভাবনার একটি দৃষ্টান্ত, যা আমাদের শেখায় — স্বপ্ন, চেষ্টা আর বিজ্ঞান মিললে অসম্ভব কিছুই নয়।
তথ্যসূত্র:
Smithsonian National Air and Space Museum
Wright Brothers Aeroplane Company
Britannica Encyclopedia
NASA Aeronautics Research