রেডিও আবিষ্কার: যোগাযোগ বিপ্লবের সূচনা
রেডিও হল এমন এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার যা মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক আমূল পরিবর্তন এনেছে। আজ আমরা যেসব প্রযুক্তির ওপর নির্ভর করি – মোবাইল ফোন, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এমনকি স্যাটেলাইট যোগাযোগ – সেগুলোর ভিত্তি গড়ে দিয়েছে রেডিও প্রযুক্তি। এই আবিষ্কারের ইতিহাস যেমন বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনে ভরপুর, তেমনি রয়েছে একাধিক বিজ্ঞানীর অবদান ও বিতর্ক।
রেডিওর তাত্ত্বিক ভিত্তি
রেডিও প্রযুক্তির ভিত্তি গড়ে ওঠে ১৯ শতকের শেষভাগে। ১৮৬৪ সালে স্কটিশ পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল তার বিখ্যাত ‘ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক থিওরি’-তে প্রমাণ করেন যে, বিদ্যুৎ এবং চৌম্বকত্ব একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং এই মিলিত শক্তি এক ধরনের তরঙ্গ তৈরি করে যা শূন্যের মধ্যে দিয়ে চলতে পারে।
বেতার প্রযুক্তি বলতে মূলত তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের মাধ্যমে তথ্যের আদানপ্রদানকে বোঝায় যেখানে তথ্য আদান এবং প্রদানের দুই বা ততোধিক স্থান কোনো তড়িৎ পরিবাহী দ্বারা সংযুক্ত থাকবে না।
এক্ষেত্রে সচরাচর বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করা হয়ে থাকে। বেতার তরঙ্গ এক ধরনের তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ যার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ১ মিলিমিটার থেকে ১০ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর এর কম্পাংক ৩০০ গিগাহার্টজ থেকে ৩০ হার্টজ পযন্ত হতে পারে।
এর প্রায় ২০ বছর পর, ১৮৮৭ সালে, জার্মান পদার্থবিদ হাইনরিখ হার্জ এই তত্ত্বকে পরীক্ষার মাধ্যমে বাস্তবে প্রমাণ করেন। তিনি তৈরি করেছিলেন এমন একটি যন্ত্র যার মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ পাঠাতে ও গ্রহণ করতে সক্ষম হন। তার সম্মানেই আজ “হার্জ” (Hz) শব্দটি ফ্রিকোয়েন্সি পরিমাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
আবিষ্কারের প্রতিযোগিতা
রেডিওর আবিষ্কারে অনেকেই অবদান রেখেছেন। তবে একে কার্যকর যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে মূল অবদান রাখেন গুগলিয়েলমো মার্কোনি, নিকোলা টেসলা, অলিভার লজ, ও আলেকজান্ডার পপভ।
গুগলিয়েলমো মার্কোনি
ইতালির উদ্ভাবক মার্কোনি-কে বহুজন “রেডিওর জনক” বলে অভিহিত করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে বেতার সংকেত পাঠাতে সফল হন এবং ১৮৯৬ সালে ব্রিটেনে তার বেতার টেলিগ্রাফির জন্য পেটেন্ট পান।
১৯০১ সালে তিনি আটলান্টিক মহাসাগরের ওপার থেকে সংকেত পাঠিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেন। তার এই অর্জন প্রমাণ করে যে, ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক তরঙ্গ বিশাল দূরত্বে তথ্য বহন করতে পারে। ১৯০৯ সালে মার্কোনি এই আবিষ্কারের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।
নিকোলা টেসলা
অন্যদিকে, মার্কিন প্রকৌশলী নিকোলা টেসলার কাজকেও রেডিও আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। ১৮৯৩ সালেই তিনি রেডিওর ধারণা ও প্রোটোটাইপ প্রদর্শন করেন। ১৯৪৩ সালে, মার্কিন সর্বোচ্চ আদালত টেসলার পেটেন্টকেই বৈধ ঘোষণা করে – যা তাকে আইনি দৃষ্টিতে রেডিওর প্রকৃত আবিষ্কর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
আলেকজান্ডার পপভ ও অলিভার লজ
রাশিয়ার আলেকজান্ডার পপভ ১৮৯৫ সালে একটি রেডিও রিসিভার তৈরি করেন, এবং ইংল্যান্ডের অলিভার লজ রেডিও সংকেত পাঠানোর বিভিন্ন পরীক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। যদিও তাদের প্রচেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ, তবুও বিশ্বজুড়ে রেডিও প্রযুক্তিকে জনপ্রিয় করে তোলার ক্ষেত্রে মার্কোনির কৃতিত্বই বেশি আলোচিত হয়।
রেডিওর ব্যবহারিক বিকাশ
রেডিও প্রথম দিকে সামরিক ও জাহাজ চলাচলে যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হতো। ১৯১২ সালের টাইটানিক দুর্ঘটনার পর, বেতার যোগাযোগ বাধ্যতামূলক করা হয় নৌযানে।
পরে ১৯২০-এর দশকে রেডিও সাধারণ মানুষের জন্য বিনোদন ও সংবাদ মাধ্যম হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। প্রথম বাণিজ্যিক রেডিও সম্প্রচার হয় ১৯২০ সালের ২রা নভেম্বর, KDKA স্টেশন থেকে, পিটসবার্গ, আমেরিকায়। এরপর থেকে দ্রুতই বিশ্বজুড়ে রেডিও স্টেশন ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) প্রথম রেডিও সম্প্রচার শুরু হয় কলকাতা কেন্দ্র থেকে ১৯২৭ সালে। পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া রেডিওর উপকেন্দ্র স্থাপিত হয়।
রেডিওর প্রযুক্তিগত অগ্রগতি
রেডিওর প্রাথমিক প্রযুক্তি ছিল AM (Amplitude Modulation) ভিত্তিক। ১৯৩০-এর দশকে FM (Frequency Modulation) প্রযুক্তি চালু হয় যা শব্দের গুণমান অনেক উন্নত করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় রেডিও ছিল যুদ্ধ পরিচালনা, প্রচার এবং জনমত গঠনের এক শক্তিশালী মাধ্যম। যুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এটি আরও বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক মাধ্যম হিসেবে গড়ে ওঠে।
১৯৫০-এর দশকে টেলিভিশন এসে রেডিওর জনপ্রিয়তা কিছুটা হ্রাস করে, তবে গাড়ি, গ্রামে ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে রেডিও আজও একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে রয়ে গেছে।
আধুনিক রেডিও
বর্তমানে রেডিও শুধু বেতার তরঙ্গে সীমাবদ্ধ নয়। ইন্টারনেট রেডিও, পডকাস্ট, এবং স্যাটেলাইট রেডিও প্রযুক্তির মাধ্যমে এটি আরও উন্নত ও ব্যাপক হয়েছে।
রেডিও প্রযুক্তির ওপর ভিত্তি করেই আজ মোবাইল ফোন, ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ, জিপিএস ইত্যাদি কাজ করে – যা আমাদের আধুনিক জীবনকে আরও গতিশীল করে তুলেছে।
রেডিও শুধুমাত্র একটুখানি যন্ত্র নয় – এটি বিজ্ঞানের এক চমৎকার প্রয়োগ যা বিশ্বকে কাছাকাছি এনেছে। তথ্য ও বিনোদনের সহজ মাধ্যম হিসেবে রেডিও এখনও অনেকের জীবনের অঙ্গ।
জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল-এর তাত্ত্বিক চিন্তা, হার্জ-এর পরীক্ষামূলক প্রমাণ, টেসলা ও মার্কোনির প্রযুক্তিগত প্রয়োগ—সব মিলিয়ে রেডিও ইতিহাসে এক যুগান্তকারী উদ্ভাবন হয়ে আছে।
তথ্যসূত্র:
Encyclopaedia Britannica
IEEE Global History Network
“Tesla vs. Marconi: The Battle of Radio Patents”, Smithsonian Magazine
Bangladesh Betar official history page