ইনকা সভ্যতা
ইনকা সভ্যতা ছিল প্রাচীন দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ ও সুসংগঠিত সাম্রাজ্য। এটি গড়ে উঠেছিল আন্দিজ পর্বতমালার বিস্তৃত অঞ্চলে, যার কেন্দ্র ছিল বর্তমান পেরু। আনুমানিক ১৩শ শতকের মাঝামাঝি সময়ে ইনকারা তাদের শক্তির উত্থান ঘটায় এবং ১৬শ শতকের শুরুতে স্প্যানিশ বিজয়ের আগপর্যন্ত তারা একটি বিশাল অঞ্চল শাসন করে। ইনকা সভ্যতা তাদের উন্নত প্রশাসন,কৃষি,স্থাপত্য,ধর্মীয় বিশ্বাস ও পথব্যবস্থার জন্য আজও বিস্ময়ের বিষয়।
অবস্থান ও বিস্তার
ইনকা সাম্রাজ্য মূলত বর্তমান পেরুতে গড়ে উঠলেও তাদের ক্ষমতা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হয় আধুনিক ইকুয়েডর, বলিভিয়া, চিলি, আর্জেন্টিনা ও কলম্বিয়ার কিছু অংশ পর্যন্ত। তাদের সাম্রাজ্যকে “তাওয়ান্তিনসুয়ু” বলা হত, যার অর্থ “চার কোণের জমি”। রাজধানী কুজকো (Cusco) ছিল ইনকা সভ্যতার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র।
প্রশাসন ও সংগঠন
ইনকা শাসনব্যবস্থা ছিল এককেন্দ্রিক ও অত্যন্ত সুসংগঠিত। সর্বোচ্চ নেতা ছিলেন “সাপা ইনকা”, যিনি নিজেকে সূর্য দেবতা ইন্তি-র সন্তান বলে দাবি করতেন। ইনকা প্রশাসন একটি স্তরভিত্তিক কাঠামো অনুসরণ করত, যেখানে স্থানীয় শাসকদের অধীনে জনগণ কাজ করত। কর আদায়, জনশুমারি ও কৃষিভিত্তিক উৎপাদনের হিসাব রাখার জন্য তারা ব্যবহার করত একটি বিশেষ গিঁটযুক্ত দড়ির পদ্ধতি, যাকে বলা হয় কুইপু (Quipu)।
কৃষি ও প্রযুক্তি
ইনকাদের সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক ছিল তাদের কৃষি ব্যবস্থাপনা। খাড়া পাহাড়ি অঞ্চলে তারা “টেরেস ফার্মিং” বা স্তরিত চাষ পদ্ধতি ব্যবহার করে চাষাবাদ করত। এর মাধ্যমে তারা পানি সংরক্ষণ ও মাটির ক্ষয়রোধ করতে পারত। তারা মাটি ও জল নিয়ন্ত্রণে উন্নত কৌশল ব্যবহার করত, যার মধ্যে ছিল সেচব্যবস্থা, ক্যানাল এবং সংরক্ষণাধার। প্রধান ফসল ছিল আলু, ভুট্টা, ক্যাসাভা ও কুইনোয়া।
ইনকাদের খাদ্যাভ্যাস ও অর্থনীতি
ইনকাদের আদিপুরুষরা শিকারী ছিল। পরে এরা ধীরে ধীরে কৃষিজীবী হয়ে পড়ে। এদের প্রধান খাদ্য ছিল ভুট্টা ও আলু। এরা ভূট্টা থেকে এক ধরনের পানীয় তৈরি করে খেত। এই পানীয়ের নাম ছিল চিচা। পেরুতে এটি এখনো জনপ্রিয়। এছাড়া ওল, নীল শ্যাওলা, কাঁচা মরিচ খেতো। মাংসের মধ্যে ছিল গিনিপিগ ও ছাগল জাতীয় লামার মাংস।
সাগরের নিকটবর্তী এলাকার মানুষ সামুদ্রিক মাছ খেতো। ইনকাদের বড় সাফল্য ছিল খাদ্য সঞ্চয়ে। সমগ্র সাম্রাজ্য জুড়ে অসংখ্য সরকারি খাদ্যভাণ্ডার ছিল। এছাড়া সাধারণ মানুষকে খাদ্য সঞ্চয়ে উদ্বুদ্ধ করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় এদের প্রায় ৫-৭ বছরের খাদ্য মজুদের ব্যবস্থা সৃষ্টি হয়েছিল। শস্য ছাড়াও তারা মাংস শুকিয়ে নোনা করে রাখতো।
স্থাপত্য ও প্রকৌশল
ইনকা স্থাপত্য ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে একীভূত, শক্তিশালী ও ভূমিকম্প প্রতিরোধী। পাথর কাটার নিখুঁত কারিগরির মাধ্যমে তারা পাথরগুলিকে কোনো মর্টার ছাড়াই এমনভাবে বসাতো, যেন তা যুগপৎভাবে একে অপরকে আঁকড়ে ধরে থাকে। মাচু পিচু (Machu Picchu) ইনকা স্থাপত্যের একটি প্রতীক,যা একটি দুর্গ বা রাজকীয় আশ্রম হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
যোগাযোগ ও রাস্তা ব্যবস্থা
ইনকারা একটি বিস্তৃত রাস্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছিল, যা প্রায় ৪০,০০০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। এই রাস্তাগুলি সংযুক্ত করত রাজধানী কুজকোকে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সাথে। পথে ছিল চাস্কি নামক দৌড়বিদরা, যারা বার্তা ও জিনিসপত্র বহন করত। ইনকাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল মৌখিক ও “কুইপু”-নির্ভর।
ধর্ম ও বিশ্বাস
ইনকা ধর্ম ছিল বহুদেবতাবাদী। প্রধান দেবতা ছিলেন ইন্তি (সূর্য দেবতা)। ইনকারা বিশ্বাস করত প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের পেছনে এক একটি দেবতা রয়েছে, যেমন পাচামামা (পৃথিবী মা) এবং ইলাপা (বজ্রদেবতা)। তারা উৎসব ও বলিদানের মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করত। শিশু বলিদান বা কাপাকোচা (Capacocha) ছিল তাদের ধর্মীয় আচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ইনকাদের পোশাক
আলস্কা ছুঁয়ে ইনকাদের যে দল আমেরিকায় প্রবেশ করেছিল, তাদের পোশাক ছিল পশুর চামড়া। আমেরিকার গ্রীষ্মপ্রধান এলাকায় প্রবেশ করার পর এরা হালকা পোশাকের জন্য সূতিবস্ত্র তৈরি করা শেখে। পেরু অঞ্চলে প্রবেশ করার পর, এরা লামার পশম দিয়ে পোশাক বানানো আয়ত্ব করে।
অভিজাতরা পোশাকের সাথে পরতো ধাতুর প্রতীকী লকেট। মেয়েরা এক ধরনের ভারি চাদর জাতীয় পোশাক দিয়ে শরীর আবৃত করতো। একে বলা হতো ‘মানতাস’। তবে সকল পোশাকই সেলাইহীন ছিল। পুরুষরা নিম্নাঙ্গে লম্বা সুতির পোশাক পড়তো ধুতির মতো করে। তবে সকল মানুষে পায়ে চপ্পল জাতীয় উপকরণ ব্যবহার করতো। এই চপ্পল তৈরি হতো লামার চামড়া থেকে। পুরুষদের ঊর্ধাঙ্গে পোশাক ধারণ করার রীতি ছিল না। রাজা নানা ধরণের অলঙ্কার ধারণ করতো।
শিল্প ও সংস্কৃতি
ইনকা শিল্পে বস্ত্র, পাথর খোদাই,মৃৎশিল্প এবং ধাতব কাজ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তারা রঙিন কাপড় বুনন এবং উল বস্ত্র তৈরিতে পারদর্শী ছিল,বিশেষ করে লামা ও আলপাকার লোম ব্যবহার করে। তাদের পোশাক সমাজের স্তরের প্রতীক ছিল। ইনকারা গান,নৃত্য এবং ধর্মীয় নাটক পরিবেশন করত উৎসব উপলক্ষে।
ইনকাদের সমাজব্যবস্থা
ইনকারা অত্যন্ত সামাজিক ছিল। এই কারণে এরা সামাজিক রীতিনীতিকে অত্যন্ত প্রাধান্য দিত। রাজা নিজের বোনকে বিবাহ করলেও, সাধারণ ইনকাদের ভিতরে এই জাতীয় কোনো বিধি ছিল না। এরা আপন বোন ছাড়াও অন্য যে কোনো কন্যাকে বিবাহ করতে পারতো। এক্ষেত্রে ইনকা ছেলেদেরকে ২০ বৎসর বয়সের আগে কন্যা পছন্দ করতে হতো।
কোনো ছেলে কনে খুঁজে না পেলে,অভিভাবকরা কনে খুজে দিত। অনেক সময় কোনো কোনো অভিভাবক তার পুত্র সন্তানের জন্য কন্যা পছন্দ করে রাখতো। কন্যার অভিভাবকরা তাতে রাজি হলে,ওই কন্যা বাগদত্তা হিসেবে অন্য কারো সাথে বিবাহ করতে পারতো না। বিবাহের দিন বর-কনে পরস্পরের হাত ধরে চন্দন বিনিময় করতো। এরপর বিবাহ উপলক্ষে সামাজিক ভোজ হতো। কিন্তু রাজ্যের সুন্দরী মেয়েদের অনেক সময় রাজার উপপত্নী করার জন্য পাঠানো হতো। এ বিষয়ে স্থানীয় পুরোহিত এবং সেনাশাসকদের বিশেষ ভূমিকা থাকতো।
পতনের ইতিহাস
১৫৩২ সালে স্প্যানিশ বিজেতা ফ্রান্সিস্কো পিজারো ইনকা সাম্রাজ্যে প্রবেশ করেন। ইনকা সম্রাট আতাহুয়ালপা-কে বন্দি করে হত্যা করার মাধ্যমে স্প্যানিশরা ইনকা সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। অভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধ, ইউরোপীয় রোগবালাই (যেমন: গুটি বসন্ত),এবং উন্নত অস্ত্রশস্ত্রসহ স্প্যানিশ কৌশলের কারণেই ইনকাদের শক্তিশালী সাম্রাজ্য দ্রুত ভেঙে পড়ে।
ইনকা সভ্যতার উত্তরাধিকার
আজও ইনকা সভ্যতার প্রভাব আন্দিজ অঞ্চলের সংস্কৃতি, ভাষা ও কৃষি ব্যবস্থায় বিদ্যমান। কেচুয়া ভাষা, যা ইনকাদের প্রধান ভাষা ছিল, এখনও লাখ লাখ মানুষ ব্যবহার করে। তাদের বানানো রাস্তা, সেচব্যবস্থা, স্থাপত্য ও কৃষি প্রযুক্তি আধুনিক বিজ্ঞানীদেরও অনুপ্রাণিত করে।
ইনকা সভ্যতা শুধু একটি সাম্রাজ্য ছিল না, এটি ছিল এক বিস্ময়কর সাংস্কৃতিক ও প্রযুক্তিগত কীর্তি। কঠিন ভূপ্রকৃতি ও সীমিত সম্পদের মাঝেও তারা একটি সুসংগঠিত, ধর্মনির্ভর এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলেছিল। আজকের দিনে ইনকাদের জীবনধারা, ধর্মীয় আচার, কৃষি পদ্ধতি ও স্থাপত্য ঐতিহ্য গবেষকদের মুগ্ধ করে এবং মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক অনন্য উদাহরণ হয়ে রয়ে গেছে।
তথ্যসূত্র:
National Geographic
Britannica.com
UNESCO World Heritage Sites