Saturday, October 4, 2025
Homeইতিহাসমানব চন্দ্র অভিযান

মানব চন্দ্র অভিযান

মানব চন্দ্র অভিযান

চাঁদ, পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের কৌতূহল ও কল্পনার কেন্দ্রবিন্দু। কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি এক বিপ্লব ঘটেছিল — মানুষ চাঁদের দিকে শুধু তাকিয়েই থাকেনি, বরং সেখানে গিয়ে পা রেখেছে। মানব চন্দ্র অভিযান, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যাপোলো মিশন, আধুনিক বিজ্ঞানের এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। চলুন ইতিহাস, প্রযুক্তি, অর্জন এবং ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে বিস্তারিতভাবে জেনে নিই।

চন্দ্র অভিযানের সূচনা

বিশ্ব রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চন্দ্র অভিযান শুরু হয়েছিল মূলত ঠান্ডা যুদ্ধের সময়। যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে চলছিল “স্পেস রেস” — মহাকাশ জয়ের প্রতিযোগিতা।

সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথমে ১৯৫৭ সালে স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে মহাকাশে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠায় এবং ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিন ছিলেন প্রথম মহাকাশচারী। এতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যুক্তরাষ্ট্র।

এরপর ১৯৬১ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডি ঘোষণা দেন যে দশকের শেষের আগেই একজন আমেরিকানকে চাঁদে পাঠানো হবে এবং নিরাপদে ফিরিয়ে আনা হবে। এই ঘোষণার মাধ্যমেই শুরু হয় নাসা-র “অ্যাপোলো প্রোগ্রাম”।

অ্যাপোলো ১১: মানুষের প্রথম চন্দ্রপদার্পণ

১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই (বাংলাদেশ সময় ২১ জুলাই), ইতিহাস সৃষ্টি হয়। অ্যাপোলো ১১ অভিযানে নিল আর্মস্ট্রং, বাজ অ্যালড্রিন ও মাইকেল কলিন্স অংশগ্রহণ করেন। মাইকেল কলিন্স কক্ষপথে থেকে যান, আর নিল আর্মস্ট্রং ও বাজ অ্যালড্রিন “ঈগল” লুনার মডিউলে চাঁদের পৃষ্ঠে নামেন।

মোট বারোজন নভোচারী চাঁদে অবতরণ করেছেন। নাসার ছয়টি মিশনের প্রতিটিতে দুজন পাইলট-মহাকাশচারী একটি করে লুনার মডিউল উড়িয়ে এই সাফল্য অর্জন করেছেন ।

এই মিশনগুলি ৪১ মাস ধরে চলেছিল, যা ২০ জুলাই ১৯৬৯ সালে শুরু হয়েছিল, নীল আর্মস্ট্রং এবং বাজ অলড্রিন অ্যাপোলো ১১-এ এবং ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭২ সালে অ্যাপোলো ১৭- তে জিন সার্নান এবং হ্যারিসন স্মিট-এর মাধ্যমে শেষ হয়েছিল । সার্নান ছিলেন চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে অবতরণকারী শেষ মানুষ।

সমস্ত অ্যাপোলো চন্দ্র অভিযানে একজন তৃতীয় ক্রু সদস্য ছিলেন যিনি কমান্ড মডিউলে ছিলেন ।

নিল আর্মস্ট্রং প্রথম পা রাখেন এবং বিখ্যাত বাক্যটি বলেন:

“That’s one small step for [a] man, one giant leap for mankind.”

এই মুহূর্ত মানব ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিগত অর্জন হিসেবে বিবেচিত হয়।

অন্যান্য অ্যাপোলো মিশন

অ্যাপোলো ১১-এর সাফল্যের পর নাসা আরও ছয়টি মিশনে চাঁদে মানুষ পাঠায়। এর মধ্যে অ্যাপোলো ১২, ১৪, ১৫, ১৬, এবং ১৭ সফলভাবে চাঁদের মাটিতে নেমে গবেষণা করে। তবে অ্যাপোলো ১৩ কারিগরি সমস্যার কারণে চাঁদে অবতরণ না করেই ফিরে আসে।

এতে কেউ মারা যায়নি, কিন্তু এটিকে “successful failure” বলা হয় কারণ এটি সফলভাবে সব মহাকাশচারীকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছিল।

এই মিশনগুলো চাঁদের ভূগোল, উপাদান, তেজস্ক্রিয়তা, ভূমিকম্প (Moonquake) প্রভৃতি বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে যা আজও বিজ্ঞানীদের কাজে লাগছে।

প্রযুক্তি ও চ্যালেঞ্জ

চন্দ্র অভিযান সহজ কোনো কাজ নয়। এতে দরকার ছিল অত্যন্ত উন্নত প্রযুক্তি, জটিল রকেট ইঞ্জিনিয়ারিং, এবং অসাধারণ মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতি।

মূল প্রযুক্তিগুলো ছিল:

স্যাটার্ন V রকেট: পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে শক্তিশালী উৎক্ষেপণযান।

লুনার মডিউল (LM): চাঁদের মাটিতে নামা ও ঊর্ধ্বে ফিরে আসার যান।

কম্যান্ড মডিউল (CM): যেখানে মহাকাশচারীরা মিশনের অধিকাংশ সময় থাকতেন।

তবে ছিল বিপদের আশঙ্কাও — রেডিয়েশন, অক্সিজেন সংকট, নিয়ন্ত্রণ হারানো, চাঁদের পৃষ্ঠের অজানা অবস্থা ইত্যাদি।

মানব চন্দ্র অভিযানের অবদান

মানুষের চাঁদে যাওয়া শুধু কল্পনার পূরণই নয়, এর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত গুরুত্ব অনেক বেশি:

চাঁদের গঠন ও ইতিহাস বোঝা গেছে।

নতুন উপাদান (যেমন – মুন রক) পরীক্ষা করা গেছে।

স্পেস স্যুট, কম্পিউটার প্রযুক্তি, রাডার, যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়েছে।

মানব মহাকাশ অভিযানের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে গেছে।

এছাড়া এটি মানব জাতির আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে— মানুষ যে চাইলে এমনকি মহাকাশ জয় করতেও পারে।

দীর্ঘ বিরতি ও পুনরায় চন্দ্র অভিযানের প্রস্তুতি

১৯৭২ সালে অ্যাপোলো ১৭-এর পর আর কোনো মানুষ চাঁদে যায়নি। ব্যয়, রাজনৈতিক ইচ্ছার অভাব, ও নতুন লক্ষ্যের দিকে (যেমন – মহাকাশ স্টেশন ও মঙ্গল অভিযান) অগ্রসর হওয়ায় চন্দ্র অভিযান স্থগিত থাকে।

তবে এখন আবার নতুন করে শুরু হচ্ছে মানব চন্দ্র অভিযান। নাসার ‘আর্তেমিস প্রোগ্রাম’ লক্ষ্য করেছে ২০২৫-২৬ সালের মধ্যে আবার মানুষকে চাঁদে পাঠানো — এবং এবার নারী ও রঙিন বর্ণের মহাকাশচারীকেও অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

বর্তমানে শুধু নাসা নয়, চীন, রাশিয়া, ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি, ভারত এমনকি বেসরকারি সংস্থা যেমন SpaceX চাঁদে মানুষের বসবাস এবং গবেষণাগার তৈরির পরিকল্পনা করছে। ভবিষ্যতের লক্ষ্য:

চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি তৈরি করা

চাঁদের জলের ব্যবহার করে রকেট জ্বালানি উৎপাদন

চাঁদকে মঙ্গল অভিযানের ট্রানজিট হাব হিসেবে ব্যবহার

চাঁদের দক্ষিণ মেরু, যেখানে চিরস্থায়ী ছায়া ও বরফ রয়েছে, এখন মূল আগ্রহের কেন্দ্র।

মানব চন্দ্র অভিযান নিছক একটি প্রযুক্তিগত কীর্তি নয়, এটি মানুষের জ্ঞানের খোঁজে অদম্য মনোভাবের প্রতীক। আজ থেকে ৫০ বছরের বেশি সময় আগে মানুষ চাঁদের বুকে প্রথম পদচিহ্ন রেখেছিল, আর এখন আমরা নতুন অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হয়তো চাঁদে ঘুরতে যাবে, বিজ্ঞান গবেষণা করবে, এমনকি বসবাসও করবে। ইতিহাসের এই অধ্যায় তাই শুধু গর্বের নয়, ভবিষ্যতের জন্য এক অনুপ্রেরণা।

তথ্যসূত্র:

NASA.gov – Apollo Program

Smithsonian Air & Space Museum

BBC History: Moon Landing

National Geographic – Artemis Mission Coverage

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments