টেলিভিশন আবিষ্কার ইতিহাস
টেলিভিশন, আজকের দুনিয়ার অন্যতম শক্তিশালী গণমাধ্যম, যার মাধ্যমে মানুষ ঘরে বসে বিশ্ব দেখার সুযোগ পায়। কিন্তু এই প্রযুক্তির পেছনে রয়েছে এক দীর্ঘ, জটিল এবং যুগান্তকারী আবিষ্কারের ইতিহাস। এর সূত্রপাত বিশ শতকের গোড়ার দিকে হলেও, এর ধারণা এবং উপাদানগুলোর বিকাশ ঘটেছিল অনেক আগেই।
টেলিভিশনের ধারণার উত্থান
“টেলিভিশন” শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ “tele” (অর্থ: দূর) এবং ল্যাটিন শব্দ “vision” (অর্থ: দেখা) থেকে, যার অর্থ দাঁড়ায় “দূরে বসে দেখা”। এই ধারণাটি প্রথম আসে উনিশ শতকের শেষ দিকে, যখন বিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক সংকেতের মাধ্যমে ছবি পাঠানোর কৌশল নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রাথমিক অবদানকারী বিজ্ঞানীরা
পল নিপকো (Paul Nipkow) – জার্মান এই বিজ্ঞানী ১৮৮৪ সালে “Nipkow disk” নামে একটি যান্ত্রিক ডিভাইস উদ্ভাবন করেন, যা ছবিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পাঠাতে সাহায্য করত। এটিই ছিল প্রথম স্ক্যানিং মেকানিজম যা টেলিভিশনের ভিত্তি স্থাপন করে।
জন লোগি বেয়ার্ড (John Logie Baird) – স্কটল্যান্ডের এই বিজ্ঞানী ১৯২৫ সালে প্রথম কার্যকর টেলিভিশন ছবি প্রদর্শন করতে সক্ষম হন। ১৯২৬ সালে তিনি বিশ্বের প্রথম টেলিভিশন সম্প্রচার প্রদর্শন করেন। তাঁর ব্যবহৃত প্রযুক্তি ছিল যান্ত্রিক, এবং “greyscale” (সাদা-কালো) চিত্র তৈরি করতে পারত।
ফিলো টেলর ফার্নসওয়ার্থ (Philo T. Farnsworth) – মার্কিন যুক্ত্যের এই তরুণ বিজ্ঞানী ১৯২৭ সালে বিশ্বের প্রথম ইলেকট্রনিক টেলিভিশন সিস্টেম তৈরি করেন। তিনি ক্যাথোড রে টিউব (CRT) ব্যবহার করে ছবি পাঠানোর কৌশল উদ্ভাবন করেন, যা পরবর্তী সময়ে টেলিভিশন প্রযুক্তির মূল ভিত্তি হয়ে ওঠে।
ইলেকট্রনিক বনাম যান্ত্রিক টেলিভিশন
প্রথম দিককার টেলিভিশনগুলো ছিল যান্ত্রিক। এগুলোতে ঘূর্ণায়মান ডিস্ক ব্যবহার করে ছবিকে স্ক্যান করা হতো এবং তা আলোক সংকেতে রূপান্তরিত হতো। তবে এই পদ্ধতি অপ্রত্যাশিত এবং ধীর ছিল।
ফার্নসওয়ার্থের তৈরি ইলেকট্রনিক টেলিভিশন প্রযুক্তি যান্ত্রিক টেলিভিশনের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। এতে উচ্চ রেজোলিউশনে এবং দ্রুত গতিতে ছবি পাঠানো সম্ভব হয়।
প্রথম সম্প্রচার এবং টেলিভিশনের উত্থান
১৯৩০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে টেলিভিশনের পরীক্ষামূলক সম্প্রচার শুরু হয়। ১৯৩৬ সালে বিবিসি (BBC) বিশ্বের প্রথম নিয়মিত টেলিভিশন সম্প্রচার শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এই প্রযুক্তির অগ্রগতি কিছুটা ধীর হয়, তবে যুদ্ধ শেষে ১৯৪০ এবং ৫০-এর দশকে টেলিভিশন ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে, টেলিভিশন দ্রুত প্রতিটি পরিবারের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। সেই সময়কার জনপ্রিয় অনুষ্ঠান যেমন – “I Love Lucy”, “The Ed Sullivan Show” – ঘরে ঘরে দেখা যেত।
রঙিন টেলিভিশনের আবির্ভাব
প্রথম দিকের টেলিভিশনগুলো ছিল সাদা-কালো। ১৯৫৪ সালে এনবিসি (NBC) প্রথম রঙিন সম্প্রচার শুরু করে, যদিও রঙিন টেলিভিশন সেটের দাম বেশি হওয়ায় তা সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছাতে সময় লাগে। ১৯৬০-এর দশকে রঙিন টেলিভিশন ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
উপগ্রহ এবং কেবল টেলিভিশনের যুগ
১৯৬২ সালে “Telstar” নামক প্রথম কমার্শিয়াল টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ হয়, যার মাধ্যমে আন্তঃমহাদেশীয় টেলিভিশন সম্প্রচার সম্ভব হয়। এর ফলে টেলিভিশনের ব্যাপ্তি বিশালভাবে বৃদ্ধি পায়।
এরপর আসে কেবল টিভি। ১৯৭০ ও ৮০-এর দশকে কেবল টেলিভিশনের মাধ্যমে দর্শকরা বিভিন্ন চ্যানেল দেখতে শুরু করে। CNN, MTV, Discovery Channel ইত্যাদি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ডিজিটাল যুগ ও আধুনিক টেলিভিশন
২০০০-এর দশকে টেলিভিশন প্রযুক্তি পুরোপুরি ডিজিটাল হয়ে ওঠে। HD (High Definition), 4K, Smart TV, ইন্টারনেট সংযোগ ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি যুক্ত হয়। এখন টেলিভিশনের মাধ্যমে শুধু সম্প্রচার নয়, ইন্টারনেট, স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম (যেমন: Netflix, YouTube, Amazon Prime) এবং গেমিং সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে।
ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন
১০ আগস্ট, ১৯২৮ সালে, জন লগি বেয়ার্ড লন্ডনে অবস্থিত নিজের কোম্পানি অফিস প্রাঙ্গনে প্রথমবারের মতো স্টিরিওস্কোপীয় ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন (3D টেলিভিশন) প্রদর্শন করেছিলেন ।
বেয়ার্ড ইলেক্ট্রো-মেকানিক্যাল এবং ক্যাথোড-রে টিউব কৌশল ব্যবহার করে বিভিন্ন ত্রিমাত্রিক টেলিভিশন সিস্টেমের ভিত্তি গড়ে তুলে। প্রথম পূর্ণাঙ্গ ত্রিমাত্রিক টিভি ১৯৩৫ সালে উদ্ভাবিত হয়েছিল। ২০০০ এর দশকে ডিজিটাল টেলিভিশনের আবির্ভাবের ফলে ত্রিমাত্রিক টিভি আবিস্কারে ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়।
3D টিভি সেটগুলি 3D হোম মিডিয়া যেমন ব্লু-রে ডিস্কে দেখার জন্য বেশ জনপ্রিয়। তা সত্ত্বেও, 3D প্রোগ্রামিং জনসাধারণের মধ্যে সে তুলনায় জনপ্রিয় হতে পারে নি। ২০১০-এর দশকের গোড়ার দিকে চালু হওয়া অনেক 3D টেলিভিশন চ্যানেল ২০১০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে বন্ধ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের টেলিভিশনের ইতিহাস
বাংলাদেশে টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৪ সালে, যখন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশন (EPTV) নামে প্রথম সম্প্রচার শুরু হয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ টেলিভিশন (BTV) নামে পুনঃনামকরণ হয়। দীর্ঘদিন BTV ছিল একমাত্র রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেল।
২০০০-এর পর থেকে দেশে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল যেমন – Channel i, ATN Bangla, NTV, Ekushey TV ইত্যাদির উত্থান ঘটে এবং গণমাধ্যমে বৈচিত্র্য আসে।
টেলিভিশন প্রযুক্তির যাত্রাপথ ছিল বহু বিজ্ঞানীর নিরবিচার প্রচেষ্টা, আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফল। এটি কেবল বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং শিক্ষা, সংবাদ ও সংস্কৃতির আদান-প্রদানে এক অমূল্য মাধ্যম। প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেলিভিশন আজও নিজেকে নতুনরূপে রূপান্তরিত করছে এবং বিশ্বকে আমাদের ঘরের সামনে নিয়ে আসছে।
তথ্যসূত্র:
Encyclopedia Britannica
History of Television: Museum of Broadcast Communications
BBC Archives
National Geographic