Friday, October 3, 2025
Homeইতিহাসবালিয়াটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি মানিকগঞ্জ

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছে জমিদার বাড়ির অসংখ্য নিদর্শন। এগুলো শুধু স্থাপত্যকীর্তি নয়, বরং বাংলার সমাজ, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের একেকটি জীবন্ত দলিল। মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত বালিয়াটি জমিদার বাড়ি সেইরকম একটি অসাধারণ স্থাপত্য, যা বাংলার জমিদারি প্রথার ঐশ্বর্য ও ঐতিহ্য আজও ধারণ করে আছে। প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো এই স্থাপনাটি বর্তমানে দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত হলেও, এর ভেতরে লুকিয়ে আছে বহু গল্প, ইতিহাস এবং সংস্কৃতির স্মৃতি।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি কোথায় কোন জেলায় অবস্থিত

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশের মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়া উপজেলায় অবস্থিত। এটি মানিকগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পশ্চিমে এবং ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে বালিয়াটি গ্রামে অবস্থিত একটি ১৯ শতকে নির্মিত প্রাসাদ। ঢাকা থেকে সড়কপথে সহজেই পৌঁছানো যায়। বিশাল আয়তনের উপর নির্মিত এই বাড়িটি মূলত একাধিক প্রাসাদসমূহের সমন্বয়ে গঠিত, যা প্রায় ১৬০ বিঘা জমির ওপর বিস্তৃত।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির পরিধি

বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি মূলত একটি সুবিশাল প্রাসাদ যা পাঁচটি পৃথক ব্লকে বিভক্ত এবং এগুলোকে বড় তরফ, মেঝ তরফ, নয়া তরফ, ছোট তরফ ও আভ্যন্তরীণ অন্দরমহল নামে পরিচিত। এই ভবনগুলো পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে বিন্যস্ত এবং এদের প্রতিটির আলাদা স্থাপত্যশৈলী ও উদ্দেশ্য ছিল, যা বালিয়াটি জমিদার পরিবারের সমৃদ্ধি ও আভিজাত্যের পরিচয় বহন করে।

বালিয়াটি প্রাসাদটি পাঁচটি ব্লকে বিভক্ত, যার মধ্যে চারটি মূল ভবন এবং একটি অভ্যন্তরীণ অন্দরমহল। এই চারটি ভবনকে জনশ্রুতিতে বড় তরফ, মেঝ তরফ, নয়া তরফ, এবং ছোট তরফ নামে ডাকা হয়। বালিয়াটির জমিদার পরিবার থেকেই এই অংশগুলো তৈরি হয়েছিল এবং প্রতিটি ব্লকের নিজস্ব উদ্দেশ্য ছিল, যা জমিদারদের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থার প্রতিফলন। অন্দরমহল মূল ভবনগুলির পিছনে একটি সুউচ্চ দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত এলাকা ছিল, যা অন্দরমহল নামে পরিচিত এবং সেখানে জমিদার পরিবারের সদস্যরা বসবাস করতেন। আরও কিছু সহায়ক দালান ও স্থাপনাগুলো ঘিরে রয়েছে উঁচু প্রাচীর, প্রশস্ত উঠান, বাগান, পুকুর ও নানা অলঙ্করণ।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস

জমিদার পরিবারের উৎপত্তি

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির ইতিহাস শুরু হয় অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে, যখন ধনাঢ্য লবণ ব্যবসায়ী গোবিন্দ রাম সাহা এই পরিবারের গোড়াপত্তন করেন। বালিয়াটি জমিদার পরিবারের সূচনা হয় ১৯ শতকের দিকে ইউরোপীয় নব্য-শৈলীতে (Neo-Classical) নির্মিত এই বিশাল প্রাসাদসম ভবনটি মূলত বালিয়াটি জমিদার পরিবারের বিভিন্ন উত্তরাধিকারীদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল এবং এটি স্থানীয় শাসন ও সমাজ-সংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিল।

বালিয়াটি জমিদার পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন গোবিন্দ রাম সাহা, যিনি অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে একজন প্রভাবশালী লবণ ব্যবসায়ী ছিলেন। গোবিন্দ রাম সাহার বংশধররাই এই জমিদার পরিবারের উত্তরসূরি হিসেবে পরবর্তীকালে জমিদারিত্ব পরিচালনা করেন এবং বিভিন্ন ভবন নির্মাণ করেন। জমিদার পরিবারের অন্যতম উল্লেখযোগ্য উত্তরাধিকারী ছিলেন কিশোরীলাল রায় চৌধুরী, যিনি ঢাকার জগন্নাথ মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠার জন্য বিখ্যাত। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরেরা জমিদারি প্রথার মাধ্যমে ধীরে ধীরে জমি, সম্পদ ও প্রভাব বিস্তার করেন।

জমিদারি বিস্তার

ঊনিশ শতকের শুরু থেকে বিশ শতকের শুরু পর্যন্ত প্রায় শতাধিক বছর ধরে মানিকগঞ্জসহ পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে (যেমন ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল ও ত্রিপুরা) এই জমিদারদের বিশাল প্রভাব বিস্তৃত ছিল। তাদের পূর্বপুরুষ গোবিন্দ রাম সাহা একজন মহাজন ও ব্যবসায়ী হিসেবে বিপুল অর্থ উপার্জন করে জমিদারি ও তালুকদারি ক্রয় করেন এবং এর মাধ্যমে বালিয়াটির জমিদাররা পূর্ব ও পশ্চিম বাড়ি নামে পরিচিত দুই ভাগে জমিদারি শাসন শুরু করেন। গোপাল সাহার উত্তরসূরিরা, বিশেষত পঞ্চানন সাহা ও দয়ারাম সাহা, জমিদারি বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তারা শুধু সম্পদ অর্জন করেননি, বরং ব্রিটিশ শাসকদের কাছ থেকে জমিদারির খাজনা আদায়ের অধিকারও লাভ করেছিলেন। এর মাধ্যমে পরিবারটি দ্রুত সমৃদ্ধশালী হয়ে ওঠে এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী এক বংশে পরিণত হয়।

সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবদান

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির সাংস্কৃতিক ও সামাজিক অবদানে ছিল শিক্ষা, সমাজসেবা ও ধর্মীয় কর্মকাণ্ডের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। জমিদাররা নিজ ব্যয়ে চিকিৎসালয় স্থাপন ও বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্থানীয় শাসনের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করেন। এছাড়া, এই জমিদার বাড়ীর ঔপনিবেশিক স্থাপত্য এবং ইউরোপীয় রেনেসাঁস শৈলী স্থানীয় সংস্কৃতি ও পুরাকীর্তিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই পরিবার শুধু ধনসম্পদে সীমাবদ্ধ ছিল না। তারা স্থানীয় সমাজ ও সংস্কৃতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন। স্কুল, মন্দির ও নানা দাতব্য কার্যক্রমে অর্থ দান করেন। জমিদাররা গ্রামীণ অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নয়নে সহায়তা করেছিলেন।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির স্থাপত্যশৈলী মূলত ইউরোপীয় নব্য-ধ্রুপদী শৈলীর অনুকরণে তৈরি, যা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সংমিশ্রণে গঠিত এক চমৎকার উদাহরণ। এই প্রাসাদে কোরিন্থিয়ান পিলারের মতো ইউরোপীয় বৈশিষ্ট্য এবং স্থানীয় উপাদান যেমন উঠোন ও বন্ধনীযুক্ত ঝুলন্ত ছাদের ব্যবহার দেখা যায়। এই সংকর শৈলী জমিদারদের ব্রিটিশদের অনুকরণ করার প্রবণতা এবং স্থানীয় পরিবেশ ও সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষাকে তুলে ধরে। উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজ ঔপনিবেশিক স্থাপত্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এটি নির্মিত হয়। বাড়িটির প্রতিটি অংশেই রয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও নকশা।

বৈশিষ্ট্য

নব্য-ধ্রুপদী শৈলী: বাড়িটি ইউরোপীয় নব্য-ধ্রুপদী (Neo-Classical) স্থাপত্যের অনুকরণে নির্মিত।

সাতটি ভবন: এখানে মোট সাতটি ভবন রয়েছে, যার মধ্যে পাঁচটি বর্তমানে দৃশ্যমান। এই ভবনগুলো স্থাপত্যের ভিন্নতা ও সময়ের বিবর্তনের সাক্ষ্য বহন করে।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মিশ্রণ: বাড়িটির স্থাপত্যে ইউরোপীয় স্তম্ভ, খিলান, প্রতিসম সম্মুখভাগ এবং স্থানীয় উঠোন ও বন্ধনীযুক্ত ঝুলন্ত ছাদের মতো প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের উপাদানগুলো একে অপরের সাথে মিশেছে।

ফ্লোরাল টপ ও কোরিন্থিয়ান পিলারের ব্যবহার: প্রাসাদের সামনে চারটি প্রাসাদে ফ্লোরাল টপ সহ কোরিন্থিয়ান ধাঁচের পিলারের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়।

নির্মাণ উপকরণ: চুন-সুরকি, লোহার পাত এবং কাদামাটিতে নির্মিত প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২০ ইঞ্চি পুরু, যা এর শক্তিশালী নির্মাণ কৌশলকে নির্দেশ করে।

বাংলার ছোঁয়া: বারান্দা, খোলা উঠান, পুকুর ও বাগান, অভ্যন্তরীণ সাজসজ্জা রাজকীয় দরজা-জানালা, রঙিন কাঁচ, ফুলেল নকশা, লোহার তৈরি বারান্দা।

প্রধান স্থাপনা

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির প্রধান স্থাপনা বলতে এর মূল কেন্দ্রীয় ব্লক বা মূল ভবনটিকে বোঝায়, যা বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষিত আছে এবং এটি এই বিশাল প্রাসাদের একটি অংশ। বালিয়াটি জমিদার বাড়িটি মোট সাতটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা নিয়ে গঠিত, যার মধ্যে বিভিন্ন সময়ে নির্মিত ভবনগুলো রয়েছে।

পূর্ব দালান: অফিস ও প্রশাসনিক কাজের জন্য ব্যবহৃত হতো।

মধ্য দালান: জমিদার পরিবারের বসবাসের স্থান। এখানে নাচঘর, দরবার কক্ষ এবং অতিথিশালা ছিল।

পশ্চিম দালান: বিভিন্ন গুদামঘর, রান্নাঘর ও চাকর-বাকরের থাকার জায়গা।

জমিদার বাড়ির জীবনধারা

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির জীবনধারা ছিল সমৃদ্ধ ও বিলাসবহুল, যেখানে জমিদারি প্রথা অনুযায়ী প্রজাদের উপর শাসনকার্য পরিচালনার পাশাপাশি ধর্মীয় ও সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হত। এই বাড়িটিতে জমিদার পরিবারের সদস্যরা ইউরোপীয় ও স্থানীয় স্থাপত্যের মিশ্রণে নির্মিত প্রাসাদের বিভিন্ন অংশে বসবাস করতেন এবং ব্যক্তিগত জীবনে ভোগবিলাসী জীবনযাপন করতেন। এই বাড়িতে জমিদার পরিবারের জীবন ছিল বিলাসবহুল ও জমকালো। প্রতিদিন অসংখ্য চাকর-বাকর, অতিথি ও সাধারণ মানুষ আসা-যাওয়া করত। দরবার কক্ষে অনুষ্ঠিত হতো খাজনা আদায়, বিচার ও বৈঠক, নাচঘর ও সঙ্গীত কক্ষে সাংস্কৃতিক আসর বসত, অতিথিশালায় অতিথিদের জন্য থাকত রাজকীয় আপ্যায়ন। এভাবে জমিদার পরিবার শুধু অর্থনৈতিক প্রভাবই বিস্তার করেনি, বরং সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হিসেবেও পরিচিত হয়েছিল।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির জমিদারি প্রথার পতন

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির জমিদারি প্রথার পতন ঘটে ১৯৫০ সালের ‘পূর্ববঙ্গীয় রাষ্ট্রীয় অধিগ্রহণ ও প্রজাস্বত্ব আইন, ১৯৫০’ পাশের মাধ্যমে, যার ফলে ব্রিটিশ শাসনামলে গড়ে ওঠা জমিদারি ব্যবস্থার অবসান হয় এবং সকল ভূমি সরকারের অধীনে চলে যায়। এই আইনের ফলে জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হলে বালিয়াটির জমিদার পরিবার কলকাতায় চলে যায় এবং জমিদার বাড়িটি বাংলাদেশ সরকার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মাধ্যমে সংরক্ষণ করে। বালিয়াটি জমিদার পরিবারও তখন তাদের ক্ষমতা ও সম্পদ হারায়। ধীরে ধীরে জমিদার বাড়ি অযত্নে পড়ে যায়। বাড়িটি দীর্ঘদিন অবহেলায় থেকে নষ্ট হতে থাকে। অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র, কাঠামো ও শিল্পকর্ম হারিয়ে যায় বা চুরি হয়ে যায়।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির বর্তমান অবস্থা ও সংরক্ষণ

বর্তমানে বালিয়াটি জমিদার বাড়ি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। ১৯৮৭ সালে এটি সরকারের অধীনে আসে। এরপর ধীরে ধীরে সংরক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়। এখন এটি একটি ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর হাজারো দেশি-বিদেশি পর্যটক এখানে ভ্রমণ করেন। বাড়ির কিছু অংশ সংস্কার করা হলেও এখনও অনেক দালান ভগ্নাবস্থায় আছে।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির পর্যটন সম্ভাবনা

বালিয়াটি জমিদার বাড়ির পর্যটন সম্ভাবনা ব্যাপক, কারণ এটি উনিশ শতকের ঔপনিবেশিক স্থাপত্য ও কারুকার্যের এক অনন্য নিদর্শন, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যপ্রেমী আকর্ষণীয় গন্তব্য। বিশাল এই প্রাসাদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর কর্তৃক সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করা হয়েছে, এবং এর ২০০টি কক্ষ, সুক্ষ্ম নকশা, ও তৎকালীন জমিদারদের অভিজাত জীবনযাত্রার প্রতিফলন এটিকে পর্যটকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে তুলেছে।

বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পে বালিয়াটি জমিদার বাড়ির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। এটি রাজধানী ঢাকা থেকে অল্প দূরত্বে হওয়ায় সহজে যাওয়া যায়। এর অনন্য স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব পর্যটকদের আকর্ষণ করে। স্থানীয় অর্থনীতিতে পর্যটনের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। যদি আরও যথাযথ সংরক্ষণ, প্রচারণা ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায়, তবে এটি একটি আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।

বালিয়াটি জমিদার বাড়ি কেবল একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অমূল্য সাক্ষ্য। জমিদারি প্রথার উত্থান ও পতনের গল্প, গ্রামীণ সমাজের শাসনব্যবস্থা, জমিদার পরিবারের ঐশ্বর্য ও জীবনধারা—সবকিছুই এই প্রাসাদের দেয়ালে, খিলানে এবং ভগ্ন দালানে লুকিয়ে আছে।

এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, কালের বিবর্তনে কত কিছুই না পরিবর্তিত হয়। যে পরিবার একসময় অসংখ্য প্রজার উপর কর্তৃত্ব করত, বিপুল ধনসম্পদ ভোগ করত, তারাই জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির পর ধীরে ধীরে ইতিহাসের পৃষ্ঠায় হারিয়ে গেছে। অথচ তাদের রেখে যাওয়া এই স্থাপত্য আজও দাঁড়িয়ে আছে, যেন ইতিহাসকে নীরবে বর্ণনা করছে।

বাংলাদেশে বিদ্যমান অসংখ্য জমিদার বাড়ির মধ্যে বালিয়াটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কারণ, এটি শুধু আকার-আয়তনে নয়, নকশা, কারুকাজ এবং স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এক অনন্য উদাহরণ। ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রভাব, বাংলার ঐতিহ্যবাহী উপাদান, এবং স্থানীয় পরিবেশের সাথে মানানসই নকশার সমন্বয়—সব মিলিয়ে এটি হয়ে উঠেছে বাংলার ঔপনিবেশিক যুগের সাংস্কৃতিক প্রতিচ্ছবি।

তবে এই ঐতিহ্যের সংরক্ষণই এখন মূল চ্যালেঞ্জ। বহু বছরের অবহেলায় বাড়িটির অনেক অংশ ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কিছু উদ্যোগ থাকলেও আরও বিস্তৃত পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি যথাযথ সংরক্ষণ, পুনর্নির্মাণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ করা যায়, তবে এটি শুধু ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পের জন্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ হয়ে উঠতে পারে।

এখন সময় এসেছে এটিকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার। এখানে একটি জাদুঘর স্থাপন, গাইডেড ট্যুর ব্যবস্থা, তথ্যকেন্দ্র ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা যুক্ত করা যেতে পারে। একই সঙ্গে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ বাড়ানো হলে তারা অর্থনৈতিকভাবে উপকৃত হবে এবং ঐতিহ্য রক্ষায় আগ্রহী হবে।

সবশেষে বলা যায়, বালিয়াটি জমিদার বাড়ি শুধুই অতীতের স্মৃতিস্তম্ভ নয়, এটি আমাদের জাতীয় পরিচয়ের অংশ। এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ করা মানে আমাদের ইতিহাসকে বাঁচিয়ে রাখা, আগামী প্রজন্মকে সেই অতীতের সাথে পরিচিত করা। যদি আমরা এটিকে সঠিকভাবে রক্ষা করতে পারি, তবে এটি শুধু মানিকগঞ্জ নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্যই গর্বের এক নিদর্শন হয়ে থাকবে।

তথ্যসূত্র

মানিকগঞ্জ জেলার সরকারি ওয়েবসাইট

আহমেদ, নূরুল ইসলাম। বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। বালিয়াটি জমিদার বাড়ি সম্পর্কিত সরকারি প্রকাশনা।

খান, মুনতাসীর মামুন। বাংলার জমিদার ও জমিদারী প্রথা, ঢাকাঃ চৈতন্য প্রকাশনী।

Rahman, S. (2010). Heritage Sites of Bangladesh. Dhaka: Bangla Academy.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments