ইদ্রাকপুর কেল্লা মুন্সিগঞ্জ
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ধারায় মুঘল যুগ একটি স্বর্ণালী অধ্যায়। এই সময়কার দুর্গনির্মাণ শুধু সামরিক প্রয়োজন মেটাত না, বরং শাসনকর্তাদের দক্ষতা, নান্দনিকতা ও রাজনৈতিক কৌশলের পরিচায়ক হয়ে দাঁড়াত। ঢাকার নিকটবর্তী মুন্সীগঞ্জ জেলার ইদ্রাকপুরে অবস্থিত ইদ্রাকপুর কেল্লা মুঘলদের সামরিক স্থাপত্যের অন্যতম নিদর্শন। বর্তমানে এটি প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য হিসেবে টিকে আছে এবং ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।
ইদ্রাকপুর কেল্লা কি
মুন্সীগঞ্জ (Munshiganj) শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ইদ্রাকপুর কেল্লা (Idrakpur Fort) অবস্থিত। মোঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে সেনাপতি ও বাংলার সুবেদার মীর জুমলা কর্তৃক ১৬৬০ সালে বিক্রমপুরের এই অঞ্চলে ইদ্রাকপুর কেল্লা নামে এই দূর্গটি নির্মিত হয়। মগ জলদস্যু ও পর্তুগীজদের আক্রমন হতে এলাকাকে রক্ষা করার জন্য এই দূর্গটি নির্মিত হয়।
ইদ্রাকপুর কেল্লা কোথায় অবস্থিত
মুন্সীগঞ্জ শহরের প্রাণ কেন্দ্রে ইদ্রাকপুর কেল্লা অবস্থিত। জনশ্রুতি আছে এ দূর্গের সাথে ঢাকার লালবাগের দূর্গের সুড়ঙ্গ পথে যোগাযোগ ছিল। বহু উচ্চ প্রাচীর বেষ্টিত এই গোলাকার দূর্গটি এলাকায় এস.ডি.ও কুঠি হিসাবে পরিচিত।
ইদ্রাকপুর কেল্লার ঐতিহাসিক পটভূমি
ইদ্রাকপুর কেল্লার ঐতিহাসিক পটভূমি হলো, এটি আনুমানিক ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের শাসনামলে বাংলার সুবেদার ও সেনাপতি মীর জুমলা নির্মাণ করেন। তিনি ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ অঞ্চলকে মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজদের হামলা থেকে রক্ষা করার জন্য এবং ইছামতী ও ধলেশ্বরী নদীর তীরে মুঘল সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে এটি নির্মাণ করেন। তখনকার সময় মুঘল শাসকদের সবচেয়ে বড় শত্রু ছিল পর্তুগিজ ও আর্মেনীয় জলদস্যু এবং আরাকানিদের নৌবাহিনী। পদ্মা, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদীপথ ধরে ঢাকার দিকে আক্রমণ আসত ঘন ঘন। ঢাকার মূল কেন্দ্রকে রক্ষার জন্য নদীবাহিত জলদস্যুদের প্রতিরোধের প্রয়োজনীয়তা থেকেই এই দুর্গ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। মুন্সীগঞ্জ সেই সময়কার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর ছিল। এখানে স্থাপিত একটি শক্তিশালী দুর্গ জলপথ নিয়ন্ত্রণে রাখত এবং ঢাকার সুরক্ষার প্রথম ঢাল হিসেবে কাজ করত। তাই ইদ্রাকপুর কেল্লাকে কেবল একটি সামরিক স্থাপনা নয়, বরং ঢাকার প্রতিরক্ষা কৌশলের মূল স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
ইদ্রাকপুর কেল্লার স্থাপত্যশৈলী ও বৈশিষ্ট্য
ইদ্রাকপুর কেল্লার স্থাপত্যে প্রধানত মুঘল রীতির ছাপ রয়েছে, যা জলদস্যু ও পর্তুগিজ আক্রমণের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে রক্ষা করার জন্য নির্মিত হয়েছিল। কেল্লাটির মূল বৈশিষ্ট্য হলো এটি একটি ইটের তৈরি নদী-দুর্গ, যার মধ্যে একটি সুরঙ্গপথ ছিল যা ঢাকার লালবাগ কেল্লার সাথে সংযুক্ত ছিল। ইদ্রাকপুর কেল্লার আয়তন প্রায় ৮৭ মিটার লম্বা ও ৫৭ মিটার চওড়া। পুরো কেল্লাটি একটি উঁচু চত্বরের ওপর নির্মিত। চারপাশে উঁচু প্রাচীর এবং কোণায় গোলাকার বুরুজ (প্রহরী টাওয়ার) রয়েছে। প্রতিটি বুরুজে তোপ বা কামান বসানোর ব্যবস্থা ছিল।
স্থাপত্যশৈলী
ইদ্রাকপুর কেল্লা মুঘল স্থাপত্যের মূল বৈশিষ্ট্য বহন করে। এটি দিল্লি বা আগ্রার দুর্গের মতো বিশাল না হলেও ছোট আকারে সামরিক কার্যকারিতার দিক থেকে অত্যন্ত কার্যকর ছিল। ঢাকার লালবাগ কেল্লা ও জহুরুল ইসলাম কেল্লার সঙ্গে ইদ্রাকপুর কেল্লার নকশাগত মিল রয়েছে।
প্রধান বৈশিষ্ট্য
দুর্গের প্রাচীর – মোটা ইটের প্রাচীর দিয়ে পুরো দুর্গকে ঘিরে রাখা হয়েছে। প্রাচীরের উচ্চতা প্রায় ১৫ ফুট।
প্রধান প্রবেশদ্বার – উত্তর দিকের প্রবেশদ্বারটি সুরক্ষিতভাবে নির্মিত। এটি আর্চাকৃতির এবং এর উপরে প্রহরী রাখার ঘর ছিল।
বুরুজ – চার কোণায় এবং মধ্যবর্তী স্থানে মোট কয়েকটি গোলাকার বুরুজ রয়েছে। এগুলো থেকে একসাথে কামান ছোড়া যেত।
ভিতরের চত্বর – দুর্গের ভেতরে সৈন্যদের অবস্থানের জায়গা, ছোট ছোট ঘর এবং অস্ত্র মজুতের কক্ষ ছিল।
মধ্যবর্তী মঞ্চ – কেল্লার মাঝখানে একটি উঁচু চত্বর বা প্ল্যাটফর্ম আছে, যেখান থেকে আশপাশের নদীপথ দেখা যেত এবং সামরিক নির্দেশ প্রদান করা হতো।
গোপন সুড়ঙ্গ – কেল্লাটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর একটি সুরঙ্গপথ, যা মূলত ঢাকার লালবাগ দুর্গের সাথে সংযুক্ত ছিল, যা যুদ্ধের সময় বা জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ ব্যবস্থা বজায় রাখতে সাহায্য করত।
সামরিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব
ঢাকার সুরক্ষা
ইদ্রাকপুর কেল্লা বা দুর্গ মূলত মগ জলদস্যু ও পর্তুগিজ আক্রমণের হাত থেকে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে রক্ষা করার জন্য নির্মাণ করা হয়েছিল। ইদ্রাকপুর কেল্লা ঢাকার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ ছিল। আরাকান ও পর্তুগিজ জলদস্যুরা প্রায়শই পদ্মা-মেঘনা দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়ত। এই দুর্গ তাদের অগ্রযাত্রা রোধ করত।
নদীপথ নিয়ন্ত্রণ
মুন্সীগঞ্জের ভৌগোলিক অবস্থান কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এখান থেকে শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব ছিল। ফলে বাণিজ্য ও শাসন দুই দিক থেকেই দুর্গের ভূমিকা অপরিসীম। ইদ্রাকপুর কেল্লাটি এমন একটি কৌশলগত স্থানে নির্মিত হয়েছিল, যা দিয়ে জলপথের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা যেত। এটি নদীপথে আসা-যাওয়ার উপর নজরদারি করতে এবং প্রয়োজনে আক্রমণ বা প্রতিরোধের সুযোগ তৈরি করতে সাহায্য করত। সংক্ষেপে, ইদ্রাকপুর কেল্লার নদীপথ নিয়ন্ত্রণ ছিল জলদস্যুদের দমন, বাণিজ্যিক পথের নিরাপত্তা রক্ষা এবং মুঘলদের রাজনৈতিক ও সামরিক নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক
ইদ্রাকপুর কেল্লা সেই সময়ের প্রতিরক্ষামূলক সামরিক শক্তি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতীক হিসেবে কাজ করত। এই সুউচ্চ প্রাচীরযুক্ত দুর্গটি নৌ-পথ সুরক্ষিত রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল, যা মুঘল প্রশাসনের ক্ষমতার প্রতিফলন ঘটাত। স্থানীয় প্রজারা মুঘল শাসকদের শক্তি ও উপস্থিতি অনুভব করত এই দুর্গের মাধ্যমে।
মুঘল শাসনোত্তর অবস্থা
১৮শ শতকে মুঘল শাসন দুর্বল হয়ে পড়লে দুর্গটির গুরুত্বও কমে যায়। পরে ইংরেজ শাসনামলে এটি সৈন্যশিবির হিসেবে ব্যবহৃত হলেও ধীরে ধীরে অযত্নে পড়ে থাকে। স্থানীয়ভাবে অনেকে এর ইট খুলে নিয়ে যায় নির্মাণকাজে। তবুও মূল কাঠামো টিকে গেছে।
সংরক্ষণ ও প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব
ইদ্রাকপুর কেল্লার প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব অনেক বেশি, কারণ এটি মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক কৌশল, নদী পথে প্রতিরক্ষা, এবং তৎকালীন জলপথের নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। আধুনিককালে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এই কেল্লার সংরক্ষণে উদ্যোগ নিয়েছে এবং এটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য কাজ করছে। এর ভাঙাচোরা অংশ সংস্কার করা হয়েছে। বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে ঘোষিত। দুর্গের প্রতিটি ইট, প্রতিটি বুরুজ, প্রতিটি প্রবেশদ্বার মুঘল সামরিক কৌশল এবং ইতিহাসের সাক্ষী। গবেষকদের মতে, এটি দক্ষিণ বাংলার মুঘল দুর্গগুলোর মধ্যে অন্যতম অক্ষত নিদর্শন।
ইদ্রাকপুর কেল্লা ও স্থানীয় লোককথা
স্থানীয়দের মধ্যে কেল্লাকে ঘিরে নানা গল্প প্রচলিত আছে। কেউ বলেন, এর নিচে গুপ্তধন লুকানো আছে। আবার কেউ বিশ্বাস করেন, এখানে গোপন সুড়ঙ্গ ছিল যা দিয়ে সরাসরি ঢাকার লালবাগ কেল্লায় যাওয়া যেত। যদিও প্রত্নতাত্ত্বিকরা এসব দাবি নিশ্চিত করেননি, তবুও লোককথাগুলো কেল্লাটিকে রহস্যময় করে তোলে।
আধুনিক প্রেক্ষাপট
আজকের দিনে ইদ্রাকপুর কেল্লা একটি ঐতিহাসিক পর্যটনকেন্দ্র। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে গবেষক ও ইতিহাসপ্রেমী সবাই এখানে ভ্রমণে আসে। এটি স্থানীয় অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখে।মুন্সীগঞ্জে পদ্মা সেতুর কারণে যোগাযোগ সহজ হওয়ায় পর্যটন আরও বাড়ছে। ফলে ইদ্রাকপুর কেল্লা নতুন করে আলোচনায় এসেছে।
সমালোচনা ও চ্যালেঞ্জ
ইদ্রাকপুর কেল্লার প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো প্রাকৃতিক কারণে দেয়াল মাটিচাপা পড়া, পলি ও বালুর স্তর জমে যাওয়া এবং জলপথের পরিবর্তন। ফলে কেল্লার ঐতিহাসিক স্থাপত্য ও অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ঐতিহ্যবাহী স্থানটির রক্ষণাবেক্ষণে সমস্যা হচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কেল্লাটিকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হলেও, এর দীর্ঘমেয়াদী সংরক্ষণ ও সঠিক পরিচর্যা এখনো একটি বড় উদ্বেগের বিষয়। যদিও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করছে, তারপরও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে:
স্থানীয় অব্যবস্থাপনা ও আবর্জনা, অনিয়ন্ত্রিত ভ্রমণকারীদের কারণে ক্ষয়ক্ষতি, পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থা দুর্বল, আশপাশে অবৈধ দখল যদি যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়া হয়, ভবিষ্যতে দুর্গটির প্রাচীন সৌন্দর্য নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি আছে।
ইদ্রাকপুর কেল্লা কেবল একটি সামরিক দুর্গ নয়; এটি বাংলাদেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মুঘল আমলে নির্মিত এই কেল্লা আমাদেরকে শুধু সেই সময়কার রাজনৈতিক ও সামরিক কৌশলের পরিচয় করিয়ে দেয় না, বরং আমাদের ভূগোল ও সমাজকাঠামোর সঙ্গে ইতিহাসকে কীভাবে যুক্ত করে তা-ও বোঝায়। পদ্মা, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যার মতো নদীবাহিত অঞ্চল রক্ষার জন্য এই দুর্গ ছিল ঢাকার প্রধান সুরক্ষা বলয়। তাই একে শুধু একটি স্থাপনা হিসেবে দেখা যাবে না, বরং ঢাকার নিরাপত্তা, বাণিজ্য ও শাসন ব্যবস্থার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে দেখতে হবে।
তবে এই ঐতিহ্য রক্ষায় আমাদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। অব্যবস্থাপনা, ভাঙচুর কিংবা অবহেলা যদি চলতে থাকে তবে কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস হয়তো হারিয়ে যাবে। তাই প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ ও সচেতনতা।
ইদ্রাকপুর কেল্লা আমাদের জাতীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। এটি শুধু একটি স্থাপত্য নিদর্শন নয়; বরং বাংলার নদীভিত্তিক সভ্যতা, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও ঐতিহ্যের এক অমূল্য দলিল। যথাযথ সংরক্ষণ, গবেষণা ও প্রচারের মাধ্যমে একে আন্তর্জাতিক মানের ঐতিহ্যবাহী স্থানে রূপান্তরিত করা সম্ভব। এভাবে ইদ্রাকপুর কেল্লা শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মনেও অমর হয়ে থাকবে।
তথ্যসূত্র
বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা।
Karim, Abdul (1992). Dhaka: The Mughal Capital and City. Dhaka: Asiatic Society of Bangladesh.
Ahmed, Nazimuddin (1984). Islamic Heritage of Bangladesh. Dhaka: University Press Limited.
Ahmed, S. (2010). “Mughal Fortifications in Bengal.” Journal of Bengal Studies, Vol. 2.
UNESCO World Heritage tentative list archives (Bangladesh section).