Thursday, October 2, 2025
Homeইতিহাসকার্জন হল এর ইতিহাস

কার্জন হল এর ইতিহাস

কার্জন হল এর ইতিহাস

কার্জন হল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ভবন, যা পুরাকীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। ঢাকার শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে কার্জন হল একটি ঐতিহাসিক নিদর্শন। এর গৌরবোজ্জ্বল অতীত, অনন্য স্থাপত্যকলা এবং রাজনৈতিক গুরুত্ব এই ভবনটিকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতীক নয়, বরং বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত করেছে। উপনিবেশিক যুগে প্রতিষ্ঠিত এই ভবন আজো ঢাকার শিক্ষাজীবন, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এটি নির্মাণের জন্য অর্থায়ন দেন ভাওয়ালের রাজকুমার ও নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিলো ঢাকা কলেজ এর ব্যবহারের জন্য এবং ১৯২১ সালের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগ পর্যন্ত এটি ঢাকা কলেজ এর লাইব্রেরি ছিল। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান অণুষদের কিছু শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

কার্জন হল কবে প্রতিষ্ঠিত হয় ও নির্মাণের প্রেক্ষাপট

কার্জন হল ১৯০৪ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় এবং ১৯০৮ সালে এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ভবনটি মূলত একটি টাউন হল হিসেবে তৈরি করার উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের আবাসস্থল। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় ঢাকাকে নতুন পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী ঘোষণা করা হয়। রাজধানী শহর হিসেবে ঢাকায় অনেক নতুন স্থাপনার পরিকল্পনা করা হয়। এর মধ্যে একটি ছিল নতুন আইনসভার জন্য ভবন নির্মাণ। এই ভবনটিই পরবর্তীতে কার্জন হল নামে পরিচিতি পায়।১৯০৪ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন ঢাকায় আসেন। তাঁর সফরের সময়ই এই ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আইন পরিষদের বৈঠক কক্ষ বা টাউন হল হিসেবে ব্যবহার। বঙ্গভঙ্গ রদ (১৯১১) হওয়ার পর এটি আর আইনসভা হিসেবে ব্যবহৃত হয়নি। পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে ব্যবহার করা হয় এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই ভবনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।

কার্জন হল কোথায় অবস্থিত

কার্জন হল বাংলাদেশের ঢাকার শাহবাগে অবস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ঐতিহাসিক ভবন। এটি মূলত একটি টাউন হল হিসেবে তৈরি করার উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯০৪ সালে ভারতের তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড কার্জন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অংশ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

অবস্থান: কার্জন হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার শাহবাগ এলাকায় অবস্থিত।

কার্জন হলের স্থাপত্যশৈলী

কার্জন হলের স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় এবং মুঘল রীতির এক চমৎকার মিশ্রণ দেখা যায়, যা এটিকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক স্থাপত্যের একটি অনন্য উদাহরণে পরিণত করেছে। ভবনটি ইউরোপীয় নির্মাণশৈলীর বৈশিষ্ট্য বহন করে, যার মধ্যে আংশিকভাবে মুসলিম স্থাপত্যরীতিরও প্রভাব রয়েছে। কার্জন হল মুঘল ও সারাসেনিক রিভাইভাল শৈলীর এক অনন্য নিদর্শন।

ভবনটি মূলত লাল ইট দিয়ে নির্মিত, এতে মুঘল স্থাপত্যের মতো খিলান, মিনার, গম্বুজ এবং অলঙ্করণ লক্ষ্য করা যায়,পশ্চিমা ধাঁচের উপাদান যেমন—বারান্দা, সিঁড়ি ও বিশাল হলঘর—এটিকে আরও মহিমান্বিত করে তুলেছে। চারপাশে বিস্তৃত বাগান ও খোলা প্রাঙ্গণ ভবনটির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে। ভবনের মাঝখানে উঁচু গম্বুজ এবং চার কোণে ছোট ছোট টাওয়ার একটি প্রাসাদীয় বৈশিষ্ট্য যোগ করেছে। এই স্থাপত্যের মাধ্যমে ব্রিটিশরা উপনিবেশিক শাসনের আধিপত্য দেখাতে চাইলেও, এটি পরবর্তীকালে বাঙালি জাতির মুক্তিসংগ্রামের প্রতীকে পরিণত হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পর্ক

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কার্জন হল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও ভূতত্ত্বসহ বিভিন্ন বিভাগের ক্লাস ও ল্যাব এখানে চালু হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক প্রখ্যাত অধ্যাপক এই ভবনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আজও বিজ্ঞান অনুষদের প্রধান কেন্দ্র হিসেবে এটি ব্যবহৃত হয়।

কার্জন হলের রাজনৈতিক গুরুত্ব

কার্জন হলের রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এটি ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনা ও আন্দোলনের সাক্ষী। বিশেষ করে, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের সময় এটি ছাত্র আন্দোলন, সভা-সমাবেশ ও মিছিলের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় এখান থেকেই বহু প্রতিবাদ ও মিছিল সংগঠিত হয়েছিল, যা বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কার্জন হল কেবল একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রবিন্দু।

স্বাধীনতা সংগ্রাম: ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে মুক্তিসংগ্রামের সময় ছাত্র আন্দোলনের ঘাঁটি হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক বক্তৃতা, মিছিল ও সভা এখান থেকেই পরিচালিত হয়েছে।

ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্র: ১৯০৪ সালে ভাইসরয় লর্ড কার্জন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং এটি নির্মিত হয় বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাকে গড়ে তোলার জন্য। পরবর্তীকালে এটি বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রে পরিণত হয়।

ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত: ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময় কার্জন হল থেকে বহু প্রতিবাদ সভা ও মিছিল সংগঠিত হয়, যা বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।

কার্জন হলের সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূমিকা

কার্জন হল একটি ঐতিহাসিক ভবন যা বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এর সাংস্কৃতিক ও সামাজিক ভূমিকা হলো এটি বাংলাদেশের স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন, যা ব্রিটিশ আমলে নির্মিত হয়েছিল এবং ঢাকা শহরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। ভবনটি বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনের সাক্ষী, যা একে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যেমন—বিতর্ক, সাহিত্যসভা, নাটক—অনেক সময় এখানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তচিন্তা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে কার্জন হল এক অগ্রগণ্য স্থান দখল করে আছে। এটি শুধু শিক্ষা নয়, বরং সামাজিক অগ্রগতিরও প্রতীক।

সংরক্ষণ ও বর্তমান অবস্থা

আজও কার্জন হল তার ঐতিহাসিক মহিমা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এর অনেক অংশ নষ্ট হয়ে গেছে এবং সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মিলে এটি সংরক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বর্তমানে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অন্তর্ভুক্ত এবং প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষার্থী এখানে ক্লাস ও গবেষণায় অংশ নেয়। ইউনেস্কো ও অন্যান্য সংস্থা থেকেও এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব স্বীকৃত হয়েছে।

কার্জন হল এর ইতিহাস শুধু একটি ভবনের কাহিনি নয়, এটি আসলে বাংলাদেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক চেতনার এক জীবন্ত দলিল। লর্ড কার্জনের নামানুসারে প্রতিষ্ঠিত হলেও এই ভবন আজ আমাদের কাছে ব্রিটিশ শাসনের প্রতীক নয়, বরং আমাদের মুক্তি ও আত্মপরিচয়ের সংগ্রামের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপনিবেশিক শক্তির হাতে গড়ে ওঠা এই স্থাপনা কালের পরিক্রমায় বাঙালির জাতীয় জাগরণের অংশ হয়ে গেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূচনালগ্ন থেকে কার্জন হল বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র হিসেবে যে ভূমিকা পালন করেছে, তা আমাদের শিক্ষা ও গবেষণার ইতিহাসে এক অমর অধ্যায়। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, গণিত ও অন্যান্য বিজ্ঞানের পাঠচর্চা এখানে শুরু হয়েছিল বলেই আজকের বাংলাদেশের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। শুধু পাঠশালা নয়, এটি ছিল মুক্তচিন্তা ও মতপ্রকাশের এক পরিপূর্ণ ক্ষেত্র, যেখানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের চিন্তাধারা বিকশিত করার সুযোগ পেয়েছে।

রাজনৈতিকভাবে কার্জন হল বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় নাম। ভাষা আন্দোলনের সময় এখান থেকেই ছাত্ররা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্বাধীনতার পূর্বপ্রস্তুতির দিনগুলোতেও কার্জন হল ছিল ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। বলা চলে, এখানে উচ্চারিত স্লোগান, বের হওয়া মিছিল আর রক্তদানের ইতিহাস আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে স্বাধীনতা বা অধিকার কোনো দিন বিনা সংগ্রামে আসে না।

স্থাপত্যিক দিক থেকেও কার্জন হল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মুঘল-সারাসেনিক শৈলী উপনিবেশিক স্থাপত্যকলার এক অনন্য উদাহরণ, যা ঢাকার নগর-ঐতিহ্যের অংশ। ভবনটির সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্য শুধু নকশাগত নয়, বরং আমাদের ঐতিহ্যের ধারক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ। আজও এটি ঢাকা শহরের এক ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে পর্যটক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করে।

বর্তমানে কার্জন হল শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের কেন্দ্র নয়, এটি একটি জাতীয় ঐতিহ্য। এর প্রতিটি ইট যেন একেকটি ইতিহাসের সাক্ষী, প্রতিটি খিলান যেন আন্দোলন ও সংগ্রামের প্রতিধ্বনি বহন করে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই স্থাপনাটি সংরক্ষণ করা তাই অত্যন্ত জরুরি। কার্জন হলকে আমরা যত যত্নের সঙ্গে রক্ষা করব, ততই আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও জাতীয় গৌরব সংরক্ষিত হবে।

সবশেষে বলা যায়, কার্জন হল আমাদের কাছে অতীতের স্মৃতি, বর্তমানের শিক্ষা এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রেরণা। এটি কেবল একটি ভবন নয়, বরং বাংলাদেশের জ্ঞানচর্চা, স্বাধীনতা আন্দোলন ও জাতীয় চেতনার প্রতীক। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়—শিক্ষা ও সংগ্রামের সমন্বয়েই একটি জাতি তার প্রকৃত পরিচয় ও মর্যাদা অর্জন করতে পারে।

তথ্যসূত্র

আহমেদ, সৈয়দ মুজাফফর (২০০০)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস। ঢাকা: বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশনী।

রাহমান, মোহাম্মদ হাবিবুর (২০০৪)। ঢাকার স্থাপত্য ঐতিহ্য। ঢাকা: বাংলা একাডেমি।

Hasan, S. M. (1980). History of Dhaka University. Dhaka University Press.

Ahmed, Nazimuddin (1984). Islamic Heritage of Bangladesh. Dhaka: Bangladesh Itihas Parishad.

“Curzon Hall.” Banglapedia – National Encyclopedia of Bangladesh. Asiatic Society of Bangladesh.

Itihasar Golpo
Itihasar Golpohttps://itihasargolpo.com
Step into the past with our unforgettable historical journey. Discover the secrets of history on our captivating journey.
RELATED ARTICLES

1 COMMENT

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

Most Popular

Recent Comments